ওদের ঈদ আসবে না

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৫, ১১: ২০

আছিয়া, মুনতাহা, সালামাহ, আল-সালোউতের। তারা সবাই শিশু। কেউ আমাদের দেশের, কেউ নির্যাতিত ফিলিস্তিনের গাজা শহরের অধিবাসী। কেউ কেউ মাত্র কয়েক দিনের বা এক মাস বয়সি নবজাতক, শিশু।

আরো অনেকে আছে ওদের সারিতে যাদের নাম আমাদের অনেকের কাছে আজও অজানা। ওরা সবাই হারিয়ে গেছে চিরতরে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার নির্মম বলি হয়ে। এই পৃথিবীতে ওদের আর কোনো ঈদ আসবে না। ঈদ আসবে না ওদের ভুক্তভোগী পরিবারগুলোয় আগের মতো করে। ওদের বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনদের হৃদয়ের শূন্যতা নিয়ে কি ঈদের খুশি ফিরে আসা সম্ভব? ওরা আজ বেহেশতের তারা, ফুল। সেখানেই তারা জ্বলজ্বল করে ফুটুক, ভেসে বেড়াক ঈদের খুশি আর আনন্দ নিয়ে!

বিজ্ঞাপন

কিছুদিন আগে মাগুরার সদর থানার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে সে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় বলে পরিবারের তরফ থেকে অভিযোগ ওঠে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার আট বছর বয়সি শিশু আছিয়া ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। গত ১৩ মার্চ ২০২৫ বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় করুণ মৃত্যু হয় নিষ্পাপ শিশুটির।

প্রায় আট দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যাওয়া মাগুরার আট বছর বয়সি শিশুটির বাড়িতে এখনো শোকের ছায়া। স্থানীয় মানুষজন একদিকে যেমন শোকার্ত, অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছেন। দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি কার্যকর করার জন্যও তারা দাবি জানিয়েছেন। অনেক মানবিক মানুষ ও বরেণ্য রাজনৈতিক নেতারাও তার পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাতে কি ওর পরিবারে ঈদের খুশি ফিরে আসবে?

গত ৩ নভেম্বর ২০২৪ বিকালে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদল গ্রামের ভাড়ারিফৌদ গ্রামের নিজ বাড়ির উঠান থেকে নিখোঁজ হয়েছিল মুনতাহা। তার প্রাইভেট টিউটর একজন নারী। তিনি কীসের লোভে পড়ে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু মুনতাহাকে হত্যা করে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা কি কারো কাছে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বোধগম্য হতে পারে?

কয়েক দিন পরই প্রথম জন্মদিন ছিল ফুটফুটে শিশু বানান আল-সালোউতের। আরেক শিশু হুর আল-সালোউতের বয়স এক বছর হয়েছে। কবে সে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা শুরু করবে, সে অপেক্ষায় ছিলেন মা-বাবা। আর ঈদ কবে আসবে, কী কেনাকাটা করবেÑ তা নিয়ে ছোট্ট সালামাহ এসলিয়েহ যেন আরো চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।

দখলদার বর্বর ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের গাজা শহরের অধিবাসী সালামাহের ঈদ আর আসবে না। হুর আল-সালোউতের প্রথম হাঁটা, আধো আধো বুলিতে কথা শোনার অপেক্ষা শেষ হবে না কোনো দিন। ইসরাইলের নির্মম হামলা মা-বাবার কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে ফিলিস্তিনের গাজার এই শিশুদের। শুধু এই তিনজন নয়, ১৭ মাস ধরে চলা ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনের উপত্যকাটিতে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ১৮ হাজার শিশু।

ইসরাইল অধিকৃত গাজায় ইসরাইলের হামলা শুরু হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরাইলের ভূখণ্ডে ঢুকে হামলা চালানোর পর শুরু হয় ইসরাইলিদের হত্যাযজ্ঞ। ‘সেদিন থেকে উপত্যকাটিতে ইসরাইলের হামলায় অন্তত পঞ্চাশ হাজার বেসামরিক মানুষ, শিশু নিহত হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।’ অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দ্য কনভারসেশনের তথ্যমতে, শিশুদের বেশিরভাগই নিহত হয়েছে ইসরাইলের সরাসরি হামলায়।

সংবাদমাধ্যম দ্য কনভারসেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলা শুরুর পর থেকে গাজায় আনুমানিক ৮৫ হাজার টন বোমা ফেলা হয়েছে। এতে সরাসরি আঘাত পেয়ে, ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে, আগুন লেগে এবং বিষাক্ত গ্যাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ‘ড্রোন হামলা ও স্নাইপারের গুলিতে শিশুদের নিহত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ২ মার্চ থেকে গাজায় ত্রাণ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয় ইসরাইল। এরপর ১৫ মার্চ এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের শিশু তহবিলÑ ইউনিসেফ জানায়, উত্তর গাজার দুই বছরের কমবয়সি শিশুদের ৩১ শতাংশ তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। সেখানে অপুষ্টির কারণে শিশুমৃত্যু ব্যাপকভাবে বেড়েছে।’

এ ছাড়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় ব্যাপক হারে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ফ্রন্টিয়ার্সের গত বছরের এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৯০ শতাংশের বেশি শিশু সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। শিশুমৃত্যুর আরেকটি বড় কারণ, শীতের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের বারবার বাস্তুচ্যুত হওয়া।

গত বছরের শেষদিকে ‘ওয়্যার চাইল্ড অ্যালায়েন্স ও গাজাভিত্তিক কমিউনিটি ট্রেনিং সেন্টার ফর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের একটি প্রতিবেদনে গাজায় ইসরাইলি আক্রমণের ফলে শিশুদের ওপর যে মারাত্মক মানসিক আঘাত নেমে এসেছে, সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সংকটাপন্ন শিশুদের পরিচর্যাকারী ৫ শতাধিক ব্যক্তির ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই পরিস্থিতিতে ৯৬ শতাংশ শিশু মনে করেছে, তাদের মৃত্যু অত্যাসন্ন।’ গাজায় শিশুদের প্রাণহানি নিয়ে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ লাজারিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বলেছিলেন, এই যুদ্ধটা শিশুদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধটা তাদের শৈশব ও ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে।

দুই বছর আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনে শিশুদের কেয়ার সেন্টারে হামলা করে শত শত নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করতে কুণ্ঠিত হননি। কারণ, নেতানিয়াহু, পুতিনের মতো যুদ্ধবাজরা মনে করেন এসব শিশুই ভবিষ্যতের যোদ্ধা। তারা বড় হলে পাল্টা আক্রমণ চালাবে তাদের নিষ্ঠুরতার কথা স্মরণ করে করে। তাই নিরীহ-নিষ্পাপ শিশুদের নিধন করা তাদের যুদ্ধের অলিখিত নীতি। এই ঘৃণ্য নীতি কোনো নরপিশাচ ছাড়া কেউই গ্রহণ করতে পারে না। অথচ সভ্য বিশ্বের দাবিদার এই কসাইদের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিধররা কখনোই মুখ খুলতে চায় না। বরং তারা প্রকাশ্যে নিরীহ মানুষ হত্যায় রসদ জোগায়। এরা মানুষরূপী নরপিশাচ, শয়তান।

তারা কোন শক্তিধর? তারা কোন শয়তানের বংশবদ? আসল শয়তান ইবলিস, বড় শয়তান। সে ঘটনাস্থলে কখনো থাকে না। আসল নরপিশাচ নিজে শয়তানি করতে মাঠে আসে না। সে শাগরেদ বা মানুষরূপী শয়তানশিষ্য মানুষকে দিয়ে শয়তানি করায়। মানবদেহে ও সমাজে ইবলিসের কার্যক্রম সর্বগ্রাসী। এসব মানুষরূপী শয়তানের কারসাজিতে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং সব সময় অপরাধ করতে প্রবৃত্ত হয়। এ জন্য মানুষের ওপর মানুষের বর্বর নির্যাতন ঘটতে থাকে বারবার।

ইবলিসের প্রলোভনে ভূলুণ্ঠিত সেসব মানবাত্মা ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। মিথ্যা, খুন, ঘুস, দুর্নীতি, চুরি-ডাকতি, পাপের ব্যবসা ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলনের কারণে আমাদের সমাজে ইবলিস অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তারা মুখে মধুর মতো কথা বলে আর কাজ করে তার উল্টো, মানবতাবিরোধীদের মতো। তারা রমজানের পবিত্রতাকেও মানতে চায় না। সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ইবলিস অনুসারীদের মুনাফেকি, ভণ্ডামি ও কুৎসা রটনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। গাজা থেকে গাজীপুরের শিশু নির্যাতন ও হত্যা কোনোটাকেই আলাদা করে দেখার অবকাশ নেই।

আছিয়া, মুনতাহা, সালামাহ এসলিয়েহ, আল-সালোউতের সবার ভেতরে রক্ত লাল, কেউ আলাদা নয়। রক্তপিপাসু নরপিশাচরা তাদের নিয়মিত নির্যাতন, হত্যা করে চলেছে। তাদের কবরের জায়গাটুকু দখল করে পৈশাচিক হাসি হাসছে। তাদের করুণ মৃত্যুর সঙ্গে তাদের পরিবারগুলোর মুখের হাসি, ঈদের খুশি এবার চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে। কোলের শিশুদের হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে তাদের সব আশা-ভরসা।

জন্ম হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই লেখকও ফিলিস্তিন নিয়ে নির্মম কাহিনি শুনতে শুনতে বিমর্ষ হয়ে উঠছে। শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন ইত্যাকার ঘটনাগুলো নিত্যদিনের মুখরোচক খবর হিসেবে পত্রিকার পাতায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সরব আলোচনার প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখে অতি অবাক হতে হচ্ছে। এসব নিয়ে রাজপথে নেমে সোচ্চার হওয়ার ঘটনাগুলো আজকাল ‘দাবির ওপর দাবি’ হিসেবে শুধু ‘চাই-দাবি’র স্তূপ তৈরি করে চলেছে। এত শত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুষ্ঠু সমাধান কোনপথে এবং কতটুকু, তার উপায় কে খুঁজে বের করবে?

চিরতরে হারিয়ে যাওয়া সব শিশুর আত্মা ‘বেহেশতের ফুল-তারা’ হিসেবে নীল আকাশে জেগে থাকুক, সেটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু ওদের পরিবারগুলোয় কি আগের মতো আনন্দের ঈদ আসবে না? ঈদের খুশি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে দুনিয়ার সব ভালো মানুষগুলোকে এই যুদ্ধটাতে শামিল হতে আশু তৎপর হওয়া উচিত।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত