২০২৪ সালের জুলাই মাসের অস্থির সময়ে বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতার উত্থান ঘটে, যারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করে একটি শক্তিশালী জনপ্রিয় গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। জুলাই মাসে যারা রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম শরীফ ওসমান হাদি ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর ৩২ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরে মারা যান। জুলাই বিপ্লব তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়নি। বরং তিনি সুপরিচিত হয়ে ওঠেন ২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, যখন বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক তুরস্কে সাড়ে ৫ বছরের নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন।
সেদিন হাদি একদল কর্মীকে নিয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। মাহমুদুর রহমান, যিনি তার সাংবাদিকতার জন্য শেখ হাসিনার সরকারের নিশানা হয়েছিলেন, সেদিন কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং একটি ট্রাকের উপরে দাঁড়িয়ে আবেগঘন বক্তৃতা দেন। সেদিন হাদি এই অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করে তার সাংগঠনিক শক্তির প্রমাণ দিয়েছিলেন। তিনি যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত জনসভা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারেন, সেদিন ঢাকা প্রথমবারের মতো তার সাক্ষী হয়েছিল। পরবর্তী মাসগুলোয় জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা প্রকাশ করে আরো খ্যাতি অর্জন করেন হাদি।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
মানুষের কাছে হাদির আবেদনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একজন বাঙালি মুসলিম (বাঙালি মুসলমান) হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরা। এ বছরের শুরুতে দেওয়া এক বক্তৃতায় হাদি স্মরণ করেন, ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। সে সময় টুপি পরা একজন মুসলিম ছাত্র হিসেবে তাকে তার শিক্ষক ‘হেফাজত’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, যা হেফাজতে ইসলামের একটি অবমাননাকর সংক্ষিপ্ত রূপ। যদিও সে সময়ে এই সংগঠনের সঙ্গে তার বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। বাংলার এবং দক্ষিণ এশিয়ার উপনিবেশবিরোধী ঐতিহ্যের মধ্যে তার ভাষার মূল প্রোথিত ছিল এবং একই সঙ্গে তিনি ‘বাংলাদেশে ভারতের সাংস্কৃতিক আধিপত্য’বিরোধী শক্তির মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন । তিনি গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বোমা হামলার শিকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনেও বক্তব্য রেখেছিলেন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতারা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে দুটি প্রধান ধারা তৈরি করেছিলেন। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, মাহফুজ আলম এবং নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে একটি ধারা মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেন, অন্যদিকে হাসনাত আবদুল্লাহ এবং সারজিস আলমের সমন্বয়ে গঠিত অন্যধারাটি ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গঠন করেন। হাদি তৃতীয় একটি গ্রুপের সদস্য ছিলেন, যারা সরকারে যোগ দেয়নি এবং এনসিপিতেও যায়নি। লোকবল সরবরাহের মাধ্যমে হাসিনাবিরোধী আন্দোলনকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল—এমন একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এই গ্রুপটি নিজেদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।
জুলাই সনদ
ইতোমধ্যে হাদি তার সহযাত্রীদের সঙ্গে মিলে ইনকিলাব সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং ইনকিলাব মঞ্চ নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। হাদি বিশ্বাস করতেন, ভারতের সহায়তায় শেখ হাসিনার সরকার ১৬ বছরে বাংলাদেশে এক ধরনের ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ’ বাস্তবায়ন করেছে। বাংলাদেশের এই যুব নেতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের’ বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার নেতৃত্বাধীন গ্রুপ ইনকিলাব মঞ্চ প্রায়ই এনসিপি এবং জুলাই মঞ্চ নামে আরেকটি সংগঠনের সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে কাজ করত।
২০২৪ সালের অক্টোবরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নতুন রোডম্যাপের নীতিমালা প্রণয়ন করে জুলাই সনদের ধারণাটি উত্থাপন করেন এবং ডিসেম্বরের শেষের দিকে এটি চালু করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কারণে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। তবে হাদি এবং তার সংগঠন জুলাই জনতা রোডমার্চের মাধ্যমে জুলাই সনদের গতি বজায় রাখে। ৫ আগস্ট, ২০২৫ তারিখে শেখ হাসিনার পতনের প্রথমবার্ষিকীতে এই সনদটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই সনদে একটি গণভোট আয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিনেই হবে।
অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন
হাদি তার রাজনীতিতে ১৯৭১ সাল থেকে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশকে অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক স্পষ্টভাবে ছিন্ন করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ এবং ইনকিলাব মঞ্চ, যাদের বাংলাদেশের ‘ডিপ স্টেট’ হিসেবে বর্ণনা করে এমন বিভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। হাদির শক্তিশালী প্রচারণা আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে বাধ্য করার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছিল।
হাদির আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার প্রবল বিরোধিতা ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের হাসিনাবিরোধী সব শক্তিকে আলিঙ্গন করতে উৎসাহিত করেনি। তিনি জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপিকে বৃহত্তর পরিসরের একটি বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ছিলেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার মতো অন্যান্য ‘জুলাইযোদ্ধাদের’ স্থান দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তবে কোনো একক রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে তার অসুবিধা হয়েছিল। যদিও তিনি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, তার সাম্প্রতিক বক্তৃতাগুলো লিঙ্গ এবং অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়গুলোয় জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামপন্থি গোষ্ঠীর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশের অন্য ইসলামপন্থিদের সঙ্গে হাদির সমস্যাটি সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে ওঠে এই সত্যের মাধ্যমে যে, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হাদি এবং ইনকিলাব মঞ্চের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলেন।
সাধারণ নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের ওপর গণভোট আয়োজনের জন্য হাদি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সঙ্গে তার মতপার্থক্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে খোলাখুলি কথা বলেছিল, হাদির কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রতি তাদের অস্বস্তির কথা জানিয়েছিল, যা বাংলাদেশের দ্বিদলীয় আধিপত্যবাদী ব্যবস্থার ক্ষতি এবং পরোক্ষভাবে জামায়াতকে লাভবান করতে পারে।
১২ ডিসেম্বর গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে হাদি ঢাকা-৮ আসন থেকে আসন্ন নির্বাচনের জন্য প্রচার শুরু করেছিলেন। এই আসনের নির্বাচন তাকে ২০০১-০৬ সালের খালেদা জিয়া সরকারের সাবেক মন্ত্রী বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ করেছিল।
হাদি হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজন পলাতক ফয়সাল করিম মাসুদকে সহায়তা করার অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সঞ্জয় চিসিম এবং শিবিওন দিউ নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ মাসুদের বাবা-মাকেও গ্রেপ্তার করেছে। তবে, হাদির সহকর্মী রাফে সালমান রিফাত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বাংলাদেশের ‘ডিপ স্টেট’ জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন।
জামায়াত এবং অন্য ইসলামপন্থিরা হাদির জানাজাকে তার উত্তরাধিকার নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি, কারণ হাদি একাই হেঁটেছিলেন তার নিজ গন্তব্যে। সহযাত্রীদের সঙ্গে তার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই কারণে, তাকে কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে, যিনি ছিলেন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতীক।
দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


৩০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে গভীর রাতে ককটেল বিস্ফোরণ
নবযাত্রার এক বছর
২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ও গণঅভিপ্রায়