‘কালো জুলাই’ এবং বিএনপির ভোট কৌশল

আলফাজ আনাম
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৪৩
আলফাজ আনাম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পতিত আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করানো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে হাসিনা দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসন টিকিয়ে রেখেছিলেন। হাসিনা তখনই পরাজিত হয়েছিলেন, যখন দেশের মানুষ এই বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে রাজপথে নেমে এসেছিল। ফলে আওয়ামী লীগ জানে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির মধ্যে যদি বিরোধ তৈরি করা যায়, তাহলে কেবল তাদের ফিরে আসা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সেই পুরোনো মুক্তিযুদ্ধ কার্ড সামনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে দেখানো হচ্ছে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে। আওয়ামী লীগের বয়ান হচ্ছে, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রক্ষা করতে হলে হাসিনার উৎখাতে গণঅভ্যুত্থানকে দেখতে হবে বিদেশি মদতপুষ্ট একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে।

হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি দিল্লি ও কলকাতা থেকে গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ছড়ানো বয়ানের পক্ষে দেশের ভেতর থেকে সুর উঠছে। গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের মধ্যে থাকা আওয়ামী অনুরক্তদের সঙ্গে বিভিন্ন দলের মধ্যে থাকা সফ্‌ট আওয়ামীপন্থিরা একই সুরে কথা বলছেন। এর মধ্যে বিএনপির ভেতরে থাকা গুপ্ত আওয়ামী লীগাররা আর মুখোশ পরে থাকতে পারছেন না। তারা শেখ হাসিনার অডিওবার্তায় উজ্জীবিত হয়ে রক্তস্নাত লাল জুলাইয়ের আন্দোলনকে কালো শক্তির ষড়যন্ত্র হিসেবে দাবি করেছেন। অতীতে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, কিন্তু খুদকুঁড়ো ঠিকমতো না পাওয়ায় তাদের অনেকে পরে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের একজন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান। তিনি নিজেই বলেছিলেন, ওবায়দুল কাদের বা ছাত্রলীগের অন্য নেতারা সরকার ও দলে যে পদমর্যাদা পেয়েছিলেন, তা না পাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগে ফিরে যাননি।

আওয়ামী লীগ আমলে জিয়াউর রহমানকে যখন পাকিস্তানের চর বলে বিষোদ্গার করা হয়েছিল, তখন ফজলুর রহমান কিংবা এখন বিএনপির বন্ধু সাজা গণমাধ্যমে সরব থাকা আওয়ামী লীগাররা নীরব ছিলেন। তারা আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে এলেও মুজিববন্দনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। অথচ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিপূজার অবসান। মুজিবের ছবিকে সামনে রেখে হাসিনা যে নিপীড়নের রাজনীতি করেছেন, তা ৫ আগস্টে এ দেশের মানুষ গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ফজলুর রহমান একটি টেলিভিশন টকশোতে বলেছেন, ‘যারা ৫ আগস্ট ঘটাইছে, কালো শক্তি, সেই কালো শক্তির নাম হলো জামায়াতে ইসলামী। তাদের যে অগ্রগামী শক্তি তার নাম হইল ইসলামী ছাত্রশিবির। সারজিস আলমরা, যারা ওইটার অভিনয় করছে, ৫ আগস্টের অভিনেতা যারা, আমি তাদেরকে নেতা বলতে আর চাই না, তাদের আমি অভিনেতা বলব। সেই আলবদর, আল শামস, জামায়াতে ইসলামী—আমরা মনে করেছিলাম ৫৪ বছর পর পূর্বপুরুষের পরাজয়ের গ্লানি তারা ভুলে গেছে। কিন্তু না, সেই পরাজয়ের গ্লানি দ্বিগুণ আকারে তাদের মধ্যে এসেছে।’

বাস্তবতা হচ্ছে ফজলুর রহমান ৫ আগস্টের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারছেন না। তার মুজিববাদী মন হতাশ ও বিক্ষিপ্ত। ফলে জুলাই-আগস্টের রক্তস্নাত আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের কালো শক্তি বলে গালি দিচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, হাসিনার পতন ও পলায়নের পুরো কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে। হাসিনা ঠিক এভাবেই ভেবেছিলেন। তিনি পতনের আগ মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। ফজলুর রহমানের এই বক্তব্য যদি ঠিক হয়, তাহলে এই অভ্যুত্থানে বিএনপির অংশগ্রহণের দাবি মিথ্যা হয়ে যায়। বিএনপির নেতৃত্ব সম্ভবত বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে শোকজ করেছে।

ফজলুর রহমানকে বিএনপির দেওয়া শোকজ করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘জুলাই-আগস্ট ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ক্রমাগতভাবে কুরুচিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে আসছেন এবং আত্মদানকারী শহীদদের নিয়ে যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা সম্পূর্ণরূপে দলীয় আদর্শ ও গণঅভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থি। মহিমান্বিত এই গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন নিয়ে আপনার বক্তব্য জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আপনার বক্তব্য দলের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার সুপরিকল্পিত চক্রান্তের প্রয়াস বলে অনেকেই মনে করে। এমনকি আপনি জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত দিয়ে কথা বলছেন। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির সাড়ে চারশ’র অধিক নেতাকর্মীসহ ছাত্র-জনতার প্রায় দেড় হাজারের অধিক মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং ৩০ হাজারেরও অধিক মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার এ ধরনের বীরোচিত ভূমিকাকে আপনি প্রতিনিয়ত অপমান ও অমর্যাদা করছেন।’

শোকজ করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ক্রমাগতভাবে তিনি এসব কথা বলেছেন। প্রশ্ন হলো বিএনপি কেন তাকে আগে থামায়নি। কিন্তু ফজলুর রহমান দলটির যা ক্ষতি করার তা করেছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও ইসলাম প্রশ্নে বিএনপির দলীয় ও আদর্শিক অবস্থান নিয়ে সফলভাবে প্রশ্ন সৃষ্টি করতে পেরেছেন। আসলে বিএনপি আগামী নির্বাচনকে ঘিরে চতুর ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে আওয়ামী নীতি ও আদর্শের একজন লোককে দলের মুখপাত্রের ভূমিকায় নামিয়েছিলেন। বিএনপির ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা ভারতপন্থিরা হয়তো শীর্ষ নেতৃত্বকে বুঝিয়েছিলেন, ফজলুর রহমানের মতো লোকরা মুক্তিযুদ্ধের বয়ান ফেরি করলে আওয়ামী ভোটগুলো বিএনপির বাক্সে পড়বে। ফজলুর রহমান শোকজের যে জবাব দিয়েছেন, তাতে তার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই পুরোনো স্টাইলে সবকিছুর জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছেন। আওয়ামী লীগের চিরাচরিত বিদ্বেষের রাজনীতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিএনপি তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দলীয় সদস্যপদ স্থগিতসহ তিন মাসের জন্য কার্যক্রম স্থগিত করেছে। কিন্তু এসব লোক যদি আবার দলে ফিরে আসে, তাহলে বিএনপির রাজনীতিতে আরো নানা বিতর্কের জন্ম দেবেন। কারণ তাদের ডিএনএতে রয়েছে আওয়ামী রাজনীতির বীজ।

আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি এখন দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। এ দেশের মানুষ জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে হাসিনাকে তাড়িয়েছে, যাতে লাখ লাখ বিএনপির নেতাকর্মী অংশ নিয়েছেন। কয়েকশ বিএনপি নেতাকর্মী নিহত, আহত, কিংবা পঙ্গু হয়েছেন। তারা বিএনপির রাজনীতির প্রধান শক্তি। সেই বিএনপির জন্য আওয়ামীপন্থিদের ভোট কি খুব জরুরি? এই আওয়ামী ভোট টানতে গিয়ে বিএনপি হারাচ্ছে তার নিশ্চিত ভোটব্যাংক, যারা বছরের পর বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দিল্লির রাজনীতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে আসছে।

আওয়ামী লীগের অধীনে সর্বশেষ নির্বাচনে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল—বিএনপি নেতারা এ দাবি করেছেন। ২০০৪ সালের নির্বাচনে যে ৫ শতাংশের মতো মানুষ ভোট দিয়েছিলো। আর ২০১৮ সালে ভোট হয়েছিলো রাতের বেলায়। প্রশ্ন হলো হাসিনার পলায়ন ও দেড় হাজার মানুষকে হত্যার পর কি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়েছে? তাহলে আওয়ামীপন্থিদের ভোটের জন্য বিএনপি কেন মুজিবপ্রেমী ছাত্রলীগ নেতাকে আশকারা দিয়ে গেল? এই নেতা তার নির্বাচনী এলাকায় কখনোই জিততে পারেননি। স্বাভাবিকভাবে বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে এখন নানা সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মুজিব বাহিনীর সদস্য এই আওয়ামী লীগাররা কখনো জিয়াউর রহমানের রাজনীতি ধারণ করতে পারেননি। জিয়াউর রহমানের রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের অবসান ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। বিএনপি গড়ে উঠেছিল ডান-বাম, মধ্যপন্থি ও সাবেক মুসলিম লীগের নেতাদের নিয়ে। শাহ আজিজুর রহমানের মতো ব্যক্তিদের প্রধানমন্ত্রী করার জন্য তিনি কখনো বিব্রত বোধ করেননি। বেগম খালেদা জিয়া ঠিক জিয়াউর রহমানের এই নীতি অনুসরণ করেছেন। আবদুর রহমান বিশ্বাসকে তিনি রাষ্ট্রপতি করেছিলেন, যিনি দেশের এক ক্রান্তিকালে গভীর ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষা করেছিলেন। ভারতীয় সমর্থনপুষ্ট জেনারেল নাসিমের ক্যু প্রচেষ্টা জীবনের বিনিময়ে তিনি ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ বিএনপির ভেতরে থাকা তথাকথিত প্রগতিশীল বলে দাবিদার বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়ারা শেষ পর্যন্ত শুধু বিএনপির সঙ্গে নয়, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

বিএনপির আরেক নেত্রী রুমিন ফারহানা অব্যাহতভাবে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি বাংলাদেশবিরোধী ভারতীয় গণমাধ্যমে গিয়ে আওয়ামী নেতাদের ভাষায় অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে শুনানির সময় তার সমর্থকরা জাতীয় নাগরিক পার্টির এক নেতার ওপর হামলা চালিয়েছেন। টেলিভিশনে দেখা গেছে, এ সময় তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন; অথচ তাদের থামানোর চেষ্টা করেননি। নির্বাচন কমিশনের ভেতরে সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত বিষয়ে শুনানির সময় যদি রাজনৈতিক দলের নেতারা মারামারি করেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন দলের নেতাকর্মীদের সামলাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

রুমিন ফারহানা এনসিপির একজন নেতা ও জুলাই আন্দোলনের একজন প্রথম সারির সংগঠককে ডাকাতদের মতো চেহারা বলে মন্তব্য করেছেন। এরপর তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তাকে ‘ফকিন্নির বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছেন। কাউকে ডাকাতের মতো চেহারার বলে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়া স্পষ্টভাবে বর্ণবাদী প্রচারণা। ইসরাইলিরা এভাবে ফিলিস্তিনিদের চিহ্নিত করে থাকে। মানুষের মানবিক পরিচয়কে অস্বীকার করে একজন অপরাধী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়। রুমিন ফারহানার কাউকে ফকিন্নির বাচ্চা বলা একই রকম ঘৃণাজনিত মনোভাবের প্রকাশ। একজন অভিজাত রাজনীতিকের সন্তান হিসেবে হয়তো রুমিন ফারহানার মধ্যে এই প্রবণতা কাজ করছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ তো তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির লোক নয়, সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষকের সন্তান। গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার আশেপাশে আমরা এ দেশের বহু অভিজাত রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের দেখছি। তারা কীভাবে লুটেরায় পরিণত হয়েছিলেন তা অজানা নয়। তাদের অনেকের হাতে জুলাই-আগস্টের মানুষ হত্যার রক্তের দাগ লেগে আছে।

আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি এখন প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। এদিক দিয়ে বিএনপির দায়িত্ব সর্বাধিক। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উত্থান হয়েছিল সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সে সময়কার জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে তিনি ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আরেকটি অভ্যুত্থানের পর বিএনপির সামনে সুযোগ এসেছে বিভাজনের রাজনীতির পরিবর্তে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার। সে সুযোগ দলটি কতটা কাজে লাগাতে পারে, তা এখন দেখার বিষয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত