স্থপতি জানালেন

‘আগ্রাসন বিরোধী আট স্তম্ভ’ তৈরির পিছনের গল্প

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ২২: ৪০
আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ২২: ৪৩

ঢাকার পলাশীতে গতকাল উদ্বোধন হয়েছে আবরার ফাহাদ স্মৃতিস্তম্ভ ,‘আগ্রাসন বিরোধী আট স্তম্ভ’। অনেকে জানেন না, এই স্মৃতিস্তম্ভের পেছনে আছে অনেক পরিশ্রম আর একাগ্রতার গল্প। উদ্যোক্তারা মনে করেন, যদি এই গল্প বলা না হয়, তবে একদিন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে এই অসাধারণ উদ্যোগের ইতিহাস।

এক ফেইসবুক পোস্টে এমনটাই জানান স্থপতি নাজমুল হক নাঈম।

বিজ্ঞাপন

তিনি জানান , আবরার ফাহাদের স্মৃতিকে ধারণ করে এমন কিছু তৈরি করার চিন্তা থেকেই শুরু হয় এই প্রকল্পের যাত্রা। উদ্যোক্তারা চেয়েছিলেন এমন একটি স্থাপনা গড়ে তুলতে, যা শুধু আবরারের স্মৃতিই নয়, বরং আগ্রাসন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনাকেও বহন করবে।

প্রথমে একটি নকশা প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয়। জমা পড়ে চারটি প্রাথমিক ডিজাইন , বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী স্থপতি সাঈদ আহমেদ (১৯৯৩–৯৪), স্থপতি সাদ সিদ্দিকী (২০১৪–১৫) এবং স্থপতি সেজান হোসাইন (২০১৯–২০)-এর তৈরি প্রস্তাবগুলো।

স্থপতি নাজমুল হক নাঈম জানান, সেখান থেকে উদ্যোক্তারা যেটি বেছে নেন, সেটির চূড়ান্ত রূপ দেন স্থপতি নাজমুল হক নাঈম। স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে যুক্ত ছিলেন বুয়েটিয়ান ইঞ্জিনিয়ার তাইফুর রহমান ও ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান। ডিজাইনের ত্রিমাত্রিক ভিজ্যুয়াল তৈরি করেন স্থপতি উৎস, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচার বিভাগের সাবেক ছাত্র।

স্মৃতিস্তম্ভটির ধারণা ছিল গভীর এবং প্রতীকী। এর আটটি স্তম্ভ আটটি মৌলিক আদর্শের প্রতীক:

মানবিক মর্যাদা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, দেশীয় শিল্প ও কৃষি রক্ষা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, গণপ্রতিরক্ষা, গণতন্ত্র এবং সার্বভৌমত্ব।

এই আটটি ধারণা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেন একে অপরের হাত ধরে ধীরে ধীরে নিয়ে যায় জাতীয় সার্বভৌমত্বের দিকে।

স্থপতিরা চেয়েছিলেন, যেন প্রতিটি স্তম্ভ দেখতে মনে হয় শূন্যে ভাসছে , যেন এক অদৃশ্য শক্তি এগুলোকে ধরে রেখেছে। স্তম্ভগুলোর নিচে কালো বেইস, যা শোকের প্রতীক। সেই বেইসের সঙ্গে স্তম্ভগুলো যুক্ত কিছু কালো ধাতব সাপোর্টের মাধ্যমে, যাতে রাতের বেলা এগুলো ভেসে থাকা প্রতীকী অবয়বের মতো দেখায় , যেন তারা অসম্ভব সাহসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মাঝের কংক্রিট অংশটি দৃঢ়তার প্রতীক , আবরারের মতো মানুষদের, যারা প্রতিকূলতার মধ্যেও আদর্শে অটল থাকে।

উপরের জং ধরা মেটালের অংশে অসংখ্য ছিদ্র, যা অন্যায় ও সহিংসতার দাগ বহন করে। এটি শোষিতের ক্ষতবিক্ষত শরীরের প্রতীক, আবার একই সঙ্গে শহীদদের অমর স্মৃতির বহিঃপ্রকাশ।

রাতে সেই ক্ষতবিক্ষত অংশ থেকে বেরিয়ে আসে আলো , যেন নতুন পথিকদের পথ দেখাচ্ছে। সেই আলো উপরের দিকে ছুটে যায়, যেন তাদের অনন্ত যাত্রার বার্তা বহন করছে।

এই স্মৃতিস্তম্ভ বাস্তবায়নের কাজটি সহজ ছিল না। শুরু থেকে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন একদল তরুণ — এম. ওয়ালি উল্লাহ (সেশন ২০১৩–১৪), শামসুজ্জামান সম্রাট (২০১৬–১৭), আলী আম্মার মুয়াজ (২০১৬–১৭), আবরার ফাইয়াজসহ আরও অনেকে।

সিটি কর্পোরেশন, বুয়েট, ট্র্যাফিক বিভাগ—প্রতিটি জায়গায় ঘুরে তারা এই প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে শামসুজ্জামান সম্রাট অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন, যেন সময়মতো প্রকল্পটি বাস্তবে রূপ নেয়।

তিনি আরো জানান, এনসিপি নেতা আখতার হোসেন ও তার টিম পিছনে কাজ করেছেন প্রজেক্টটি বাস্তবায়নের ও নামকরণে। এবং আইডিয়া দিয়ে সাহায্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া নিজে তত্ত্বাবধান করেছেন কাজটি সম্পন্ন করতে দ্রুত সময়ের ভিতর। সিটি কর্পোরেশন এর একঝাঁক ইঞ্জিনিয়ার,ঠিকাদার এবং নির্মাণ শ্রমিক দিন রাত কাজ করে বাস্তবায়ন করেছেন নির্দিষ্ট দিনের ভেতর। সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও শ্রমিকরাও দিনরাত কাজ করেছেন নির্ধারিত সময়সীমা রক্ষা করে।

নানা বাধা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে ‘আগ্রাসন বিরোধী আট স্তম্ভ’ আবরার ফাহাদের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার চেতনার প্রতীক হয়ে।

উল্লেখ্য, এই স্মৃতিস্তম্ভ আজ শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি এক প্রজন্মের বিশ্বাস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, আর জাতীয় আত্মমর্যাদার প্রতিচ্ছবি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত