দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট রাজনৈতিকভাবেও বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চল রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। একটি সিটি করপোরেশন, পাঁচটি পৌরসভা ও ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট জেলায় ছয়টি সংসদীয় আসনে মোট ভোটার ২৮ লাখ ৭০ হাজার।
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সিলেটের আসনগুলোতে নির্বাচনি মাঠ অনেক আগে থেকেই সরগরম। গণসংযোগ, মতবিনিময় সভা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ নিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে তৎপরতা চালাচ্ছেন।
মাঝখানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা এবং জামায়াতের নেতৃত্বে আটদলীয় জোট গঠন ও আসন সমঝোতার গুঞ্জনে প্রচারে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দেয়। তবে তফসিল ঘোষণার পর আবারও নির্বাচনি মাঠ চাঙা হয়ে ওঠে।
শুরু থেকেই প্রতিটি আসনে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলেন। অবশেষে ৩ নভেম্বর প্রথম দফায় ২৩৭ আসনের সঙ্গে সিলেটের ছয়টির মধ্যে টারটিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। পরে ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় সিলেট-৪ আসনে প্রার্থী ঘোষণা হলেও সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) এখনো ঝুলে আছে।
বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর এক আসনে প্রকাশ্য এবং দুই আসনে মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিও উঠেছে। এসব বিরোধ মিটিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা এখন বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে সিলেট-৫ আসনটি জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে—এমন গুঞ্জনে ক্ষোভ বাড়ছে।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী অবশ্য বহু আগেই এককভাবে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তারা বেশ জোরেশোরেই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সিলেটের ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, এবি পার্টি, বাসদসহ (মার্কসবাদী) একাধিক দল নির্বাচনে আগ্রহী। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মূল লড়াই হবে বিএনপি, জামায়াত ও দু-একটি ইসলামি সংগঠনের মধ্যে।
বিভিন্ন সূত্রের আভাস অনুযায়ী, জামায়াত নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোটের সঙ্গে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হলে পুরো চিত্র পাল্টে যেতে পারে। কারণ, জোটের জন্য ছাড় দিতে গেলে জামায়াতের জন্য দুটি আসনও ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। তবে স্থানীয় জামায়াত নেতারা আপাতত এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অনিচ্ছুক। তাদের বক্তব্য, সমঝোতার সিদ্ধান্ত হবে কেন্দ্রীয়ভাবে। অন্যদিকে জোটের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, আগামী ২০-২১ তারিখের আগে সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
সিলেট-১ (মহানগর-সদর)
মর্যাদাপূর্ণ এই আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির দিনরাত প্রচারকাজে ব্যস্ত। সভা-সেমিনার, নাগরিক সংলাপ থেকে শুরু করে তরুণ ভোটার, নারীদের সঙ্গে মতবিনিময়, পাড়া-মহল্লার প্রচারে তিনি তার আধুনিক রাজনৈতিক ভাবনা তুলে ধরছেন। মিথ রয়েছে, সিলেট-১ আসনে যে দলের প্রার্থী বিজয়ী হন, সে দলই সরকার গঠন করে।
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি প্রথমবার এই আসনে লড়লেও দলীয়ভাবে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। শহর ও শহরতলির আনাচে-কানাচে, নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রায়দিনই সমাবেশ, কর্মিসভা, জনসংযোগ করে ভোটারদের সমর্থন চাচ্ছেন তিনি। আসনটিতে এনসিপির প্রার্থী হিসেবে এহতেশাম হকের নাম ঘোষণা করা হলেও এখনো তাকে মাঠে দেখা যায়নি। এছাড়া জমিয়ত থেকে মাওলানা আব্দুল মালিক চৌধুরী, খেলাফত মজলিস থেকে মাওলানা তাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস থেকে প্রিন্সিপাল ফখরুল ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের একাংশ থেকে মুফতি ফয়জুল হক জালালাবাদী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন।
সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর)
প্রবাসী অধ্যুষিত বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই আসনে বিএনপির প্রার্থী নিখোঁজ নেতা এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনা। ইলিয়াস আলীর জনপ্রিয়তা ও আবেগ তাকে শক্ত অবস্থানে রেখেছে। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের অধ্যক্ষ আবদুল হান্নান। ভোটারদের মন জয় করতে তিনি নানা কৌশলে কাজ করছেন। এছাড়া খেলাফত মজলিসের মুনতাসির আলী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা হোসাইন আহমদ, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা মোহাম্মদ আমির উদ্দিন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ড. লুৎফুর রহমান কাসিমী ভোটারদের মাঝে নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন।
সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ)
সুরমা-কুশিয়ারা নদীবেষ্টিত এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন এমএ মালিক। দলীয়ভাবে তাকে শক্ত প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে ব্যারিস্টার এমএ সালামের অনুসারীরা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা লোকমান আহমদ। রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দক্ষিণ সুরমা ও ফেঞ্চুগঞ্জে দলটির ভিত্তি এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী। ফলে বিএনপি যদি ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে, তবে জামায়াত বিএনপিকে আটকে দিতে পারে। এছাড়া খেলাফত মজলিসের দিলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নুরুল হুদা জুনেদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা নজরুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা রেজাউল হক চৌধুরী রাজু মাঠে কাজ করছেন।
সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ)
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এবং পর্যটন এলাকা হিসেবে খ্যাত কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী। তবে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে সোচ্চার আবদুল হাকিম চৌধুরী ও হেলাল উদ্দিন আহমদসহ কয়েকজন। অবশ্য আরিফুল হক নিজের মতো করে নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে তরুণ রাজনীতিবিদ জয়নাল আবেদীন মাঠে রয়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই তিনি প্রচারে নেমে পড়েন। দলকেও সংগঠিত করেছেন। সম্প্রতি এনসিপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন প্রবাসী প্রযুক্তিবিদ রাশেল উল আলম।
সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট)
জোট জটিলতার কারণে ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এই আসনে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বেঁধেছে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে। তারা প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার দাবি তুলছেন। বিশেষ করে জেলা বিএনপির প্রথম সহসভাপতি মামুনুর রশিদ (চাকসু মামুন) প্রকাশ্যেই আসন ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী হিসেবে হাফেজ আনোয়ার হোসেন খান কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা রেজাউল করিম জালালী, খেলাফত মজলিসের মুফতি আবুল হাসান, ইসলামী আন্দোলনের রেজাউল করীম আবরারসহ অন্যান্য প্রার্থী নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন।
সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ)
প্রবাসী অধ্যুষিত গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার আসনে অন্তত ৯ জন নির্বাচনি দৌড়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী। বড় বড় শোডাউন ও গণসংযোগ করছেন তিনি। তবে ফয়সল আহমদ চৌধুরীর অনুসারীরা মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি করছেন। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন। গত রোজার আগ থেকেই তিনি মাঠে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ইফতার মাহফিল, দলীয় বৈঠক, গণসংযোগ করে আলোচনায় আসেন তিনি। এ আসনে জমিয়তের মাওলানা ফখরুল ইসলাম, খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা সাদিকুর রহমান, গণঅধিকার পরিষদ থেকে জাহিদুর রহমান প্রার্থী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন।
বিগত দিনে এ জেলায় বিএনপি শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। কিন্তু মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্ষোভে মনে হচ্ছে এবার তাদের দলগত ঐক্য নড়বড়ে।
এদিকে জামায়াত অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার তৃণমূল সংগঠনকে গুছিয়ে মাঠে নেমেছে। এছাড়া জামায়াতের আমির এ অঞ্চলের অধিবাসী। স্বাভাবিকভাবে এরও প্রভাব পড়বে। তাই বিএনপিকে জয় পেতে হলে মনোনয়নের মনোমালিন্য ও অন্তর্কোন্দল নিরসন করে একসঙ্গে মাঠে কাজ করতে হবে। এছাড়া বিএনপির জোট ও জামায়াতের আট দলের আসন বণ্টনে শেষ পর্যন্ত হিসাব-নিকাশ উলটপালট হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

