নিরাপদ খাদ্য কত দূর?

মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ৪৩

বেঁচে থাকতে হলে খেতে হবে। কিন্তু সেই খাদ্যই যদি নিরাপদ না হয় তা হলে বাঁচার উপায় কী? আদিকালে বন-জঙ্গলে মানুষ খাদ্য উৎপাদন করেনি। দলবেঁধে শিকার করে সেই খাবার আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার সময় খাদ্য ‘নিরাপদ’ কি না, তা নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না তাদের। তারা খাবার সংরক্ষণ করত না বা সংরক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না; পরিবেশ দূষণ বা দূষিত পরিবেশও ছিল না। তবে ভবিষ্যৎ খাদ্যপ্রাপ্তি বা খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে চেতনা ছিল তাদের মধ্যে।

এরই ধারাবাহিকতায় চাষাবাদের কলাকৌশল মানুষের চিন্তায় চলে আসে—সেই পাথর যুগ থেকে বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পর্যন্ত। অনেকে বলেন, জীবন-জীবিকার অতি গতিময়তা আর বিজ্ঞানের অপব্যবহারে বর্তমানে শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি, খাদ্যের চেয়ে ওষুধ বেশি, অঙ্কের চেয়ে আতঙ্ক বেশি এবং চিন্তার চেয়ে চেতনা বেশি। ভূ-রাজনীতি আর পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি।

বিজ্ঞাপন

নানারকম দিবস এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো জাতীয় বা আর্ন্তজাতিক দিবস পালিত হয় দেশে। কিন্তু কোনো দিবসই সবার মাঝে নাড়া দেওয়ার মতো জাগরণ সৃষ্টি করেনি। কিছু দিন আগে উৎপাদনকারীদের অজান্তেই হয়ে গেল জাতীয় কৃষক দিবস। আবার ভোক্তা অধিকার দিবস পালন হয়েছে, অথচ ভোক্তারা বুঝতেই পারেননি। বড় বড় সেমিনারে বক্তাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে এসব দিবস কখন শুরু হয়, আর কখন শেষ হয়, কেউ টের পায় না। খাদ্য নিরাপত্তার ভয়, উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধের প্রভাব প্রভৃতি নানা ধরনের বিষয়ে ভবিষ্যৎ হিস্যাই এখন চেতনার হট ইস্যু। তবে খাদ্য নিরাপত্তা এখন পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য কোনো ধারণা নয়। খাদ্য উৎপাদনের পরিসংখ্যানকেই কেবল খাদ্য নিরাপত্তা বোঝায় না।

বিশ্ব খাদ্য উৎপাদন, বাণিজ্যনীতি, বাণিজ্য-সম্পর্কিত নীতি, কৃষি-সম্পর্কিত আইন ও নীতি, আয়-সংক্রান্ত ধারা, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা আরো বহুপক্ষীয় ও বহুমাত্রিক ব্যাখ্যার বিষয়। পারিবারিক কৃষি সংস্কৃতি ও বিন্যাস ভেঙে পড়েছে। প্রতিদিনই কৃষি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। বাজারের মর্জিতেই ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষিজমি। খাদ্য বাণিজ্যের যমজ বা প্রতিপক্ষ নয়। খাদ্য এক বিরাজমান শ্রেণিসংস্কৃতি, যার সঙ্গে মিশে আছে জীবনযাপনের রূপ-রস-বিহঙ্গ।

তবে এগুলো হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কথাবার্তা। কিন্তু আমরা যা খাচ্ছি তা কি নিরাপদ? আর নিরাপদ যদি না হয় তাহলে খাদ্য অনিরাপদ হচ্ছে কীভাবে? মানুষই খাদ্যকে অনিরাপদ করছে। অল্প কিছু খারাপ মানুষ খাদ্যে ভেজাল ও নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে আমরা জানি মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাত নেই। তাহলে মিনিকেট চাল আসছে কোথা থেকে। ইদানীং সবাই জানতে পারলেন, এই চালের ইতিহাস এবং কলকাতা থেকে বাংলাদেশের যশোরে চাল বিতরণের মিনি প্যাকেট কাহিনি। এরপর বাংলার ব্যবসায়ীরা ফেলে দেওয়া বা নষ্ট চাল কেটে ছোট করে পুষ্টি উপাদান সব ফেলে দিয়ে চকচকে বানিয়ে বছরের পর বছর শহরের ভদ্রলোকদের খাওয়াচ্ছে।

মৎস্য ও পোলট্রি খাদ্যে ক্ষতিকর উপাদান, ফলে ফরমালিন, রঙ লাগানো, সবজিতে কীটনাশক—এসব নতুন কিছু নয়। তবে এসব নিয়ে সচেতনতার অভাব সর্বত্র। ভেজাল খাদ্য দীর্ঘদিন ধরে খাওয়ার কারণে কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি ক্যানসার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যথাযথ আইন ও এর প্রয়োগে সফলতা তেমন নেই বললেই চলে? ফলে খাদ্যে ভেজাল মেশানো অব্যাহত রয়েছে। সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত না হলে কেবল আইন প্রয়োগ কিংবা সচেতনতা তৈরি কোনো কাজে আসবে না।

নিরাপদ খাদ্য বলতে ভৌতিক, জৈবিক ও রাসায়নিক—এই তিন স্তরেই খাদ্যের গুণগত মান বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। উৎপাদন, পরিবহন ও সংরক্ষণ সব ক্ষেত্রে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থেকে খাদ্যকে মুক্ত রাখার পাশাপাশি রান্নার প্রক্রিয়ায় এবং ফ্রিজিংয়ে সঠিক তাপমাত্রার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি খাদ্য গ্রহণের সময় হাত জীবাণুমুক্ত রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটিলে খাবার নিরাপদ থাকার সুযোগ থাকে না।

বাংলাদেশের মানুষের বিজ্ঞানের জ্ঞান ও সচেতনতা কতটুকু তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর পরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় সবার হাতেই আছে ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল ফোন। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সবাইকে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবহন ও

সংরক্ষণের ক্ষেত্রে খাদ্য ও পরিবেশের বিজ্ঞানসম্মত নিয়মনীতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষক তথা উৎপাদক, পরিবহন ও সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সাধারণ মানুষকে খাদ্য, পুষ্টি ও পরিবেশ বিষয়ে কমিউনিটিভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমেই হয়তো একদিন হয়তো এ বিষয়ে পরিপূর্ণ চেতনাবোধ জাগ্রত হবে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। সর্বোপরি খাদ্য নিয়ে অন্যায্য বাণিজ্যের কারাগার থেকে খাদ্যকে মুক্ত করতে দরকার নিরাপদ খাদ্যবান্ধব রাষ্ট্রীয় নীতি ও আইন এবং এর যথাযথ প্রয়োগ।

লেখক : পুষ্টিবিদ ও মৎস্য বিশেষজ্ঞ, মোংলা, বাগেরহাট

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত