শত অভিযোগের পরও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে বিমান

কবিতা
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫: ০৬

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে দেওয়ায় কাজের দক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। দাবি উঠেছে, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সেবায় প্রতিযোগিতা সৃষ্টি এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ জরুরি। বর্তমান মনোপলি ব্যবস্থার পরিবর্তে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে দক্ষ অপারেটর নিয়োগের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

সেবার মান নিয়ে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিয়েছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিমানের জিম্মায় তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দুই বছরের জন্য দেওয়ার নির্দেশনা এসেছে। বিষয়টি নিয়ে জোর বিতর্ক চলছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথিতযশা কোম্পানি ডিনাটা, সুইসপোর্ট, ফ্রাপোর্ট, মেনজিস এবং সেলেবির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

এয়ার এস্ট্রার সিইও ইমরান আসিফ আমার দেশকে বলেন, বর্তমানে বিদ্যমান বিমানবন্দরগুলোর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস করে। কিন্তু তাদের মান ভালো না। তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিমানে ইউনিয়ন আছে। কোনো কারণে শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে গেলে পুরো বিমানবন্দর অচল হয়ে পড়বে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিমান কী নিশ্চিত করতে পারবে, কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন কখনও কর্মবিরতিতে যাবে না? বরং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাশাপাশি অন্য অপারেটরকেও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দিলে সার্ভিস প্রতিযোগিতামূলক ও উন্নত হবে।

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিশ্বের কোথাও কোনো একটি সংস্থা এককভাবে বিমানবন্দর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে না। সেখানে শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের দেশের সব বিমানবন্দর এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করছে বিমান। সেবা দিতে গিয়ে বিমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এখন তারা শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। এটা তারা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবে, তা বলা যায় না।

শাহজালাল বিমানবন্দরের ১ ও ২ নম্বর টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার বিষয়ে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকলেও প্রতিটি এয়ারলাইনসকে ফ্লাইট অবতরণের পর এবং উড্ডয়নের আগে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে ১০ জন করে কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। যেখানে বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে, সেখানে এয়ারলাইনসগুলো কেন নিজেদের লোক নিয়োগ দেবে? এ সেবা দেওয়ার জন্য তো এয়ারলাইনসগুলো নির্ধারিত ফি পরিশোধ করছে। তা ছাড়া বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে নানা সমস্যার কথা বলা হলেও তারা এগুলো আমলে নেয় না। অনেক বিষয় দীর্ঘ সময়ের জন্য পেন্ডিং রাখে। এই রীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এয়ারলাইনসগুলো বিমানের গ্রাহক, তাদের সমস্যা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করতে হবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেন, বাংলাদেশের যাত্রী পরিবহন করে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো সন্তুষ্ট নয়। তারা জানিয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় শাহজালাল বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ বেশি। তাদের সন্তুষ্ট করতে হলে শাহাজালাল বিমানবন্দরকে অ্যাভিয়েশন হাব করতে হবে।

ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের জিএসএ রিদম গ্রুপের হেড অব বিজনেস মাসুদুজ্জামান বলেন, বিমান বাংলাদেশের জাতীয় এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠান। আমরা চাই বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করুক। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো তাদের কাজের প্রক্রিয়া দীর্ঘ। বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার আগে বিমান থেকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার অনুমতি নিতে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসকে চার মাসের বেশি সময় ঘুরতে হয়েছে। তিনি বলেন, শাহজালালের নতুন কার্গো টার্মিনাল দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। এ টার্মিনাল বিশ্বের অন্যতম বড় ও আধুনিক। কিন্তু এখন যারা শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ব্যবস্থাপনা করছে, তাদের দিয়ে উন্নত ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হবে কি না, তা পর্যালোচনা জরুরি।

এয়ারলাইনস অপারেটরস কমিটির ঢাকার চেয়ারপারসন দিলারা হোসেন বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে ৩০-৪০ বছর আগে যেসব অভিযোগ শুনেছি এখনও একই অভিযোগ আসছে। এই বিমানবন্দরে ক্রমেই বিদেশি এয়ারলাইনস বাড়ছে। কিন্তু গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সেবার মান বাড়ছে না।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া আমার দেশকে বলেন, শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনালসহ দেশের সব টার্মিনালকে উন্নত করার জন্য বেবিচক কাজ করছে। এসব টার্মিনালের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য উপদেষ্টার সঙ্গে কথা হয়েছে। এখন শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল চালু জাতির কাছে একটা স্বপ্ন। তবে এজন্য বেবিচক বসে নেই। সংশ্লিষ্ট সবাই কাজ করছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রয়াত উপদেষ্টা হাসান আরিফ আমার দেশকে বলেন, বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষমতার বিষয়টি আমরা দেখব। দুই বছর যে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব বিষয়টা এমন নয়। যদি তার সক্ষমতার ঘাটতি হয় বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশ বিমানের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হেন্ডলিংয়ের মতো সক্ষমতা আছে কি না, এটা প্রাথমিকভাবে পারসেপশনের একটি বিষয়। কারণ, বিমানের এত দিন যে সার্ভিস আমরা পেয়ে আসছি সেটা মনঃপূত না। একটি সাধারণ অভিযোগ, আমি টিকিট পাই না কিন্তু বিমানে উঠে দেখি পুরো বিমান ফাঁকা।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের বিষয়ে বিমানের সর্বশেষ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. সফিকুর রহমান বলেন, যাত্রীসেবার মান উন্নয়ন ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ৮৪ জন গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত এক বছরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১১০০ জনকে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের যাত্রীসেবার ক্রমাগত উন্নতি ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি জানান, আরও ৫৫০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আনুমানিক ১ হাজার কোটি টাকার ইকুইপমেন্ট কেনা হয়েছে।

সম্পাদনা : আব্দুর রাজ্জাক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত