স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণের সময়সীমা প্রায় কাছাকাছি। আগামী বছরের ২৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের কথা রয়েছে। সেই হিসাবে ক্যালেন্ডার ধরে আর মাত্র এক বছর রয়েছে। তবে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট, অর্থনীতি, শিল্প ও ব্যবসা পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি গ্রহণ উপযুক্ত কি না—সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এলডিসি উত্তরণ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের মত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ‘হাব’ নিয়ে বর্তমান সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তকে ‘সাধারণ’ নয় বলে মনে করছেন তিনি। তারেক রহমান বলছেন, গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটে থাকা সরকারই কেবল চট্টগ্রাম বন্দরের মতো স্থাপনায় কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও এক্সে (সাবেক টুইটার) নিজের ভেরিফাইড অ্যাকাউন্ট থেকে এ সংক্রান্ত পোস্টটি করেন। সেখানে তিনি উদাহরণ টেনে এলডিসি উত্তরণ ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রসঙ্গে বিশদ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
তারেক রহমানের পোস্ট হুবহু তুলে ধরা হলো—
গাজীপুরের একজন ছোট পোশাক কারখানার মালিককে কল্পনা করুন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি তার ব্যবসা গড়ে তুলেছেন, শতাধিক কর্মীকে চাকরি দিয়েছেন, সীমিত মুনাফা সামলেছেন এবং এক কঠিন আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা করেছেন। একদিন দৃশ্যমান কোনো ঘোষণা ছাড়াই, যে শুল্ক সুবিধাগুলো তার পণ্যের দাম প্রতিযোগিতামূলক রেখেছিল, তা নিঃশব্দে উধাও হয়ে যায়। ফলে তার অর্ডার কমে যায় এবং কারখানা চালু রাখা, কর্মীদের বেতন দেয়া এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার চাপ বাড়তে থাকে।
এবার নারায়ণগঞ্জের একজন তরুণীকে কল্পনা করুন, যিনি তার পরিবারের অনিশ্চয়তায় তলিয়ে যাওয়া দেখছেন। তার বাবা একটি কারখানায় কাজ করেন। অতিরিক্ত আয়ের (ওভারটাইম) ওপর তিনি নির্ভরশীল। রপ্তানির চাপ বাড়লে সবার আগে ওভারটাইম বন্ধ হয়। এরপর শিফট কাটছাঁট করা হয়। তারপর চাকরি চলে যায়। এগুলো কোনো শিরোনাম নয়। এগুলো সাধারণ ঘরের ভেতরে ঘটে যাওয়া নীরব সংকট।
এই সিদ্ধান্তের জন্য তারা কখনো ভোট দেননি। তাদের কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আসল সংখ্যাগুলো তাদের কখনো দেখানো হয়নি। এ কারণেই বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের বিতর্কটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিএনপি আগেও বলেছে, এলডিসি স্থগিতের বিকল্পটি খোলা না রেখে ২০২৬ সালের সময়সীমা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যা এমন একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিচ্ছে যাদের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার ম্যান্ডেট নেই। অথচ তারা এমন দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যা আগামী দশক ধরে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
আমাদের বলা হয় যে বিলম্ব ‘অসম্ভব’, এমনকি স্থগিতের জন্য অনুরোধ করাটাও এক ধরনের ‘অপমান’ হবে, যা জাতিসংঘ (ইউএন) বিবেচনাও করবে না। কিন্তু আমরা যদি আরও নিবিড়ভাবে দেখি, তবে ইতিহাস আরও জটিল গল্প বলে।
অ্যাঙ্গোলা এবং সামোয়ার মতো দেশগুলোর উত্তরণের সময়সূচি রদবদল করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়লে জাতিসংঘের নিয়মাবলীতেই নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে। দেশ গঠনের ফলাফল সম্পর্কে সময় চাওয়া কেবল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীল শাসন। কিন্তু আমরা কেন ভান করছি যে, কোনো বিকল্প নেই? আমরা কেন আমাদের ভবিষ্যতকে সীমিত করছি?
স্থগিতের বিকল্পটি প্রকাশ্যে বাতিল করে দিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের দর কষাকষির ক্ষমতা দুর্বল করে দিচ্ছি। আমরা আন্তর্জাতিক আলোচনায় আমাদের হাত আগেই উন্মুক্ত করে প্রবেশ করছি, আলোচনার টেবিলে বসার আগেই নিজেদের সুযোগ (Leverage) বিসর্জন দিচ্ছি।
সরকারের নিজস্ব নথিপত্রও স্বীকার করে যে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক মহল ইতোমধ্যেই ব্যাংকিং খাতে চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ, ক্রমবর্ধমান ঋণের ঝুঁকি এবং রপ্তানি কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন।
এটা উত্তরণের বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি নয়। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু উত্তরণের ‘অধিকার’ থাকা আর উত্তরণের জন্য ‘প্রস্তুত’ থাকা এক জিনিস নয়।
আমি মনে করি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ না থাকাকে প্রকৃত জাতীয় শক্তি বলা যায় না। আসল জাতীয় শক্তি হলো সেই শৃঙ্খলা থাকা, যার মাধ্যমে ক্ষতির মাত্রা অপরিবর্তনীয় হওয়ার আগেই কঠিন প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করা যায়।
এবার চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে তাকান, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার। সেখানে যা ঘটে, তা যেকোনো রাজনৈতিক বক্তৃতার চেয়েও লাখ লাখ মানুষের জীবনকে বেশি প্রভাবিত করে।
বন্দর সংক্রান্ত সাম্প্রতিক দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্তগুলো সাধারণ নয়। এগুলো একটি জাতীয় সম্পদ নিয়ে কৌশলগত প্রতিশ্রুতি, যা একটি অন্তর্বর্তী সরকার দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে—যার কাছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাধ্য করার মতো গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরে আমরা যা দেখছি, তা এলডিসি উত্তরণের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। কৌশলগত বিকল্পগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। জনবিতর্ককে একটি সমস্যা হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। বৈধ উদ্বেগগুলোকে গতি এবং অনিবার্যতার অজুহাতে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে।
আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, এটা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বকে আক্রমণ করার বিষয় নয়। এটি প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার এবং এই নীতির ওপর জোর দেয়ার বিষয় যে—যেসব সিদ্ধান্ত দেশের জীবনকে দশক ধরে প্রভাবিত করবে, সেগুলো জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকারের মাধ্যমে নেয়া উচিত।
কেউ বলছে না যে, আমাদের এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণ বা বন্দরের সংস্কার করা উচিত নয়। যুক্তিটি আরও সরল এবং মৌলিক; একটি জাতির ভবিষ্যৎ এমন একটি সরকার দ্বারা স্থির করা উচিত নয়, যেটিকে জাতি নির্বাচন করেনি।
কৌশলগত ধৈর্য দুর্বলতা নয়। জনপরামর্শ কোনো বাধা নয়। গণতান্ত্রিক বৈধতা বিলম্ব নয়। আর আমার মতে, সম্ভবত এটাই এর নিচে লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য।
বাংলাদেশের মানুষ কখনো তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় ছিল না। তারা কষ্ট সহ্য করেছে এবং ত্যাগ স্বীকার করেছে কারণ তারা মর্যাদা, কণ্ঠস্বর এবং পছন্দে বিশ্বাসী।
তাদের চাওয়া সহজ: শোনা, অংশগ্রহণ করা এবং সম্মানিত হওয়া।
এ কারণেই আমাদের অনেকেই ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে—যা বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার, পছন্দ করার এবং একটি সহজ সত্যকে পুনর্ব্যক্ত করার একটি সুযোগ।
এই দেশের ভবিষ্যৎ অবশ্যই দেশবাসীর দ্বারা নির্ধারিত হতে হবে, ‘সবার আগে বাংলাদেশ’-এই বিশ্বাস নিয়ে।

