‘গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটা আজও মেলেনি’

মাহমুদা ডলি
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ২৫

স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি ফাখরুল জামাল। কপালে জোটেনি সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারী অস্ত্র কাঁধে বয়ে বেড়িয়েছেন। রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।

হালুয়াঘাট থেকে শুরু করে দুর্গম অঞ্চলে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে পর্যায়ক্রমে ছোট-বড় গেরিলা অপারেশন করতে করতেই ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন মিত্রবাহিনীকে। ১৫ ডিসেম্বর সাভার এলাকায় ঢুকে পড়ে মিত্রবাহিনী।

বিজ্ঞাপন

তিনি জানান, খোলা জিপে অস্ত্র তাক করে মিত্রবাহিনীর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু এসব বীরত্বের জন্য খেতাব তো মেলেনি, উপরন্তু গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও পাননি। গেজেটভুক্ত হতে চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন আর বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।

১৯৭১ সালে ভারতের টেটরা বশিরহাট ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ৭-৮ জন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ময়মনসিংহ এলাকা হয়ে হালুয়াঘাট সীমান্ত হয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে মিত্রবাহিনীর কয়েকটি জিপ ঢুকে পড়ে। সেখানেই প্রথম কথা হয় তাদের সঙ্গে।

উর্দু, ইংরেজি ভাষায় বলার এক্সপার্ট হিসেবে তারা বেছে নেয় ফাখরুল জামালসহ দুই যুবককে। ফাখরুল জামালরা প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যেতে চাইলে অধিনায়ক মেজর ভিএস রুহেল তাদের বলেছিলেন, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে থাকলে তাদের আর কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার হবে না। তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে ঢাকার সাভার পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য গাইড করা।

মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ফাখরুল জামালরা ৩ থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে থেকে সশস্ত্র যুদ্ধ এবং গাইড করায় দেশ রক্ষা বিভাগ কর্তৃক ইস্যুকৃত (ক্রমিক নং- ১৭০২৩ এবং ৮৫১ আর্টিলারি লাইট ব্যাটারি) মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ভিএস রুহেল স্বাক্ষরিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র পান। কিন্তু সনদপত্র দুটি শুধু স্মৃতি হিসেবে রয়েছে তার কাছে।

ফাখরুল জামাল আমার দেশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জীবনযুদ্ধে এতটা ব্যস্ত ছিলাম যে, সনদপত্রগুলো নিয়ে ভাবতে যাইনি। কিন্তু যখন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম গেজেটভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন আমার সনদপত্রগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর বহু চেষ্টার পর হারিয়ে যাওয়া সনদপত্র খুঁজে পাই ২০১৮ সালের দিকে।

তাই ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) গেজেটভুক্তির জন্য আবেদন করি। কিন্তু তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এখনো তার আবেদনের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানান তিনি।

ফাখরুল জামাল তার যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে এ ইউনিটটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লক্ষ্যভেদী ফায়ারের মাধ্যমে সাভার পর্যন্ত পৌঁছানোর ফলে তা বিজয় ত্বরান্বিত করে। সেনাপতি জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে তাদের ইউনিট ১৫ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেখা হয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। ওই দলের সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ব্রিজের ওপার অর্থাৎ ঢাকার মধ্যে তখনো যুদ্ধ চলছিল।

জেনারেল নাগরা মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীকে অনুরোধ করলেন কোনো গোলাগুলি না করতে এবং নদী পার না হওয়ার জন্য। কিন্তু সুবেহ সাদিকের সময় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করলে এ সময় পাকবাহিনীর বেশকিছু সদস্য মারা যায় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। এ সময় মুক্তিবাহিনী বাঙ্কার দখলে নেয়। সকালের খণ্ডযুদ্ধের পর সকাল ১০টায় সাদা পতাকা হাতে ব্রিজ পার হয়। এ সময় অস্ত্র নিয়ে ফাখরুল জামালের গাইডে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দেয় মিত্রবাহিনী। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টায় খবর পাওয়া যায় জেনারেল নিয়াজী আত্মসর্মপণ করবেন।

তিনি বলেন, আত্মসর্মপণের সময়ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসারিতে ছিলাম। আফসোস হচ্ছে, পরাজিত পাকবাহিনীর রেখে যাওয়া অস্ত্রগুলো পাকিস্তানিদের ব্যবহৃত গাড়িগুলোয় ভরে ভারতীয় বাহিনীকে নিয়ে যেতে দেখেছি। একটা অস্ত্রও তারা রেখে যায়নি।

ফাখরুল জামাল বলেন, ‘‘সাদা পতাকা হাতে ব্রিজ অতিক্রমের সময় যে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের অনভূতি হয়েছিল, জীবনেও সেটা ভোলার নয়। এত বছরেও যুদ্ধের একটি পদক্ষেপও ভুলে যাইনি। অথচ ৫৩ বছরেও স্বীকৃতিটা পেলাম না। আমার কিছু দরকার নেই। সরকারের কাছে একটাই দাবি, মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চাই।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত