ড. মাহবুবুর রাজ্জাক
সারা দেশের ছাত্র প্রকৌশলীরা গত বুধবার তিন দফা দাবিতে শাহবাগে জমায়েত হয়েছিলেন। তাদের দাবি, গুলির মূল কথাটি হলো সরকারি চাকরিতে প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা বাতিল করতে হবে। প্রকৌশলী পদ এবং পদবি হবে শুধু স্নাতক প্রকৌশলীদের জন্য। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এই দাবিগুলোর সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই। দেশের প্রকৌশল খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রশাসনের উচিত ছিল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় বসা। অথচ পুলিশ তাদের ওপর অকারণে বর্বর হামলা করে রক্তাক্ত পরিবেশ তৈরি করে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
অন্যদিকে প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীরাও আন্দোলনে আছেন। তারা নিজেদের প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দিতে চায় এবং প্রকৌশলীদের জন্য উপযুক্ত পদগুলো বর্ধিত হারে প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের পদায়ন চায়। এর বাইরে তাদের কিছু কিছু দাবি স্বার্থগত দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত; পেশাগত রেষারেষির কারণেই হয়তো তারা দাবিগুলো তুলেছেন। দাবিগুলো স্নাতক প্রকৌশলীদের এবং বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে পুরো প্রকৌশল খাতের স্বার্থবিরোধী।
দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়নে প্রকৌশলী এবং প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের সমন্বিত টিমওয়ার্ক প্রয়োজন। প্রকৌশলীদের কাজ প্রকৌশলীদেরই করতে হবে। তেমনি প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের কাজও প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদেরই করতে হবে। দুই দলের কাজই একটা আরেকটার পরিপূরক। কাজেই রেষারেষি নয়, প্রয়োজন কাজের সুষম বণ্টন। উভয় পক্ষের উচিত আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যাগুলোর সমাধান করা এবং প্রকৌশল খাতের সমৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে কাজ করা।
আমাদের বুঝতে হবে ‘প্রকৌশলী’ শব্দটি কোনো বংশগত পদবি নয়। উন্নত বিশ্বে শুধু একাডেমিক সনদের বলে প্রকৌশলী পদবি ব্যবহার করা যায় না। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর পেশাগত দক্ষতার একটি স্তর অতিক্রম করে প্রফেশনাল পরীক্ষা পাস করলেই শুধু প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দেওয়া যায়। প্রকৌশলী পদবিটি তিনিই ব্যবহার করতে পারেন, যিনি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা এবং নৈতিকতার মান পূরণ করেছেন এবং নির্ধারিত সময় পরপর তার লাইসেন্স নবায়ন করেছেন। তারা প্রকৌশল কাজে স্বাক্ষর, ডিজাইন অনুমোদন এবং নিরীক্ষণ করলে ধরে নেওয়া যায় যে পেশাগত দায়িত্বশীলতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ড নিশ্চিত করেই তা করেছেন। প্রকৌশলীদের জন্য একটি কোড অব ইথিক্স অনুসরণ বাধ্যতামূলক থাকে। এতে দুর্নীতি, পক্ষপাত, গাফিলতি থেকে বিরত থাকা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার শপথ থাকে। তারা তাদের কাজের জন্য আইনগতভাবে দায়বদ্ধ থাকেন। অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে একজন প্রকৌশলী তার লাইসেন্স হারান এবং প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার অধিকারও হারান।
প্রকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করা যায় এমন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেশে এখন বেড়েছে। তাই প্রকৌশল পেশায় মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন সরকারের উচিত প্রকৌশলী এবং প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীসহ প্রকৌশল খাতে সব পেশাজীবীদের জন্য পেশাগত ট্রেনিং, রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স চালু করা। সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরির জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যত বড় ডিগ্রিই থাকুক লাইসেন্সবিহীন কাউকেই প্রকৌশলী পদবি ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। হালনাগাদ লাইসেন্স না থাকলে প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীরা কেন, কার্যত স্নাতক ডিগ্রিধারীরাও প্রকৌশল পদবি ব্যবহার করতে পারেন না।
বর্তমানে স্নাতক প্রকৌশলীদের এন্ট্রি পদ নবম গ্রেডের আর প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের এন্ট্রি পদ ১০ গ্রেডের। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে নবম গ্রেডের ৩৩ শতাংশ পদ আবার ডিপ্লোমাধারীদের প্রমোশন দিয়ে পূরণ করার রীতি চালু করা হয়। কার্যত কোথাও কোথাও এর চেয়েও অনেক বেশি পদ ডিপ্লোমাধারীদের দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রথমত নবম গ্রেডে স্নাতক প্রকৌশলীদের ঢোকার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, ডিপ্লোমাধারীরা প্রমোশনের মাধ্যমে এমন সব পদে পদায়িত হচ্ছেন, যেসব পদে স্নাতক প্রকৌশলীরাও বিসিএস ছাড়া যোগ দিতে পারেন না। এটি স্নাতক প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের বৈষম্য এবং প্রকৌশল খাতের জন্য অশনিসংকেত।
প্রশ্ন হলো—স্নাতক প্রকৌশলীদের কর্মক্ষেত্রে ডিপ্লোমাধারীরা পদায়িত হতে পারেন কি না? উত্তর হলো না। ডিপ্লোমাধারীরা প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষিত নন। তাদের কর্মক্ষেত্র আলাদা। তাই উচিত হবে তাদের চাকরি, পদায়ন ও প্রমোশনের জন্য অবিলম্বে প্রকৌশলীদের সমান্তরাল আরেকটি ধারা চালু করা। ফলে স্নাতক প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের পদ এবং কাজ সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হবে। প্রকৌশল খাতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবী দলের মধ্যে অকারণে রেষারেষি বন্ধ হবে। দুই দল নিশঙ্কচিত্তে কাজে মনোযোগ দিলে কাজের গতি ও দক্ষতাও বাড়বে।
প্রকৌশল সংস্থাগুলোয় ব্যবস্থাপনা সংকট প্রকট। প্রায় সবক্ষেত্রেই প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারা সংস্থা প্রধান হয়ে থাকেন। তারা প্রকৌশলীদের পেশাগত সমস্যার প্রতি সুবিচার করতে পারেন না। সম্প্রতি একজন উপদেষ্টা দেশের প্রকৌশলীদের সক্ষমতা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। অথচ এই প্রকৌশলীরাই বিদেশের মাটিতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন। সমস্যা প্রকৌশল শিক্ষায় নয়, সমস্যা প্রকৌশল সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনায়। প্রকৌশল সংস্থাগুলোয় কাজের গতিশীলতা আনতে চাইলে স্বতন্ত্র প্রকৌশল প্রশাসন ক্যাডার সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এতে দেশের প্রকৌশল খাতে উন্নততর নেতৃত্ব তৈরি হবে। সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের দ্বন্দ্বে মেধার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি পেশাতেই মেধার প্রয়োজন; এমনকি যিনি ফসল ফলান তারও। মেধার প্রমাণ দেখিয়েই স্নাতক এবং ডিপ্লোমা সনদগুলো অর্জন করতে হয়। তবে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা অবশ্যই আছে। কারিকুলামের সীমাবদ্ধতা, অভিজ্ঞ শিক্ষকের স্বল্পতা, গবেষণাগারের অভাব, যন্ত্রপাতির অভাব, সঠিক মূল্যায়নের অভাব ইত্যাদি। বলতে দ্বিধা নেই, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলো বেশি অবহেলার স্বীকার। এই দায় ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ডিপ্লোমাধারীরা যেন তাদের কাজে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারেন, সেভাবে তাদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের।
বলা হয়, ডিপ্লোমাধারীদের উচ্চশিক্ষার পথ সীমিত করে রাখা হয়েছে। এটি অবশ্যই অনুচিত। উচ্চমাধ্যমিক বাদ দিয়ে ডিপ্লোমা সনদের জন্য চার চারটি বছর ব্যয় করাটা কতটা যৌক্তিক তাও ভেবে দেখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দুই বছরে কারিগরি বোর্ডের আওতায় উচ্চমাধ্যমিক সনদ দিয়ে যারা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, তাদের যদি সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়। যারা তারপর পলিটেকনিকে কারিগরি ধারায় থাকবেন, তারা দুই বা তিন বছরে প্রকৌশলে ডিপ্লোমা নিয়ে হয় শ্রমবাজারে যাবেন, নয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে দুই বছরে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন।
তবে ভুলে গেলে চলবে না, সবাই প্রকৌশলী হতে চাইলে সেটিও প্রকৌশল খাতের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। তাই ডিপ্লোমাধারীদের জন্য প্রস্তাবিত ক্যাডারে সম্মানজনকভাবে পেশাগত বিকাশের সুযোগ থাকতে হবে, যাতে তারাও সন্তুষ্টচিত্তে পেশায় মনোযোগী হতে দ্বিধান্বিত না হন। পরিশেষে, প্রকৌশল খাতে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য নিয়মিত পেশাগত উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন তারা সর্বশেষ প্রযুক্তি ও নীতিমালা সম্পর্কে হালনাগাদ থাকেন এবং সর্বোচ্চ পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন।
লেখক : অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট
Email: mmrazzaque@me.buet.ac.bd
সারা দেশের ছাত্র প্রকৌশলীরা গত বুধবার তিন দফা দাবিতে শাহবাগে জমায়েত হয়েছিলেন। তাদের দাবি, গুলির মূল কথাটি হলো সরকারি চাকরিতে প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা বাতিল করতে হবে। প্রকৌশলী পদ এবং পদবি হবে শুধু স্নাতক প্রকৌশলীদের জন্য। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এই দাবিগুলোর সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই। দেশের প্রকৌশল খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রশাসনের উচিত ছিল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় বসা। অথচ পুলিশ তাদের ওপর অকারণে বর্বর হামলা করে রক্তাক্ত পরিবেশ তৈরি করে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
অন্যদিকে প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীরাও আন্দোলনে আছেন। তারা নিজেদের প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দিতে চায় এবং প্রকৌশলীদের জন্য উপযুক্ত পদগুলো বর্ধিত হারে প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের পদায়ন চায়। এর বাইরে তাদের কিছু কিছু দাবি স্বার্থগত দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত; পেশাগত রেষারেষির কারণেই হয়তো তারা দাবিগুলো তুলেছেন। দাবিগুলো স্নাতক প্রকৌশলীদের এবং বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে পুরো প্রকৌশল খাতের স্বার্থবিরোধী।
দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়নে প্রকৌশলী এবং প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের সমন্বিত টিমওয়ার্ক প্রয়োজন। প্রকৌশলীদের কাজ প্রকৌশলীদেরই করতে হবে। তেমনি প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের কাজও প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদেরই করতে হবে। দুই দলের কাজই একটা আরেকটার পরিপূরক। কাজেই রেষারেষি নয়, প্রয়োজন কাজের সুষম বণ্টন। উভয় পক্ষের উচিত আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যাগুলোর সমাধান করা এবং প্রকৌশল খাতের সমৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে কাজ করা।
আমাদের বুঝতে হবে ‘প্রকৌশলী’ শব্দটি কোনো বংশগত পদবি নয়। উন্নত বিশ্বে শুধু একাডেমিক সনদের বলে প্রকৌশলী পদবি ব্যবহার করা যায় না। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর পেশাগত দক্ষতার একটি স্তর অতিক্রম করে প্রফেশনাল পরীক্ষা পাস করলেই শুধু প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দেওয়া যায়। প্রকৌশলী পদবিটি তিনিই ব্যবহার করতে পারেন, যিনি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা এবং নৈতিকতার মান পূরণ করেছেন এবং নির্ধারিত সময় পরপর তার লাইসেন্স নবায়ন করেছেন। তারা প্রকৌশল কাজে স্বাক্ষর, ডিজাইন অনুমোদন এবং নিরীক্ষণ করলে ধরে নেওয়া যায় যে পেশাগত দায়িত্বশীলতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ড নিশ্চিত করেই তা করেছেন। প্রকৌশলীদের জন্য একটি কোড অব ইথিক্স অনুসরণ বাধ্যতামূলক থাকে। এতে দুর্নীতি, পক্ষপাত, গাফিলতি থেকে বিরত থাকা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার শপথ থাকে। তারা তাদের কাজের জন্য আইনগতভাবে দায়বদ্ধ থাকেন। অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে একজন প্রকৌশলী তার লাইসেন্স হারান এবং প্রকৌশলী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার অধিকারও হারান।
প্রকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করা যায় এমন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেশে এখন বেড়েছে। তাই প্রকৌশল পেশায় মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন সরকারের উচিত প্রকৌশলী এবং প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীসহ প্রকৌশল খাতে সব পেশাজীবীদের জন্য পেশাগত ট্রেনিং, রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স চালু করা। সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরির জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যত বড় ডিগ্রিই থাকুক লাইসেন্সবিহীন কাউকেই প্রকৌশলী পদবি ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। হালনাগাদ লাইসেন্স না থাকলে প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীরা কেন, কার্যত স্নাতক ডিগ্রিধারীরাও প্রকৌশল পদবি ব্যবহার করতে পারেন না।
বর্তমানে স্নাতক প্রকৌশলীদের এন্ট্রি পদ নবম গ্রেডের আর প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের এন্ট্রি পদ ১০ গ্রেডের। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে নবম গ্রেডের ৩৩ শতাংশ পদ আবার ডিপ্লোমাধারীদের প্রমোশন দিয়ে পূরণ করার রীতি চালু করা হয়। কার্যত কোথাও কোথাও এর চেয়েও অনেক বেশি পদ ডিপ্লোমাধারীদের দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রথমত নবম গ্রেডে স্নাতক প্রকৌশলীদের ঢোকার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, ডিপ্লোমাধারীরা প্রমোশনের মাধ্যমে এমন সব পদে পদায়িত হচ্ছেন, যেসব পদে স্নাতক প্রকৌশলীরাও বিসিএস ছাড়া যোগ দিতে পারেন না। এটি স্নাতক প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের বৈষম্য এবং প্রকৌশল খাতের জন্য অশনিসংকেত।
প্রশ্ন হলো—স্নাতক প্রকৌশলীদের কর্মক্ষেত্রে ডিপ্লোমাধারীরা পদায়িত হতে পারেন কি না? উত্তর হলো না। ডিপ্লোমাধারীরা প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষিত নন। তাদের কর্মক্ষেত্র আলাদা। তাই উচিত হবে তাদের চাকরি, পদায়ন ও প্রমোশনের জন্য অবিলম্বে প্রকৌশলীদের সমান্তরাল আরেকটি ধারা চালু করা। ফলে স্নাতক প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের পদ এবং কাজ সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হবে। প্রকৌশল খাতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবী দলের মধ্যে অকারণে রেষারেষি বন্ধ হবে। দুই দল নিশঙ্কচিত্তে কাজে মনোযোগ দিলে কাজের গতি ও দক্ষতাও বাড়বে।
প্রকৌশল সংস্থাগুলোয় ব্যবস্থাপনা সংকট প্রকট। প্রায় সবক্ষেত্রেই প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারা সংস্থা প্রধান হয়ে থাকেন। তারা প্রকৌশলীদের পেশাগত সমস্যার প্রতি সুবিচার করতে পারেন না। সম্প্রতি একজন উপদেষ্টা দেশের প্রকৌশলীদের সক্ষমতা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। অথচ এই প্রকৌশলীরাই বিদেশের মাটিতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন। সমস্যা প্রকৌশল শিক্ষায় নয়, সমস্যা প্রকৌশল সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনায়। প্রকৌশল সংস্থাগুলোয় কাজের গতিশীলতা আনতে চাইলে স্বতন্ত্র প্রকৌশল প্রশাসন ক্যাডার সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এতে দেশের প্রকৌশল খাতে উন্নততর নেতৃত্ব তৈরি হবে। সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের দ্বন্দ্বে মেধার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি পেশাতেই মেধার প্রয়োজন; এমনকি যিনি ফসল ফলান তারও। মেধার প্রমাণ দেখিয়েই স্নাতক এবং ডিপ্লোমা সনদগুলো অর্জন করতে হয়। তবে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা অবশ্যই আছে। কারিকুলামের সীমাবদ্ধতা, অভিজ্ঞ শিক্ষকের স্বল্পতা, গবেষণাগারের অভাব, যন্ত্রপাতির অভাব, সঠিক মূল্যায়নের অভাব ইত্যাদি। বলতে দ্বিধা নেই, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলো বেশি অবহেলার স্বীকার। এই দায় ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ডিপ্লোমাধারীরা যেন তাদের কাজে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারেন, সেভাবে তাদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের।
বলা হয়, ডিপ্লোমাধারীদের উচ্চশিক্ষার পথ সীমিত করে রাখা হয়েছে। এটি অবশ্যই অনুচিত। উচ্চমাধ্যমিক বাদ দিয়ে ডিপ্লোমা সনদের জন্য চার চারটি বছর ব্যয় করাটা কতটা যৌক্তিক তাও ভেবে দেখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দুই বছরে কারিগরি বোর্ডের আওতায় উচ্চমাধ্যমিক সনদ দিয়ে যারা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, তাদের যদি সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়। যারা তারপর পলিটেকনিকে কারিগরি ধারায় থাকবেন, তারা দুই বা তিন বছরে প্রকৌশলে ডিপ্লোমা নিয়ে হয় শ্রমবাজারে যাবেন, নয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে দুই বছরে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন।
তবে ভুলে গেলে চলবে না, সবাই প্রকৌশলী হতে চাইলে সেটিও প্রকৌশল খাতের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। তাই ডিপ্লোমাধারীদের জন্য প্রস্তাবিত ক্যাডারে সম্মানজনকভাবে পেশাগত বিকাশের সুযোগ থাকতে হবে, যাতে তারাও সন্তুষ্টচিত্তে পেশায় মনোযোগী হতে দ্বিধান্বিত না হন। পরিশেষে, প্রকৌশল খাতে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য নিয়মিত পেশাগত উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন তারা সর্বশেষ প্রযুক্তি ও নীতিমালা সম্পর্কে হালনাগাদ থাকেন এবং সর্বোচ্চ পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন।
লেখক : অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট
Email: mmrazzaque@me.buet.ac.bd
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১২ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে