জেলা প্রশাসকদের ক্ষমতা ও প্রাসঙ্গিক কথা

গোলাম মোহাম্মদ
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ৩১

প্রতিবছর সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সরাসরি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তাই আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে এবারের তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজ কার্যালয়ে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে বিগত ৫৩ বছরে বিভিন্ন সময় সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, শাসনব্যবস্থাতেও কমবেশি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র আসেনি শাসনব্যবস্থায়। বরং গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থাকে পদদলিত করে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল। বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে ফ্যাসিবাদ সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষভাবে যারা দায়ী, তার মধ্যে আছেন আমলারাও। বাংলাদেশে সাধারণত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই আমলা নামে পরিচিত। ব্রিটিশ ভারতে আমলারাই মূলত দেশ শাসন করতেন। এরপর পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও আমলাতন্ত্রের বিধিবিধানের বেড়াজাল থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। বরং বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারের দুর্বল মুহূর্তগুলো কাজে লাগিয়ে আমলাতন্ত্রকে আরো পাকাপোক্ত করা হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনামলে প্রবর্তিত আমলাতান্ত্রিক জটিল বিধিবিধানের কারণে সরকার স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারে না। এই বিধিবিধানগুলো সহজ, জনকল্যাণমুখী এবং আধুনিকায়ন করার জন্য রয়েছে সংসদ। কিন্তু সংসদ এই দায়িত্ব পালনে সফল হয়নি। বরং আমলানির্ভরতা কাজ করেছে। আমলাদের কাজ ছিল গণতন্ত্রকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা করা। কিন্তু আমলারা তা না করে সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে সরকার ও গণতন্ত্রকে দুর্বল করার মাধ্যমে জনগণকে প্রকৃত সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে।

দেশের তিনটি অঙ্গÑনির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ। ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে বাংলাদেশেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিচার বিভাগের একটি অংশ নির্বাহী বিভাগের অধীন ছিল, অর্থাৎ আমলাদের হাতে। দেশ, জাতি ও বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা হয়েছে, তবু কিছু ত্রুটি রয়েছে। নির্বাহী বিভাগ পরিচালনার জন্য মন্ত্রী, আমলা, সাচিবিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়োজিত রয়েছেন। কাজের সুবিধার্থে নির্বাহী বিভাগকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, অনুবিভাগ ইত্যাদিতে বিভাজন করে ঢেলে সাজানো আছে।

বর্তমানে সরকারের প্রত্যেক বিভাগ এবং অধিদপ্তরে উপজেলা থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের দক্ষ জনশক্তি নিয়োজিত আছে। দেশের মূল ক্ষমতাগুলো যদি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং পরিদপ্তর হয়ে উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের ওপর অর্পণ করা হতো, তাহলে কাজের গতির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরো বৃদ্ধি পেত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে ইউএনও এবং ডিসির তুলনায় সরকারের অন্যান্য দপ্তর বা বিভাগের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা, মর্যাদা আর কাজের পরিবেশ একেবারেই সীমিত। বাস্তবে দেখা যায়, ডিসি প্রায় ৮০টি কমিটির সভাপতি। এ ছাড়া আরো ছোটখাটো ১০-১২টি বিষয়ে দায়িত্ব দেখভাল করেন। তদ্রূপ ইউএনওর ওপরও অনুরূপ দায়িত্ব দেওয়া আছে। জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন দপ্তরের বিসিএস কর্মকর্তারা কোনো অবস্থাতেই মেধা, প্রজ্ঞা, মনমানসিকতায় ডিসি/ইউএনওর তুলনায় কম নয় বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিক প্রজ্ঞার অধিকারী। যেমনÑস্বাস্থ্য, কৃষি, প্রকৌশল, পুলিশ, শিক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা।

একজন কর্মকর্তা যদি ৮০টি কমিটির সভাপতি হন, তাহলে প্রশাসনিক কাজের গতি বাড়বে না বরং কমবে। আর যার দপ্তরের কাজ তিনি যদি কমিটির সভাপতি হতেন, তাহলে সেই কাজটি আরো গতিশীল হতো। একজন মানুষকে কেন এতগুলো কমিটির সভাপতি হতে হবে? পত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, ডিসি সাহেবরা আরো ক্ষমতা চান। ডিসির আরো ক্ষমতা না দেওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে বলে তাদের দাবি। প্রশ্ন হলো, ডিসি সাহেবরা যখন বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তখন কি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেনি? বরং অনেক সরকারের আমলে এর চেয়েও বেশি অবনতি ঘটেছিল। এসব বাড়তি ক্ষমতা যদি ডিসিদের দেওয়া হয়, তাহলে অন্যান্য অধিদপ্তরে কাজকর্মের গতিশীলতা হারাবে, তাদের মানসিক এবং সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে, ফলে আত্মতৃপ্তি নিয়ে কাজ করার সুযোগ কমে যাবে। বিষয়টি সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।

প্রতিবছর ডিসি সম্মেলন করা হয় এবং তাদের পক্ষ থেকে সরকার একটি লেখচিত্র পেয়ে থাকেন। আমরা মনে করি, অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়েও এরূপ সম্মেলন করা উচিত। সেখানে দেখা যাবে, উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ডিসিদের নজরদারি যে একটি বাধা, তা প্রকাশ পাবে। সরকার কাজের ওপর ভিত্তি করে ২৫টির বেশি ক্যাডার সৃষ্টি করেছে। আলাদা মন্ত্রণালয়ও আছে। সর্বস্তরে ডিগ্রিধারী বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী জনবল আছে। প্রতিটি পেশার লোকবল দিয়ে মন্ত্রণালয়গুলো ঢেলে সাজানো হলে সার্বিক উন্নয়ন আশা করা যায়। জেলাপর্যায়ে ডিসিদের আরো ক্ষমতা দেওয়া হলে অন্যান্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়বে, ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে, বরং ডিসিদের হাতে যেসব অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া আছে, সেগুলো অন্যান্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হাতে অর্পণ করা উচিত।

পরিশেষে বলতে চাই, যার যেটা কাজ তাকে দিয়ে সেটা করানোই যুক্তিসংগত। উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত একই ক্যাডারের লোকবল দ্বারা পূরণ করা উচিত। এমনকি মন্ত্রীও একই ক্যাডার থেকে হতে পারেন। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সহজ হবে। ফলে বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ জনবল দ্বারা দেশের সেবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছানো যাবে। ব্রিটিশ প্রবর্তিত যে আমলাতন্ত্র বর্তমানে দেশে চালু আছে, এর দ্বারা আবহমানকাল চেষ্টা করেও দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, গাজীপুর

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত