স্বাস্থ্যখাতের বর্তমান বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা

বেতন-ভাতায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০: ৪১

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত জনবলের সিংহভাগ এখন বেসরকারি খাতে নিয়োজিত। সরকারি খাতে যেখানে মোট জনবল দেড় লক্ষাধিক। সেখানে বেসরকারি খাতে তা প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি। চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ এবং অন্যান্য সহায়তাকারী কর্মীদের সংখ্যাতেও বেসরকারি খাত এগিয়ে। তবে বেতন কাঠামোর দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-ভাতার দিক থেকে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ডাক্তার ও নার্সরা তুলনামূলকভাবে কম বেতন পাওয়ায় দেশের স্বাস্থ্যখাত ভয়াবহ মেধা পাচারের শিকার হচ্ছে। যা জনমুখী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে সিরডাপ অডিটোরিয়ামে ‘স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি জনবলের বেতন নীতি: বর্তমান বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস, বাংলাদেশ (এএইচআরবি) এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদের সঞ্চালনায় এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ. কে. আজাদ খান।

এছাড়াও সরকারের পে কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক, শ্রম স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, জন প্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. শাহিনা সোবহান মিতু, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব মহাসচিব ডা. মো. জহিরুল ইসলাম শাকিল, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন।

সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি জনবল দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান প্রক্রিয়ার অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ কাঠামোতে দীর্ঘদিন ধরে যথাযথ বেতন কাঠামো, নীতি-অসামঞ্জস্য এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নানা জটিলতা বিদ্যমান। সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন কাঠামোতে বিদ্যমান অসামঞ্জস্যতা কেবল কর্ম-প্রেরণা ও দক্ষতা নয়, সেবার গুণগত মানেও প্রভাব ফেলছে।

বক্তাদের কথায় উঠে আসে, একদিকে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি খাতে বেতন-ভাতায় প্রকট বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা কর্মজীবনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিদেশ-মুখী হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন (২০২৫) একটি যুগোপযোগী বেতন কাঠামো প্রণয়নের সুপারিশ করেছে, যেখানে ঝুঁকি ভাতা, পারফরম্যান্স-লিংকড ইনসেনটিভ এবং স্বয়ংক্রিয় বেতন সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে।

বেতন বৈষম্য, ন্যূনতম মানদণ্ডের অভাব এবং সামাজিক সুরক্ষার কারণে স্বাস্থ্য খাতে মেধাবী ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন আলোচকেরা। একই সঙ্গে বড় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে। এ কারণে বিদেশে মাইগ্রেশনের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ খাতে মেধাবীদের আসা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলেও মত দেন তারা।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্য এবং ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে কনভেনশন ১৩১ এর নির্দেশনা আংশিকভাবে মানে। তবে স্বাস্থ্যখাতের মতো পেশাগত খাতে জীবন যাত্রার মান, প্রোডাক্টিভিটি কাঠামো পুরোপুরি কার্যকর নয়। পেশাভিত্তিক জব ইভালুয়েশন, পারফর্মেন্স বেইজ পে চালু করলে আইএলও সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যখাতে বর্তমানে সমস্যা সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেতন কাঠামোর বৈষম্য। এখানে বেতন কাঠামো মূলত পদমর্যাদা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। বাস্তব জীবনযাত্রার ব্যয়, উৎপাদনশীলতা ও পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে এর সামঞ্জস্য নেই। নৈশকালীন দায়িত্বপালন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের অতিরিক্ত পারিশ্রমিক নেই। আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করেছি, বেসরকারি খাতে বেতন পেতে বিলম্ব হয়। একই কাজ হলেও বেতন বৈষম্য, ন্যূনতম মানদণ্ডের অভাবের পাশাপাশি সামাজি সুরক্ষাও নেই। এতে মেধাবী ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এসব খাতে মেধাবী এই সমস্ত খাতে মেধাবী লোকদের আসার পরিমাণ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এজন্য স্বাস্থ্য খাতের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বা পে কমিশনের দাবি জানান তিনি।

আকরাম হোসেন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত জনবলের বড় অংশই বেসরকারি খাতে। সরকারি খাতে যেখানে মোট জনবল ১ লাখ ৫১ হাজারের মতো, সেখানে বেসরকারি খাতে এই সংখ্যা ১ লাখ ৯০ হাজারের বেশি। চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ এবং অন্যান্য সহায়তাকারী কর্মীদের সংখ্যাতেও বেসরকারি খাত এগিয়ে। তবে বেতন কাঠামোর দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন-ভাতার দিক থেকে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ডাক্তার ও নার্সরা তুলনামূলকভাবে কম বেতন পাওয়ায় দেশের স্বাস্থ্যখাত ভয়াবহ মেধা পাচারের শিকার হচ্ছে। যা জনমুখী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় বাধা।’ এসব কারণে বিদেশে মাইগ্রেশনের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও মনে করেন এই চিকিৎসক গবেষক।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. এ. কে. আজাদ খান বলেন, ‘বেতন কাঠামোর পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগগুলোও তার প্রাপ্য। কিন্তু আমরা আলাপ করার সময় তা ভুলে যাই। যেমন—সে বাড়ি পেল কি-না, গাড়ি পেল কি-না, যাতায়াত সুবিধা পেল কি-না, দারোয়ান পেল কিনা—এটা আলোচনার করার বিষয়। তা না হলে তুলনা করা মুশকিল।’

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা বেতন দিয়ে যেন জীবন নির্বাহ করতে, এদিকে খেয়াল করতে হবে। তা না হলে মানুষ চলতে পারবে না। স্বাস্থ্যখাতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীও আছে। তার বেতনের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। ইমার্জেন্সিসহ বিভিন্ন পরিবেশে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করেন, তাদের ঝুঁকি ভাতা নিয়েও ভাবতে হবে।

স্বাস্থ্যখাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘একজন সিভিল সার্জনকে যে বেতন দেওয়া দরকার, তা দেওয়া হয় না। তাদের ব্যবস্থাপনা জ্ঞান রয়েছে। এই জ্ঞান থাকলে তার প্রাপ্য অনেক বেশি। এখন তাঁকে যা দেওয়া হচ্ছে, মূলত তার চেয়ে বেশি দেওয়া হয়। বেতনের মাধ্যমে না, টেবিলের নিচ দিয়ে। মিন্টো রোডের একটি বাড়ির ভাড়া কত? কয়টা গাড়ি তিনি করেছেন? ... সুতরাং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চাইলে এটা ভাবতে হবে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত