বিচার ও সংস্কার হোক এই পালায়

মারুফ কামাল খান
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ৪২

বাংলাদেশে খুব সুষ্ঠুভাবে পূর্বপরিকল্পনা করে কিছু ঘটে না। মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের খেয়ালি প্রকৃতির এ দেশে চিন্তার বাইরে হুটহাট করে ঘটে যায় অনেক কিছু, অনেক বড় বড় ঘটনা ও অঘটন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাংলাদেশের সৃষ্টিকালের ঘটনাবলির দিকে তাকালেও আমরা দেখি এই অভিন্ন সত্য।

১৯৭০ সালে ফৌজি প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা ইয়াহিয়া খানের অধীনে পাকিস্তানের নির্বাচনে সেদিনের বাঙালি, আজকের বাংলাদেশিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতেছিল। এই বিজয়ে সবাই আশায় বুক বেঁধেছিল বাংলাভাষীদের নেতৃত্বে পাকিস্তানে আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান ঘটবে, প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্র ও ইনসাফভিত্তিক শাসনব্যবস্থা; কিন্তু তা হয়নি।

বিজ্ঞাপন

শাসনতন্ত্র রচনা প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বিরোধ বাঁধল। আগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিলেন, তিনি জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছেন এবং তার ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচিত হবে। পশ্চিমের জেড এ ভুট্টো তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার এই পূর্বঘোষণা তিনি মানেন না। তিনি বললেন, আমরা পরিস্কার স্লেট চাই। জাতীয় পরিষদে বসে সবাই মিলে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র তৈরি করতে হবে। সেজন্য ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার ঘোষণা বাতিল করতে হবে।

মুজিব বললেন, এটা জনতার ম্যানডেট। এই গণরায় বাতিলের ক্ষমতা কারও নেই। ভুট্টো ঘোষণা দিলেন তার দল ঢাকায় ডাকা জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেবে না। পশ্চিম থেকে অন্য দলের নির্বাচিত এমএনএ’দের কেউ যোগ দিতে গেলেও তার মাথা অথবা ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া হবে।

এই অচলাবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ডাকা জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। তিনি জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের আগেই পরিষদের বাইরে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছার আহ্বান জানান। অধিবেশন স্থগিতের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুজিব আন্দোলনের পাশাপাশি আলোচনা করতেও রাজি হন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভুট্টোসহ পশ্চিমের নেতারা ঢাকায় আসেন। আলোচনা শুরু হয়। সে আলোচনায় অচলাবস্থা নিরসনে অগ্রগতি হচ্ছে বলে আভাসও দেওয়া হয়। কিন্তু এর পুরাটাই ছিল পুবের প্রতি পশ্চিমের প্রতারণা। প্রকৃতপক্ষে সামরিক শাসকেরা ও পশ্চিমের নেতা ভুট্টো মিলে সমঝোতার মেকি আভাসের আড়ালে পুবের জনগোষ্ঠীর ওপর সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য কালক্ষেপণ করছিলেন। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে তারা বিনা ঘোষণায় চুপিসারে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। আর রাতের অন্ধকারে এই অঞ্চলের নিরস্ত্র মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় হত্যাযজ্ঞ।

সে সময় চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। অন্যান্য অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও অধিনায়কেরাও লড়াই শুরু করেন। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও আনসার সদস্যরাও বিদ্রোহ করেন। শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র স্বাধীনতার যুদ্ধ।

পূর্বপরিকল্পনা-মাফিক এ যুদ্ধ হয়নি। বাঙালি রাজনীতিকদের প্রস্তুতি চলছিল পাকিস্তানের শাসনভার হাতে নেওয়ার জন্য। তারা নয়া শাসনতন্ত্র রচনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিশ্চিত করার পরিকল্পনা আঁটছিলেন।

কিন্তু পরিস্থিতি তাদের ইচ্ছার বাইরে ঘুরে গেল। আক্রান্ত হয়ে তারা আত্মরক্ষার্থে আশ্রয় নিলেন ভারতে। দলে দলে শরণার্থীরা ছুটল সীমান্ত পেরিয়ে। নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের আক্রমণ তৃতীয় পক্ষ ভারতকে এ সংকটে পক্ষভুক্ত হওয়ার সুযোগ এনে দিল। এর ফলাফল যা দাঁড়াল তা উপমহাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল। সেই ফলাফলই আমরা আজও বয়ে চলেছি।

স্বাধীনতাযুদ্ধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে ঘিরে পক্ষ-প্রতিপক্ষের যে সমীকরণ তৈরি হয়, তাতে নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রুশ-ভারত অক্ষশক্তির বলয়ে প্রবেশ করে। সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগকে ভোল পালটে রাতারাতি সমাজতন্ত্রী সাজতে হয়। মুজিবের নামে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশেলে মুজিববাদ নামের এক রাজনৈতিক পদ্ধতির উন্মেষ ঘটানো হয়।

এই মুজিববাদের কর্মসূচি স্বাধীনতার লক্ষ্য ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতাই অক্ষম শাসক মুজিবকে বাকশাল নামের একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের দিকে ঠেলে দেয়। গণতন্ত্র হত্যা করে তিনি রাজতান্ত্রিক ধাঁচের এক স্বৈরশাসকে পরিণত হন।

বাকশালের সমাজতন্ত্রবিরোধী নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ সেনাবাহিনীতে তার অনুগত অংশকে ব্যবহার করে এক রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুজিব শাসনের অবসান ঘটান। তবে এই পরিবর্তন স্বল্পস্থায়ী ছিল। সেনাবাহিনীতে নিহত মুজিবের অনুগত একদল অফিসার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত এবং সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে।

এই ক্যুদেতায় খালেদ ক্ষমতা সংহত করতে পারেননি। সাধারণ সৈনিকেরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সেনাছাউনি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দেন। তারা জিয়াকে মুক্ত করে তার ওপর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

এরপর বাংলাদেশে ক্ষমতার যত পালাবদল ঘটেছে, তার কোনোটাই খুব একটা সুপরিকল্পিতভাবে হয়নি। পরিবর্তনের পর করণীয় কর্মসূচির ব্যাপারেও আগাম কোনো কিছু নির্ণয় বা নির্ধারণ করা হয়নি। এক্ষেত্রে কেবল স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী ‘নব্বুইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে কিছুটা ব্যাতিক্রম বলা যেতে পারে। আন্দোলনকারী তিন জোট সে সময় এরশাদ সরকারের পতনের পর করণীয় সম্পর্কে একটি রূপরেখা তৈরি করেছিল। তিন জোটের রূপরেখা নামের ওই কর্মসূচি পরে আর বাস্তবায়নের দায়িত্ব কেউ নেয়নি।

হাসিনার ফ্যাসিবাদী রেজিম বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে টানা ক্ষমতায় ছিল। তারাই সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, নৃশংসতা, দুর্নীতি-লুণ্ঠন ও দলীয়করণ করেছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই রেজিমকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দল-জোট কখনো তীব্র এবং কখনো মৃদুমন্দ আন্দোলন পরিচালনা করেছে।

কিন্তু তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের তদারকিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়। এর বাইরে তারা কিছু দলীয় ও জাতীয় এজেন্ডা নিয়েও খণ্ড খণ্ড আন্দোলন করেছে। তবে কখনও সরকার উৎখাতের আন্দোলন তারা করেনি। টানা ১৫ বছর ধরেই হাসিনা রেজিম বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় থেকেছে। আর বিরোধী দলগুলো থেকেছে রক্ষণাত্মক ভূমিকায়।

হাসিনা রেজিমের একটা বড় অপকৌশল ছিল বিরোধী দলের আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে অন্তর্ঘাত ও নাশকতা সৃষ্টি। সরকারি বাহিনী ও শাসকদলের গুণ্ডাদের ব্যবহার করে বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ ও নিরাপরাধ মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে এর দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে তাদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হতো।

শিক্ষার্থীরাও তাদের নিজস্ব দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে টিউশন ফি বাড়ানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন সফল হলেও নিরাপদ সড়ক ও রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলন পুলিশের ছত্রছায়ায় লীগের হাতুড়ি-হেলমেট-চাপাতি বাহিনী দিয়ে দমিয়ে ফেলা হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা হ্রাস ও বৈষম্য নিরসনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনও একই কায়দায় তারা দমন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে এবার তারা পুরোনো কায়দায় সফল হতে পারেনি।

দলীয় গুণ্ডা, পুলিশ, আনসার ও সীমান্ত রক্ষী দিয়ে হাসিনা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছাত্র আন্দোলন দমাতে গেলে সারা দেশের ছাত্র-তরুণদের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ তাদের সন্তানদের বাঁচাতে পথে নেমে এসেছিলেন। জনতার সম্মিলিত রুদ্র রোষে হাসিনার ওই সব ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর অস্ত্রের ভাষা অকেজো হয়ে পড়ে। তখন দেখামাত্র গুলির হুকুম দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ ও কার্ফ্যু জারি করে হাসিনা রাজপথে মোতায়েন করে সশস্ত্র বাহিনী।

দেশ রক্ষার সৈনিকেরা নিরস্ত্র দেশবাসীর বুকে গুলি চালাতে অস্বীকার করলে ফ্যাসিস্ট ঘাতক হাসিনার ক্ষমতার খেল খতম হয়ে যায়। হাসিনা গণভবন নামে দুর্গসদৃশ যে রাষ্ট্রীয় প্রাসাদবাসিনী ছিলেন, সেদিকে লাখ লাখ মানুষ ছুটে আসতে থাকে। তখন জীবন রক্ষায় ক্ষমতা ছেড়ে তাকে পালিয়ে যেতে সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য ভিক্ষা করতে হয়।

হাসিনার তো পতন হলো, কিন্তু তারপর কী? গোল বাধলো সেখানেই। ওই যে বললাম, ‘চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন একটি সীমিত লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল। এর কোনো ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। পরে ঘটনাপ্রবাহের নানা অভিঘাতে এই আন্দোলন জাতীয় রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করে।

এক দফার অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী হাসিনা রেজিম উৎখাতের আন্দোলনে পরিণত হয় এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের অংশগ্রহণে জাতীয় ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান রূপে সাফল্য ও বিজয় অর্জন করে। এই পটভূমিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয় বিজয়কে সংহত করে পরবর্তী ধাপে পৌঁছে দেওয়ার। এখন সে পরবর্তী ধাপটি কী? কেবলই জাতীয় সংসদের একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেওয়া?

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী রেজিম উৎখাতের পর যে রাজনৈতিক দলগুলোর সুষ্ঠু নির্বাচনে ভালো ফল করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের মূল লক্ষ্য এখন অবিলম্বে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। এর জন্য যেটুকু টুকটাক সংস্কার করা প্রয়োজন, তার বেশি কিছু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করুক সেটা তারা চান না। তারা বলছেন, সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। তারা এসে সংস্কার করবে। অনির্বাচিত কোনো সরকারের সংস্কার করার এখতিয়ার নেই।

আসলে রাজনৈতিক দলগুলো প্রচলিত রাষ্ট্রকাঠামো ও সিস্টেম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে। এ কারণে তারা সংবিধানে হাত দেওয়ারও বিরোধিতা করছে। বিএনপির মতো দলের নেতারাও বলছেন, সংবিধান নাকি মুক্তিযুদ্ধের ফসল এবং শহীদদের বুকের রক্তে লেখা।

এগুলো যে পুরোই বাকোয়াজ তা তারা নিজেরাও জানেন এবং জেনেও বলছেন চটজলদি একটা ভোট করে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করার উদ্দেশ্যে। তারা বিলক্ষণ জানেন, সত্যিকারের সংস্কার হলে রাজনীতি তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। তাই তারা একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছেন, সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের এক-এগারোর সরকারের মতো মাইনাস বিএনপি ফর্মুলা কার্যকর করার চক্রান্ত চলছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে বলে আমার মনে হয় না। তারা বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে মাইনাসের চেষ্টা করছে বলেও আমি মনে করি না। ইউনূস অল্প সংস্কার করে নির্বাচন সেরে ফেলতে চাইলে এ বছরেই নির্বাচনের আয়োজন করার কথা বলেছেন। আর মোটামুটি সংস্কার সেরে নির্বাচন করলে আগামী বছরের মাঝ নাগাদ ভোটের সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করেছেন।

এখন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলো ও স্টেকহোল্ডাররা একমত হলেই নির্বাচন কমিশন সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ও তফসিল ঘোষণা করতে পারে। নির্বাচন কোনো একটি পার্টির বিষয় নয় এবং এই নির্বাচনের তারিখ আগুপিছু করা নিয়ে আন্দোলনেরও প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।

ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে কোন লক্ষ্যে পরিচালিত করতে হবে, সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের মাথায় ভাবনা আসে বিজয়ের পর। হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর করণীয় নির্ধারণে সশস্ত্র বাহিনী প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে। দলগুলোর মাথায় ছিল অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদল।

তারা এমন একটি সরকার গঠনের পরামর্শ দেয়, যে সরকার কিছু রুটিন দায়িত্ব পালন করবে এবং খুব তাড়াতাড়ি তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে একটা নির্বাচন করে দিয়ে চলে যাবে। এই পরিকল্পনায় বাদ সাধে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তারা জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূস তাদের পছন্দ। আর সরকারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি থাকতে হবে। এ দাবি পূরণ করা হলেও শিক্ষার্থীদের পরবর্তী লক্ষ্যগুলোর ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো রক্ষণাত্মক মনোভাব গ্রহণ করে। এরপর উচ্চতর আদালতকে ফ্যাসিবাদের ক্রীড়নকদের কবলমুক্ত করা এবং আনসার বিদ্রোহ মোকাবিলা ছাড়া শিক্ষার্থীদের আর কোনো পদক্ষেপ সফলতার মুখ দেখেনি।

হাসিনা রেজিমের নিযুক্ত রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, সংবিধান বাতিল এবং বিপ্লবের প্রোক্লেমেশন জারির ব্যাপারে তাদের উদ্যোগ চোরাবালিতে আটকে যায়।

রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও সংবিধান বাতিল প্রশ্নে বিএনপি ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন মতের কারণে সরকারের হস্তক্ষেপে শিক্ষার্থীদের বিপ্লবের প্রোক্লেমেশনও স্থগিত রাখতে হয়েছে। এখন সবার সঙ্গে আলাপ করে সরকার এ প্রোক্লেমেশন জারির দায়িত্ব নিয়েছে।

মোটকথা, শিক্ষার্থীদের বিপ্লবের কোনো পূর্বপরিকল্পনা না থাকলেও বিপ্লবের পর পরামর্শদাতা ও থিংক ট্যাংকদের পরামর্শে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা বা রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট দিয়ে তারা বিপ্লবের যে প্রোক্লেমেশন জারির উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা খুব সফল হবে বলে আমার মনে হয় না। কোনো ঘোষণা এলেও সেটা আর সত্যিকারের বিপ্লবের প্রোক্লেমেশন হওয়ার সুযোগ নেই।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কতগুলো ভুল করায় এরই মধ্যে তারা বিপ্লবের ট্রেন মিস করেছে। প্রথমেই তারা সংবিধান মেনে এর আওতায় রাষ্ট্রপতির অধীনে সরকার গঠন ও শপথ নিয়েছে। সংবিধানে এমন সরকারের বিধান না থাকলেও উচ্চ আদালতের এক মতামত আনিয়ে তার আওতায় এই সরকার গঠনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

ফলে সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি খুবই নড়বড়ে। শিক্ষার্থীরা সরকারের অংশীদার হয়েও ভুল করেছে। সংবিধানের ছায়ায় আদালতের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সরকারে অন্তর্ভুক্ত থেকে বিপ্লব করা সম্ভব নয়। তাদের বাইরে থেকে ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল। ফ্যাসিবাদের বীজ যে সংবিধান সেটাকে আরও জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখতেই হয়তো তাদের বাধ্য হতে হবে। নতুন রিপাব্লিক গঠনও তাদের পক্ষে এ দফায় সম্ভব হবে না।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল হওয়ার কারণ রাজনৈতিক দলগুলো এতে সমর্থন দিয়েছিল, জনসাধারণ রাজপথে নেমে এসেছিল এবং সর্বোপরি সামরিক বাহিনীর সায় ছিল। এখন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভক্ত এবং বিপ্লবের প্রতিও তাদের সমর্থন নেই। সামরিক বাহিনীও এখন বিপ্লবের পতাকা বহনে প্রস্তুত বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরম্যান্স এতটা সফল নয় যে, জনগণ ঝুঁকি নিয়ে তাদের ঘোষিত বিপ্লবী কর্মসূচির পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। ফলে একা শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিপ্লব সফল করা আপাতত সম্ভব হবে না বলেই আমার ধারণা।

আমার ধারণা দিনকে দিন দেশবাসী নির্বাচনের ব্যাপারে উন্মুখ হয়ে উঠতে থাকবে। কাজেই তার আগে কিছু অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া আর তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না। এই সংস্কারগুলো এখন না করলে রাজনৈতিক সরকার এসে করবে না। ফলে যে লাউ সেই কদু হয়ে পুরোনো দিন ফিরবে, পুবরাবৃত্তি ঘটবে ইতিহাসের।

এই সংস্কারে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযোগী করে উপদেষ্টা পরিষদকে পুনর্গঠিত করা উচিত। শিক্ষার্থীরা সরকার থেকে বেরিয়ে ভ্যানগার্ডের ভূমিকায় ফিরে না গেলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কেবল কমতেই থাকবে। বর্তমান সরকারকে সংস্কারের সঙ্গে সমান্তরাল গতিতে পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে।

এই দুটি কাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার জন্য তাদের কর্তব্য রুটিন কাজে সীমাবদ্ধ করতে হবে। এসব কাজের মধ্যে থাকবে দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং যানজট যতটা সম্ভব নিরসন করা। মনে রাখতে হবে, এই দিনই শেষ নয়, সামনে আরও দিন ও সুযোগ আসবে। তখন নতুন প্রজন্মকে বিপ্লবী পরিবর্তনের সুযোগ পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। এবারকার ভুলের পুনরাবৃত্তি তখন আর করা যাবে না। ▪️

মারুফ কামাল খান: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত