মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব ও ‘দক্ষিণপন্থিদের উত্থান’ বিতর্ক

আবদুল লতিফ মাসুম
প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২৫, ১০: ৩২

বাংলাদেশের রাষ্ট্র এবং জনমনস্তত্ত্বের একটি অনিবার্য বিষয় ‘ভাবাদর্শের সংঘাত’ (Conflict of values)। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে দেখা হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের অবসান হিসেবে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের মূল প্রতিপাদ্য ছিল হিন্দু-মুসলমান। হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান ও মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান। এই সাধারণ বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে যে রাষ্ট্র দুটো নির্মিত হলো, ভাষায় ও ঘোষণায় পার্থক্য থাকলেও মূলত তার ভিত্তি ছিল ধর্ম। ধর্মের বন্ধনে পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হলো, তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বললেন, Double State ev Impossible State । মাত্র সিকি শতাব্দীর মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কথা ফলে গেল। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের দ্বিধাবিভক্তি ঘটল। ধর্মের বিপরীতে ভাষাকে এবং শুধু ভাষাকে জাতিরাষ্ট্রের একক নিয়ামক হিসেবে প্রদর্শন করা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই এর অকার্য এবং অসম্পূর্ণতা অনুভূত হলো। আমরা শুধুই যে বাঙালি তা নয়, ধর্ম যে আমাদের হৃদয়ের ভাষা, নৃতত্ত্বের ভাষায় আমরা যে সংকর জাতি এবং একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ যে অর্জন করেছে নতুন মানচিত্রÑসবকিছু নিয়ে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশি জাতিগোষ্ঠী যে নতুন সত্তায় আবির্ভূত হয়েছে, তা একটি অনিবার্য সত্য। আবুল মনসুর আহমদ এই নতুন রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করেছেন ‘END OF THE BETRAYAL AND THE RESTORATION OF LAHORE RESOLUTION’ হিসেবে। লাহোর প্রস্তাব ১৯৪০-এর মানে হলো ধর্ম ও ভৌগোলিক বাস্তবতার ভিত্তিতে দুটো দেশ। এ দুই দেশের মধ্যে হাজারো মাইল ব্যবধান। এই দুই দেশের মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে এক জাতি হলেও জাতীয়তাবাদের অন্যান্য উপাদানে তাদের অনেক বিভাজন এবং অনেক বিভক্তি। ১৯৭১ সালে ধর্মীয় পরিচয়কে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফসল হিসেবে মুসলিম বাংলার স্লোগান উত্থিত হয় সর্বত্র। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ জাতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পরপর তিনি বাংলাদেশ জাতির নাড়ির টান অনুভব করেন। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপিত হয়। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। জাতীয়তাবাদের সব উপাদান একত্র করে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ জাতির প্রাণশক্তি হিসেবে ঘোষিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিপরীত শক্তি ছলে-বলে-কলে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রতিবেশীর ‘প্যাকেজ ডিল’-এর মাধ্যমে তারা যখন ক্ষমতাসীন হয়, তখন তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রকে অস্বীকার করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভারতীয় ভাবধারার প্রত্যাবর্তন ঘটে। তথাকথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে অধীনতার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতীয় মূলনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জাতীয় মূল্যবোধকে বিপদগ্রস্ত করা হয়। বিগত অর্ধশতাব্দীব্যাপী ইতিহাস ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে সরকারিভাবে-বেসরকারিভাবে, রাজনৈতিকভাবে-সামাজিকভাবে, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিকভাবে এমনকি নিত্যদিনের যাপিত নাগরিক জীবনের ভাবাদর্শের সংঘাত তীব্রভাবে অনুভূত হয়। শাসন প্রক্রিয়ায় যখন বাঙালি তথা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারকরা ক্ষমতায় ছিল, প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা, এমনকি পাঠ্যবই প্রণয়নেও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নির্মূলকরণে সচেষ্ট থেকেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামি ভাবধারার প্রবহমান ইতিহাস ও দ্বন্দ্ব সচল থেকেছে এই ভৌগোলিক অঞ্চলে দীর্ঘকাল থেকে এটি অস্বীকার করে লাভ নেই। আদর্শিক দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই পৃথিবী এগিয়েছে সভ্যতার সুপ্রভাত থেকে।

বাংলাদেশের যে ভাবাদর্শের সংঘাতের কথা এতক্ষণ আলোচিত হলো, তারও ইতিহাস অনেক পুরোনো। পৃথিবীর এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব যেমন পৃথক পৃথক রাষ্ট্র ও ইতিহাস নির্মাণ করেছে, তেমনি ধর্মনির্ভর অথবা আদর্শনির্ভর সংঘাত সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ ভারতে আমাদের আলেম-ওলামারা জিহাদের পথে ছিল। পরে যখন তারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে এসেছে, তখনো তাদের আদর্শ হিসেবে ইসলাম ছিল চির বহমান। হিন্দু, শিখ ও জৈন ধর্মের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে সময়ান্তরে। পাশ্চাত্যের আধুনিকায়নের প্রভাবে ভারতীয় জনগণও প্রভাবিত হয়েছে। তাদের রাজনীতিতে ও শিক্ষায় নতুন নতুন আদর্শ ও মতবাদের প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে। এভাবে পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মতো মতবাদ বা আদর্শ ভারতীয় সমাজকে প্রভাবিত করেছে। পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র যেহেতু উপনিবেশবাদের ধারক, তা বেশ প্রচার-প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। উপনিবেশবাদের শেষদিকে যে আদর্শ বা মতবাদ পৃথিবীতে আলোড়ন তোলে, তা হচ্ছে মার্কসবাদ। ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট লিগের পক্ষ থেকে জার্মান ভাষায় মার্কস ও এঙ্গেলস কর্তৃক Communist Manifesto ঘোষিত হয়। এই আদর্শ পুঁজিবাদের, শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তির বার্তা হিসেবে প্রতিবাদী মানুষের মধ্যে ঝড় তোলে। ব্রিটিশ ভারতেও এই ঝড় অভিঘাত হানে। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। পরে মূল ভারতেও কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন করেন কমরেড মুজাফফর। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যখন

বিজ্ঞাপন

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়, তখন থেকে আরো দৃঢ়ভাবে মার্কসবাদের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে পুরো পৃথিবীতে। সংগতভাবেই ভারতের শিক্ষিত তরুণ শ্রেণি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। একসময় ভারত ও পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকলেও বিপুলসংখ্যক নতুন প্রজন্ম এর দ্বারা আকৃষ্ট হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি আগের মতো নিষিদ্ধ থাকলেও গোপনে এর কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কমিউনিস্ট বিশ্বের নানা ধরনের দ্বন্দ্ব ও বিভাজন বাংলাদেশেও নানা ধরনের ধারা-উপধারার সৃষ্টি করে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন মার্কসবাদ তথা সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় সৃষ্টি করে। বাংলাদেশেও এর প্রতিঘাত লক্ষ করা যায়। এখন এই মুহূর্তের বাংলাদেশেও নানা মতের ও নানা পথের কমিউনিস্ট ভাবধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এর দুটো ভিন্ন ভিন্ন ধারা লক্ষ করা যায়। একটি ধারা বিগত সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুবর্তী। মস্কো বা দিল্লির কোথাও কমিউনিজমের পাত্তা না থাকলেও মোটামুটিভাবে বামধারার এক বৃহৎ অংশ এখনো তাদের অনুবর্তী রয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে অনেক বিভক্তি নিয়ে তারা আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত হয়েছে। চৌদ্দ দলের অধিকাংশই এ ধারায় অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন-সত্তায় অগ্রসরমাণ আছে। অন্য একটি বামধারা শেখ হাসিনা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শক্ত ভূমিকা পালন করেছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে তাদের নিজ নিজ তাত্ত্বিক অবস্থান থাকলেও গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনায় এখনো একাত্ম তারা।

এই যে তত্ত্বকথার অবতারণা এবং ইতিহাস-ভূগোলের বয়ান, এর মূল কারণ হচ্ছে দেশের বামধারার একজন শীর্ষ বুদ্ধিজীবী, প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ড. বদরুদ্দীন উমর এর কিছু মন্তব্য। গত শুক্রবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব মন্তব্য করেন। ‘সংস্কার নয়, জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে শ্রমিক-কৃষকের গণঅভ্যুত্থানের রাজনৈতিক প্রস্তুতি নিন’ শিরোনামে এ সভার আয়োজন করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল। তার বক্তব্যে তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন ও কার্যক্রম সম্পর্কে। দ্বিতীয়ত, তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্পর্কে তার মন্তব্য। তৃতীয়ত, জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে তার মূল্যায়ন।

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে যে কেউ যেকোনো মূল্যায়ন পেশ করতে পারেন। দেশের একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে তার মূল্যায়ন সচেতন নাগরিক সাধারণের দৃষ্টিগোচর হবেÑএটাই স্বাভাবিক। তিনি একজন যথার্থ মার্কসবাদী হওয়ার কারণে সবকিছুকে মার্কসবাদী তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আমরা জানি মনীষী কার্ল মার্কস তার ‘অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ’ (Economic Determinism) এবং ‘শ্রেণি-সংগ্রাম’ (Class Struggle) দ্বারা সবকিছুকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, এই গণঅভ্যুত্থান শাসক শ্রেণির অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। এ সরকারও শাসক শ্রেণির খেদমতদার হিসেবে থাকায় এখানে এক বছরে এমন কিছু ঘটেনি, যেটাকে বলা যেতে পারে আশাবাদী হওয়ার মতো ব্যাপার। তিনি আরো বলেন, এই অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক একটি কর্মসূচির অধীনে দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে হয়নি। ছাত্রদের বক্তব্যে শ্রমিকদের কোনো কথা নেই। কৃষকের কোনো কথা নেই। তার কারণ, এ আন্দোলন তো কোনো শ্রেণি কাঠামোর বিরুদ্ধে না। যে ব্যবসায়ী শ্রেণি এ দেশ শাসন করে আসছে, ৭২ সাল থেকে তারা এখনো আছে। সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংস্কার সংস্কার করে সবাই চিৎকার করছে, সংস্কার চাইতে পারে তারা, যারা ব্যবস্থাকে স্বীকার করে নিয়েছে। যারা সংস্কার চায় তারা এ ব্যবস্থার উচ্ছেদ চায় না। বিদ্যমান যে ব্যবস্থাটি আছে, সেটি উচ্ছেদ করার আন্দোলন করতে হবে। যে শ্রেণি শাসন আছে, সেটির উচ্ছেদ চাইতে হবে। যে পরিস্থিতি রয়ে গেছে, সেটি চললে এ দেশের কোনো উন্নতি হবে না।

বিগত ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের ধরন-ধারণ ও গতিবৈশিষ্ট্য নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। যারা এই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, বিপ্লবী সরকার গঠন করতে চেয়েছেন এবং আওয়ামী সরকারের সব উপরিকাঠামোকে উৎপাটন করতে চেয়েছেন, তারা হতাশ হয়েছেন। সবাই স্বীকার করেন যে ৮ আগস্ট যখন সরকার গঠিত হয়, তখন দৃশ্যত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, রাজনৈতিক নেতারা এবং দোদুল্যমান আমলাতন্ত্র, এটিকে সাংবিধানিক নিয়মানুবর্তিতা দিতে চেয়েছেন। পুরোনো কাঠামোতে নিবদ্ধ হয়ে নতুন কিছু, বিপ্লবী কিছু করা যায় না। সুতরাং প্রফেসর বদরুদ্দীন উমরের হতাশা ন্যায়সংগত। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তর্গত দুর্বলতাও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। শীর্ষ নেতৃত্ব যেহেতু এনজিও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ছিলেন, সুতরাং কথিত এনজিওগ্রাম শব্দটি আরোপিত মনে হয় না। আরো স্পষ্ট করে বললে পুঁজিবাদী কাঠামো এবং বিশ্ব পুঁজির মালিকদের সম্পর্ক, সীমাবদ্ধতা এবং সম্পৃক্ততা অবাস্তব নয়। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, আমরা বিশ্বব্যবস্থার বাইরে যেতে পারি না।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের অভিযোগে প্রফেসর বদরুদ্দীন উমর তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী শক্তিশালী হয়েছে। এখন দক্ষিণপন্থিদের প্রভাব বেড়েছে। তাদের একটা উত্থান হয়েছে। এখন ছাত্রদের যে পার্টি হয়েছে, সে পার্টির বক্তব্যে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষ নিয়ে কোনো কথা নেই। তারা ভাবছে ধর্মকে ব্যবহার করবে। সে জন্য তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এখানে বদরুদ্দীন উমরের মূল আপত্তির জায়গা হলো ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার। ধর্ম ও রাজনীতির এই দ্বন্দ্ব সম্ভবত মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে দ্বৈধের বিষয়। লুসিয়ান ডব্লিউ পাই, এসপি হান্টিংটন, ফুকিয়ামাসহ তাবৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্বীকার করছেন, শুদ্ধ হোক বা অশুদ্ধ হোক, ন্যায় হোক কি অন্যায় হোকÑমুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জনগণ কোনো না কোনোভাবে তাদের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ইসলামি মূল্যবোধের স্বীকৃতি চায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধ্রুপদি ব্যাখ্যায় ধর্ম ও রাজনীতি ভিন্ন বিষয়। এ নিয়ে মধ্যযুগে ইউরোপে দীর্ঘমেয়াদি বিরোধ ও দ্বন্দ্ব ঘটে। ওই সময় ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে প্রাচ্যেÑচীন, আরব ও ভারতে কোনো যুদ্ধ বিগ্রহ হয়নি। উপনিবেশবাদের কারণে পাশ্চাত্যের ওই ধারণাটি আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে মেকলে প্রণীত ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা। প্রফেসর বদরুদ্দীন উমরের আরেকটি মন্তব্য দক্ষিণপন্থিদের উত্থান। দক্ষিণপন্থি বলতে কী বুঝিয়েছেন আমাদের সামনে তা পরিষ্কার নয়। সেই ফরাসি পার্লামেন্ট থেকে বামধারার উৎপত্তির কথা আমরা জানি। কিন্তু দক্ষিণপন্থিদের উদয়-অস্ত সম্পর্কে আমাদের ধারণা কম। বামধারার রাজনীতিবিদরা ডানধারাকে রক্ষণশীল, গণবিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীলÑএসব অভিধায় অভিহিত করে থাকেন। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান সম্পর্কে এ যাবৎ প্রকাশিত গবেষণা, গ্রন্থগুলো ও পণ্ডিতদের মন্তব্যে ডানধারার উত্থান হয়েছে এমন মন্তব্য শুনিনি। সবাই ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবকে আপামর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান বলেই অভিহিত করেছেন। এই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক সংগঠন এবং সিভিল সোসাইটিকে যদি কোনো তাত্ত্বিক বা আদর্শিকভাবে চিহ্নিত করতে চায়, সেটি হবে আরোপিত সত্যÑপ্রকৃত সত্য নয়। বস্তুত যদি পন্থি নির্দেশ করতেই হয়, তাহলে এ অভ্যুত্থানকে কোনো রঙ না দিয়ে মধ্যপন্থি বলাই শ্রেয়। যারা আন্দোলনের মূল কারক, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের যাচাই করলে কোনো ধর্মভিত্তিক বা মতাদর্শভিত্তিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিশ্চিতভাবেই নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনী ছিল সর্বজনীন। প্রফেসর বদরুদ্দীন উমরের মতো জাতির অভিভাবক থেকে চব্বিশ গণঅভ্যুত্থানের অবমূল্যায়ন ও অপমূল্যায়ন আশা করা যায় না। সেই পুরোনো তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যদি তত্ত্বকথার ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশকে দিকনির্দেশনা দেন, তাই পুরো জাতির জন্য বিভেদের মধ্যে ঐক্য নিশ্চিত করবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত