মুজিববাদ আসলে কী?

শাহীদ কামরুল
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯: ৪১

অনেকেই আজকাল জিজ্ঞাসা করেন, মুজিববাদ কাকে বলে? আসলে, মুজিববাদ নামক ধারণার আবিষ্কারক হলেন সিরাজুল আলম খান। তিনি মার্ক্সবাদ, মাওবাদ আর নানাবাদের মতোই একটা কিছু জনগণের সামনে উপস্থিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব তো ইনটেলেকচুয়াল ছিলেন না। ভাসানীর যেমন রবুবিয়াত-সংক্রান্ত তত্ত্ব আছে, শেখ মুজিব তো তেমন কোনো তত্ত্ব রেখে যাননি।

মুজিববাদ হলো এমন এক বিমূর্ত জিনিস, যা ধরা অথবা ছোঁয়া যায় না। ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালে এটা ছিল সিরাজুল আলম খান, পুরো আওয়ামী লীগ এবং তাদের মিত্রদের তৈরি করা একটি মিথ, যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতীয় ঐক্য তাদের দৃষ্টিতে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। গত সরকারের আমলে মুজিববাদ পরিণত হয়েছিল ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গোপন দর্শনে। মুজিববাদ হলো বিশুদ্ধ মতাদর্শ। মানে, এটা পুরোই একটা মিথ ও ফাঁপর। যেই ফাঁপর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আওয়ামী লীগের তালুক বানিয়ে ফেলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আদতে, মুজিববাদ হলো একটা পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ। আর মতাদর্শের কাঠামো যে পিতৃতান্ত্রিক মন বা চেতনা ও ভাষার মতোই, যা আমরা জেনেছি বিখ্যাত দার্শনিক লইস আলথুজারের কাছ থেকে। মতাদর্শের সঙ্গে ভাষা ও কর্তাসত্তার (সাবজেকটিভিটির) সম্পর্ক বোঝার জন্যও মুজিববাদ তাই বেশ ভালো একটা কেসস্টাডির বিষয় হতে পারে।

বাংলাদেশে এত সাইকোএনালাইটিকস আছে এবং এত নারীবাদী থাকা সত্ত্বেও এখনো কেন এই বিষয়ে খুব বেশি লেখালেখি বা গবেষণা হয়নি, সেই প্রশ্নটিও জরুরি। কেননা, এর মাধ্যমে আমাদের শিক্ষিত সমাজের চেতন ও অচেতন মনের ওপর মুজিববাদের প্রগাঢ় প্রভাব সম্পর্কেও আমরা ধারণা পাই।

আধুনিক সাইকোএনালিস্টরা, বিশেষ করে জাক লাকাঁর অনুসারীরা বলেন, মানুষ ভাষার জগতে প্রবেশ করে যেই পাটাতনের ওপর ভর করে, তার নামই হলো পিতা বা বাপ। পুংলিঙ্গ বা ফ্যালাস যার আরেক নাম। এই পিতা বা বাপ ঠিক জৈবিক পিতা না, যদিও জৈবিক পিতা বা কোনো ফাদার ফিগার হতে পারেন এই পাটাতন বা পুংলিঙ্গের রূপক।

এমনকি খোদ বাক্য-ভাষা তথা লোগো-ডিসকোর্সও হলো এই পিতারই অপর নাম। একই সঙ্গে বাক্য ও পুংলিঙ্গকে পিতা মেনে চেতনা বা কর্তাসত্তা গঠিত হওয়ার এই প্রক্রিয়াকেই জাক দেরিদা বলেছিলেন, ফাল্লোগোসেন্ট্রিজম তথা পুংলিঙ্গবাক্যকেন্দ্রিকতা।

মুজিববাদ হলো বাংলার জমিনে পুংলিঙ্গবাক্যকেন্দ্রিকতারই একটি নাম, যার মাধ্যমে মুজিববাদীদের কর্তাসত্তা গঠিত হয়। মানে, মুজিববাদীদের চেতনার জগতে যে বড় বাপ বা বিগ আদার বা বড় অপরের রাজত্ব কায়েম আছে, তার নামই হলো মুজিব। এই মুজিব ঠিক একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন, যদিও একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তির ইমেজেই এই বাপ-সংক্রান্ত ইমাজিনেশন গড়ে উঠেছে।

মুজিববাদ হলো বাংলাদেশের সমাজে উপস্থিত থাকা সবচেয়ে বলবান পিতৃতন্ত্র। আমাদের সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের নারী-পুরুষ-কর্তা বা সাবজেক্ট বা পুরুষ হয়েছেন মূলত এই পিতৃতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে। এরা মুজিববাদ ছাড়তে চান না, কারণ তা ছাড়লে এরা ভাষা ও চেতনার স্তরে এতিম হয়ে যাবে।

শেখ মুজিব মোটেই কোনো সুপারম্যান ছিলেন না। স্টেটসম্যান হিসেবে তিনি চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৭০ও ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে গিয়ে সিরাজুল আলমরা শেখ মুজিবের একটা মিথিক্যাল ইমেজ তৈরি করেছিল, মুজিব একপর্যায়ে নিজেই সেই মিথে বিশ্বাস করা শুরু করেছিলেন। তার ফল হয়েছে ভয়াবহ।

কিন্তু এটাও সত্যি, তার এমন কিছু স্কিল ছিল, যা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে জননেতাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। জনগণের কাছের মানুষ হয়ে ওঠা, মাইক ছাড়াই দরাজ গলায় ভাষণ দিতে পারা, সর্বোপরি জনগণের কণ্ঠ হয়ে উঠতে পারা ছিল ওই আমলে জননেতা হওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভাসানী ও মুজিবরা ছিলেন জননেতা। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদ কিংবা জিয়াউর রহমান ছিলেন স্টেটসম্যান। এই দুই ধরনের নেতাদের পার্থক্য বোঝা জরুরি।

ইতিহাসের একটি পর্বে বাংলাদেশের জনগণ শেখ মুজিবের কণ্ঠের মধ্যে নিজেদের রাজনৈতিক কণ্ঠ খুঁজে পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর), সিপিবি তখন শেখ মুজিবকে সামনে রেখে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে ঐক্য গড়ে তুলেছে। এটা ছিল তাদের রাজনৈতিক সাফল্য।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিব আরো বড় কিংবদন্তিতে পরিণত হন, কেননা তখন তিনি মাঠে উপস্থিত ছিলেন না। ফলে পুরোপুরি মিথিক্যাল একজন শেখ মুজিবকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলাটা সহজ হয়েছিল। ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে তিনি রাজিই ছিলেন না। তার চেয়ে পাকিস্তানের জেলে থাকাই শ্রেয় মেনেছেন।

মুজিব মিথের সমস্যা হলো যে, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে অবদান রাখা অনেককেই নাই করে দেয়। মওলানা ভাসানী, সিরাজুল আলম খান, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান, সিরাজ শিকদার, মণি সিংহদের মতো মানুষরা অদৃশ্য হয়ে যান। আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, হুমায়ুন কবিরদের মতো যে তরুণ সাহিত্যিকরা স্বাধীনতার পক্ষে ২৫ মার্চের আগে থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তারা তো হিসাবের মধ্যেই থাকেন না।

শেখ মুজিব মিথের নবায়ন ও আরো আপগ্রেড করার মাধ্যমেই শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র টিকেছিল। শেখ মুজিব মিথ তথা মুজিববাদই হলো সেই মতাদর্শ, যার কারণে হাসিনা ও তার অনুসারীরা বাংলাদেশকে নিজেদের বাপের তালুক মনে করেন এবং তাদের বিরোধিতাকারী সবাইকেই দেশদ্রোহী বা রাজাকার বানিয়ে দেন।

আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে একজন পবিত্র সত্তায় পরিণত করেছিল। আমি শেখ মুজিবকে অপবিত্র বা ব্যান করতে চাই না। আমি চাই মুজিবের সহজীকরণ। যেন আমরা তাকে তার ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্য অবস্থানটি দিতে পারি। মিথের বাইরে ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্বের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠা জননেতা হিসেবে চিনতে পারি।

যেন তাকে পারফর্মেটিভ রাজনীতির গুরুত্ব ও সীমা নিয়ে গবেষণার বিষয় বানাতে পারি। কীভাবে স্বৈরাচার তৈরি হয় এবং কীভাবে কারো স্বৈরাচার হওয়াটা থামানো যায়, তা নিয়ে গবেষণার জন্যও শেখ মুজিবের ইতিহাস ভালোভাবে পাঠ করা জরুরি।

৭ মার্চের ভাষণ তার শ্রেষ্ঠ সময় যখন পার করেছে, তখন ৭ মার্চ কোনো জাতীয় দিবস ছিল না। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, শেখ হাসিনার স্বৈরাচার সরকার মাত্র তিন বছর আগে যেই দিবসটিকে জাতীয় দিবস বানিয়েছে, আজকে সেই দিবসটি অক্ষুণ্ণ রাখতে অনেক আপাত আওয়ামীবিরোধী মানুষও আবেগী ও প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। মতাদর্শ কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য এই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুজিববাদের ফারাক কী? মুজিববাদ হলো মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে দাবি করা। যেমন ধরেন, ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংকুচিত করতে চাওয়া হলো মুজিববাদ। কেননা, এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান ও চেতনাকেই মেনে নেওয়া হয়।

শেখ হাসিনা সরকারের হাতে আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে গেছে। শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। মুজিবের মূর্তি নতুন করে কী ভাঙবেন? সেটা শেখ হাসিনাই তো ভেঙে ফেলেছেন। তার মতো করে মুজিবের ইমেজের ডেসেক্রেশন কজনে করেছেন? হাসিনা রেজিমের আমলে মুজিবের ডেড বডিকে বারবার নতুন করে কোরবানি দিয়েছেন কারা? হাসিনার সমর্থকরাই।

লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুজিবকে একটোপ্লাজমে পরিণত করার ইতিহাস ভুলে গেছেন? কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এই পরিণতি লাভ করেনি। কারণ মুক্তিযুদ্ধ তো আওয়ামী লীগের একা সম্পত্তি নয়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম, যাতে পুরো সমাজের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল।

২০১৩ সাল থেকে তাই বাংলাদেশের প্রাগ্রসর রাজনৈতিক সমাজ ৭২-এর সংবিধানকেন্দ্রিক চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী চেতনাকেই বাতিল করে দিয়েছেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আকাঙ্ক্ষা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে ব্যাখ্যা ও প্রতিষ্ঠা করেছেন।

হাসিনার আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আওয়ামী লীগ কখনো রক্ষা করেনি। সিপিবিও করেনি। ৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্টের পর সিপিবি বাধ্য হয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে অন্তত মুখে মুখে স্বীকার করতে। কিন্তু তারা একাত্তরের জাতীয় চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বিশ্বাসী নয়। বরং তারা এখনো আওয়ামী চেতনার ধারক ও বাহক বলেই মনে করি।

এ কারণেই ৭ মার্চের প্রতি তাদের এত আবেগ এবং সংবিধান দিবস হিসেবে ৪ নভেম্বরকেও তারা ধরে রাখতে চান। জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে ৭২-এর সংবিধানের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। শুধু তারাই এই সংবিধান প্রতিষ্ঠার দিনকে এখনো জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করতে চাইতে পারে, যারা মন থেকে এই গণঅভ্যুত্থান মেনে নিতে পারেনি। ৩৬ জুলাইয়ের পর সংবিধান দিবস হিসেবে ৪ নভেম্বর বাতিল হওয়াটাই স্বাভাবিক ঘটনা। পুরোনো ব্যবস্থাকে ভাঙার পাশাপাশি নতুন ব্যবস্থা গঠন করাও আমাদের কাজ।

মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ যে ১৭ এপ্রিলকে মুজিবনগর দিবস নাম দিয়েছে, এটাও একটি প্রতিবিপ্লব।

মুজিববাদীদের উচিত আর ফাঁপর না নিয়ে ৬৭ থেকে ৭২ পর্যন্ত কীভাবে ইতিহাসের হেজেমনিক বয়ান তৈরি করা হয়েছিল, তা সততার সঙ্গে পাঠ করা। ইতিহাসের ডিকনস্ট্রাকশন-রিকনস্ট্রাকশন করা। এই কাজের অর্থ এই নয় যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক বয়ান বাতিল করে আরেক বয়ানের হেজেমনি প্রতিষ্ঠা করব। বরং এর মাধ্যমে ইতিহাসের ওই সময়টির ঐতিহাসিক সত্য আমাদের জন্য আরো বোধগম্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত