স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্য প্রার্থী নিয়োগ

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮: ২৫

প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষায় বাদ পড়লেও অযোগ্য সেই ব্যক্তিকেই চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দিয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি)। সিডিসির জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এটিডি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগে এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। যার পেছনে আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক একজন সভাপতি। অভিযোগ উঠেছে, বড় অংকের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এই নিয়োগ হয়েছে।

যদিও নিয়োগ পাওয়া কীটতত্ত্ববিদের দাবি, সবকিছু বৈধভাবেই হয়েছে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। তবে নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এটিডি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগে ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আবেদনকারীর সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪৫ বছর হতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। যেখানে শর্তপূরণ সাপেক্ষে একজন প্রার্থী প্রাথমিক বাছাইয়ে নির্বাচিত হোন। কিন্তু নিয়ম অমান্য করে (আবেদনের সময়) আরও দুজনকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র দেওয়া হয়। এর মধ্যে একজন ৫২ বছরের রাজীব চৌধুরী, অন্যজন ৫৪ বছরের মো. খলিলুর রহমান।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, কীটতত্ত্ববিদের মাসিক বেতন হবে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, আবেদনকারীর বয়সসীমা ৪৫ বছর। এরপর পদটির জন্য ১১ জন আবেদন করেন। আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে একজনকে যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী প্রার্থীর তালিকা করে ওই বছরের ২৪ নভেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিবের (বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিশাখা) কাছে পাঠান কমিটির সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. একরামুল হক।

চিঠিতে তিনি লিখেন, দুই প্রার্থী রাজীব চৌধুরী ও খলিলুর রহমানের অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বাকি সব যোগ্যতাই ঠিক আছে, তবে তালিকায় থাকা আবেদনকারী রাজীব চৌধুরীর বয়স ৫২ বছর এবং মো. খলিলুর রহমান ৫৪ বছর বয়সি। তাদের প্রাথমিকভাবে যোগ্য হিসেবে বাছাই করা হলেও একজনের ৭ বছর এবং অপরজনের ৯ বছর বেশি হওয়ায় প্রাথমিক বাছাই কমিটিতে নির্বাচিত হওয়া একমাত্র প্রার্থীকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এর মধ্যেই অযোগ্য দুই প্রার্থীর একজনকে নিয়োগে মরিয়া হয়ে ওঠেন স্বাচিপের সাবেক একজন সভাপতি। তিনি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনা এবং মোটা অংকের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অযোগ্য সত্ত্বেও ৫৪ বছর বয়সি খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। কাজে লাগান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তাকে। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়।

পরে দ্বিতীয় দফায় বয়স শিথিল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বয়স শিথিলের কথা উল্লেখ করে একজন প্রার্থীকে নিয়োগের কথা বলা হয়। এ পর্যায়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন খলিলুর রহমান। পরে ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় তাকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের সুপারিশ করে বাছাই কমিটি। পরে ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর তাকে নিয়োগ দেয় সরকার। কারণ হিসেবে বলা হয়, খলিলুর রহমানের কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে সরকারি চাকরিতে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই পদে ১১ বছর জাতীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

তবে অনুসন্ধানে ভিন্ন তথ্য মিলেছে। সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা জানা গেছে, অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগে আপত্তি করায় বাছাই কমিটির একজন সদস্যকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি ইনস্টিটিউটে কর্মরত রয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে বাছাই কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয় আমার দেশ’র। একজন সদস্য বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তিতে সাত বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল। সে আবেদনকারীদের মধ্যে একজনকে বাছাই করা হয়। যিনি কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে ৯ বছরের অভিজ্ঞ। সবকিছুই ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বাছাই কমিটির সদস্য সচিব সিডিসির সাবেক লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দিতে হবে। যিনি কিনা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। বাছাই কমিটিতে চূড়ান্ত হওয়া কীটতত্ত্ববিদ রাকিবুজ্জামান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণেই মূলত তাকে বাদ দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘স্বাচিপের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান সরাসরি নাজমুল ইসলামকে ফোন দিয়ে বলেন, খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দিতে হবে। এজন্য সরকারের মন্ত্রীদের দিয়ে যোগাযোগ করা হয়। এমনকি মন্ত্রণালয়ের আমলাদের পকেটে বড় অংকের টাকাও দেন নিয়োগ পাওয়া কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান।’

প্রথম হয়েও নিয়োগ বঞ্চিত জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির এন্টোমোলজিক্যাল টেকনিশিয়ান মো. রাকিবুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ‘কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে আমার ৯ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যেখানে আবেদনে চাওয়া হয়েছিল ৭ বছরের। তারপরও সর্বোচ্চ বয়সসীমা নয় বছর শিথিল করে অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে একই দপ্তরে কীটতত্ত্ববিদ পদে নিয়োগের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমি আবেদন করেছিলাম। আমি জেনেছিলাম সেখানে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত তালিকায় অযোগ্য হিসেবে বাদ পড়ে যায় একজন প্রার্থী। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাদ পড়া ব্যক্তিই চূড়ান্তভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে চাকরি করছেন। আমি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়ে অনেক প্রতিবেদন দেখেছি। সেখানে একমাত্র আমিই চূড়ান্তভাবে যোগ্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে অযোগ্য সেই প্রার্থীকেই নিয়োগ দেওয়া হয়। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই ভয়াবহ অন্যায়ের অবসান হওয়া দরকার।’

তবে নিয়োগ পাওয়া খলিলুর রহমানের ভাষ্য, এই চাকরিতে যোগ দিতেই তিনি সরকারি চাকরি ছেড়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার দীর্ঘ ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা। শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেন পুরো বাংলাদেশে আমার মতো এত অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ নেই। আবেদনে অভিজ্ঞদের বয়স শিথিলের কথা বলা হয়েছে, তারপরও আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। পরে সরকারই সেটি বুঝতে পেরে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছে। যেখানে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে নিয়োগ পেয়েছি। রাজনৈতিক বিবেচনা কিংবা আর্থিক লেনদেনে নিয়োগ পাইনি।

নিয়োগ কমিটির চূড়ান্ত বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন সিডিসির পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। ৫ আগস্টের পর তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।

বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ডা. মো. ইকরামুল হক আমার দেশকে বলেন, ‘অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে যেহেতু বয়স শিথিলের কথা বলা হয়েছে, তবে যিনি প্রথম হয়েছিলেন তারও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। আমি পরীক্ষা নিয়ে সেই ফল পাঠিয়েছিলাম। এর মধ্যেই আমাকে বদলি করা হয়েছে। ফলে বাকিটা আমার দায়িত্ব ছিল না। পরে কাকে নেওয়া হয়েছে সে ব্যাপারে জানি না।’

নিয়োগের আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই হয়েছে তৎকালীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব নিলুফার নাজনীনের নেতৃত্বে। গত শনিবার নিলুফার নাজনীন আমার দেশকে বলেন, ‘প্রাথমিকে বাদ পড়া ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। যদিও অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে কেন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আমার জানা নেই।’

অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগের কারণ জানতে চাইলে প্রশ্ন শুনেই ফোন কেটে দেন নিয়োগ কমিটির সভাপতি তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ব স্বাস্থ্য উইং) কাজী জেবুন্নেছা বেগম। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত