বিশ্ব শিশু দিবস আজ

শিশুদের বেদনাদায়ক আত্মত্যাগে মহীয়ান জুলাই বিপ্লব

এমরানা আহমেদ
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৩: ২০
ফাইল ছবি

৫ আগস্ট ২০২৪ ছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের দিন। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ওই দিনে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ লেখা প্লাকার্ড হাতে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে শরিক হতে পরিবারের সঙ্গে বেরিয়েছিল জাবির ইব্রাহিম (৬)। উত্তরা দক্ষিণখানের কেজি মডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্র ছোট্ট জাবিরের মনে তখন দেশপ্রেমের অদম্য বাসনা।

সেদিন উত্তরা স্কলাস্টিকা স্কুলের উল্টো পাশে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে অবস্থান করছিল জাবির ও তার পরিবারের সদস্যরা। বিকাল সাড়ে ৪টার হঠাৎ রাস্তার উত্তর দিক থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ সদস্য সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে এবং ফাঁকা গুলি করতে করতে সামনে এগোতে থাকে। আতঙ্কে উপস্থিত অনেকেই দৌড়াতে থাকেন। এ সময় জাবিরকে কোলে নিয়ে বাবা কবির হোসেন ভূঁইয়াও দৌড়াতে শুরু করেন। কিছু দূর এগোতেই ‍জাবিরের গায়ে এসে লাগে একটি গুলি। তার রক্তে বাবার পুরো শরীর ভিজে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

বিজ্ঞাপন

জাবিরের মা রোকেয়া বেগম বলেন, আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। আমি শুধু মা। ওরা আমার ছোট্ট, নিষ্পাপ জাবিরকে আমার চোখের সামনে মেরে ফেলেছে। বাবা কবির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, দেশের জন্য নিজের প্রাণপ্রিয় ছেলেকে উৎসর্গ করেছি। ছেলের প্রাণের বিনিময়ে যদি দেশ ও দেশের মানুষ ভালো থাকে, তবেই আমার পরিবারের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। সেই সঙ্গে এ গণহত্যায় জড়িত প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানান তিনি।

জুলাই আন্দোলনে নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শিশুর বয়স ছিল মাত্র চার বছর; নাম আবদুল আহাদ। গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে ১১ তলা একটি ভবনের আট তলায় নিজের বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয় আহাদ। পরিবারের বর্ণনা অনুযায়ী, হেলমেটধারীরা আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি চালানোর সময় একটি গুলি আহাদের ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথায় বিদ্ধ হয়। পরের দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়।

আহাদের মতোই বাসায় থেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আরো তিন শিশু। তারা হলো- রাজধানীর মিরপুরে সাফকাত সামির (১০), উত্তরায় নাঈমা সুলতানা (১৫) ও নারায়ণগঞ্জে রিয়া গোপ (৬)। গণঅভ্যুত্থানের প্রথম কোনো শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৭ জুলাই; ভোলার মো. সিয়াম (১৫) ঢাকায় বেড়াতে এসে যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

বিশ্ব শিশু দিবস ও জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে ৮ অক্টোবর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমি যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এ অনুষ্ঠানে জুলাই আন্দোলনে নিহত শিশুদের পরিবারকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেখানে নিহত শিশুদের অভিভাবকরা সন্তান হারানোর অনুভূতি জানাবেন। এছাড়া শিশুদের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শিত হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, সভাপতিত্ব করবেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ। ইউনিসেফ প্রতিনিধি ও শিশু প্রতিনিধিরাও বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনে মোট ১৩৩ শিশু-কিশোর শহীদ হয়েছে। তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থী ৯১ জন; যা মোট মৃত্যুর ৬৮ শতাংশ। বাকিরা অনানুষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত ছিল বা বিভিন্ন খাতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ছিলেন ১১৭ জন। মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

শহীদ শিশুদের মধ্যে চারজন মেয়ে শিশুও রয়েছে—রিয়া গোপ (৬), নাঈমা সুলতানা (১৫), রিতা আক্তার (১৭) ও নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)। তাদের মধ্যে রিয়া বাসার ছাদে ও নাঈমা বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। রিতা ও নাফিসা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

জুলাই অভ্যুত্থানে কয়েকজন শহীদ শিশুর নাম দেশের লোকমুখে এখনো ঘুরে বেড়ায়— পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শাহারিয়ার খান আনাস (১৬) ৫ আগস্ট বাড়িতে একটি চিঠি রেখে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল। চিঠিতে সে লিখেছিল, মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। মৃত্যুভয়ে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। ওই দিন রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলিতে মৃত্যু হয় আনাসের।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া (১৭) ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এর একদিন আগে সে নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছিল, ‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’

এদিকে এসব হত্যাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুমাইয়া মামুন সিমরান। তিনি বলেন, চোখের সামনে যেভাবে নিজের দেশের সাধারণ মানুষসহ নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা হয়েছে, তা জাতির মুখে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে। তবে এটা একদিক দিয়ে গর্বের বিষয়ও বটে। দেশের স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বুক পেতে দিয়েছিল শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী মানুষ। আমি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন শিক্ষক হিসেবে এ গণহত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত