চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত শহীদ ওয়াসিম আকরাম এক্সপ্রেসওয়ে দিন দিন মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে। গতিসীমা না মানা, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, সাত বছরেও অসম্পন্ন কাজ ও কোনো ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি। চলতি নভেম্বরেই এই উড়াল সড়কে তিনটি প্রাইভেটকার দুর্ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার নগরের নিমতলা বিশ্বরোড অংশে একটি প্রাইভেটকার সড়কের বাইরে গিয়ে পড়ে এক পথচারীসহ পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এর মধ্যে এক সাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে গত এক বছরে দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়। এছাড়াও প্রায় সময় উড়াল সড়কে ছোট-বড় দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। এত প্রাণহানি ও দুর্ঘটনার পরও এখন পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের নজরদারিও চোখে পড়ার মতো নয়।
নগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, পতেঙ্গা অংশে একটি টোল প্লাজা স্থাপন করেই দায় সেরেছে সিডিএ। সেখানে দু-একজন নিরাপত্তা কর্মী থাকলেও তারা পুরো ১৫ কিলোমিটার উড়াল সড়কে কোনো দায়িত্ব পালন করেন না। এছাড়াও সিএমপির ট্রাফিক (বন্দর) বিভাগের তৎপরতাও উড়াল সড়কে নেই বললেই চলে। লালখান বাজার থেকে উড়াল সড়ক শুরু হলেও সেখানে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকা যানবাহনও বিনা বাধায় উঠে পড়ছে সড়কে। এছাড়াও প্রায় স্থানে সড়কের পাশে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই।
গত শুক্রবার সকালে শহীদ ওয়াসিম আকরাম উড়াল সড়কে সরেজমিনে দেখা যায়, পথচারীরাও উড়ালসড়কে হাঁটছেন। এছাড়াও অনেক যানবাহন থামিয়ে যাত্রীরা নেমে পড়ছেন। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছেন, কেউ ছবি তুলছেন। আবার কয়েকটি গ্রুপ টিকটক ভিডিও তৈরি করছেন। এ সময় আরো দেখা যায়, উড়াল সড়কে কোনো গতিসীমা মানা হচ্ছে না। প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা সবচেয়ে বেশি গতিসীমা লঙ্ঘন করছে। কিছু স্থানে গতিরোধক থাকলেও সেগুলোর তোয়াক্কা করছে না চালকরা।
এছাড়াও কোনো স্থানে নেই সিসি ক্যামেরা। সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার আর বাঁক এলাকায় ৪০ কিলোমিটার। যানবাহন থামানো ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সিডিএ।
গত ৫ ও ১২ নভেম্বর দুটি প্রাইভেটকার উল্টে যায় উড়াল সড়কের পতেঙ্গা অংশে। সর্বশেষ গত শুক্রবার একটি জিপ উড়াল সড়ক থেকে ছিটকে বাইরে পড়ে যায়। এতে গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে একজন মারা যান।
জানা যায়, নগরের দেওয়ানহাট, বারিক বিল্ডিং, সল্টগোলা, ইপিজেড, কাটগড় এলাকায় উড়াল সড়কে বাঁক রয়েছে। এসব পয়েন্টেই ছোট-বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।
সিডিএ সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ট্রাক, বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে সিএনজি, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল সবচেয়ে বেশি চলাচল করে উড়াল সড়কে। চলাচলের সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে আছে, কার ও মাইক্রোবাস।
উড়াল সড়কটি ব্যবহারকারী চালকরা জানিয়েছেন, কখনো পেছন থেকে এসে অন্য যানবাহন ধাক্কা দেয়, কখনো গাড়ি অতিরিক্ত গতির কারণে উল্টে যায়। এছাড়াও যেসব যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে সেসব ওঠতে কোনো বাধা দেওয়া হয় না।
জানা যায়, ২০১৭ সালে সাবেক চসিক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এক্সপ্রেসওয়ে নামে উড়াল সড়কটির কাজ শুরু হয়। এতে ব্যয় হয় ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে এটির উদ্বোধন করা হলেও এখনো অনেক অংশে কাজ শেষ হয়নি। গত বছরের আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষামূলক যানবাহন চলাচল শুরু হয়। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে উদ্বোধন করা হয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এটির নাম পরিবর্তন করে শহীদ ওয়াসিম আকরাম উড়াল সড়ক রাখা হয়।
সিডিএ বলছে, বর্তমানে ৯২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে এখনো যানবাহনের সংখ্যা অনেকাংশেই কম। সিডিএর তথ্য মতে, গত দশ মাসে শহীদ ওয়াসিম আকরাম উড়াল সড়কে মোট যানবাহন চলে ২৪ লাখ ৩৫ হাজার ৭৮৮টি। এতে রাজস্ব আয় হয় ১৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
সড়কটি চালু হওয়ার আগে সম্ভাব্য সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চলতি বছর প্রতিদিন গড়ে ৬৬ হাজার ৩২৩টি যানবাহন চলবে। অথচ বাস্তবে চলছে মাত্র ৮ হাজার ১১৯টি। এতে যানজট কমার আশা করা হলেও নগরবাসীর মুক্তি মেলেনি যানজট থেকে।
বিষয়টি নিয়ে সিএমপির মুখপাত্র সহকারী পুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) আমিনুর রশিদ জানান, আমাদের নিয়মিত নজরদারি রয়েছে। কোনো যানবাহন গতিসীমা লঙ্ঘন করলেই আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। প্রায় সময় মামলা হয়, চেকপোস্ট বসানো হয়। তবে উড়াল সড়কে মাসের হিসাবে দুর্ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই।
এ বিষয়ে সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান জানান, এসব বিষয়ে আমরা পুলিশকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। আমাদের দিক থেকে নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই, সব ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মোটরসাইকেল চালকরা আইন মানতে নারাজ। তারা নানা পরিচয়ে জোরপূর্বক উড়াল সড়ক ব্যবহার করছে। আমরা গতি ক্যামেরা বসাচ্ছি আর দুশ সিসি ক্যামেরা স্থাপন করছি। এতে কে আইন ভঙ্গ করছে সেটা দেখা যাবে। পুলিশ তাৎক্ষণিক জরিমানা করবে।
সিডিএর উপ-প্রধান প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী জানান, প্রকল্পের পুরো বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হলে ফলাফল পাওয়া যাবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসিটিভি ক্যামেরাও স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

