আলফাজ আনাম
দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন হয়েছে জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এমন অভূতপূর্ব ঐক্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। মাত্র পাঁচ মাস আগের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমরা দেখছি রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় পরিচয়, পেশাগত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পরিচয় ভুলে সবাই রাজপথে নেমে এসেছিলেন। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে এতসংখ্যক নারীর উপস্থিতিও আগে কখনো দেখা যায়নি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাদরাসাছাত্রদের একসঙ্গে মিছিলে অংশ নিতে। শাড়ি কিংবা স্কার্টপরা নারীদের সঙ্গে হিজাব-বোরকা পরা নারীদের মিছিলে অংশ নিতে দেখা গেছে।
এ জাতীয় ঐক্য তৈরির এক মাসের কম সময়ের মধ্যে প্রাণ দিতে হয়েছে ১৫০০ মানুষকে। অন্ধ কিংবা পঙ্গু হয়েছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। এই ঐক্য ফ্যাসিস্ট ও তার প্রধান দোসরদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ১৮ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো পুরোটাই রয়ে গেছে। হাসিনার পতন ও পলায়নের পর রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটকেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিযোগিতার ফলে পাঁচ মাসের মাথায় আবার বিভক্তি ও বিভাজনের রাজনীতি ফিরে আসার আলামত দেখা যাচ্ছে।
গত দেড় দশকে ফ্যাসিস্ট শাসন টিকে ছিল জাতিকে বিভক্ত করার এক ন্যারেটিভ বা বয়ান থেকে। এটি ছিল চেতনার নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ করে জাতিকে বিভক্ত করা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ইসলামোফোবিয়া, যার লক্ষ্য ছিল ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে লিপ্ত থাকা পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আদায়। এতে ফ্যাসিবাদী শাসকরা বেশ ভালোভাবেই সফল হয়েছিল।
জাতিকে বিভক্ত করার এই রাজনীতির চূড়ান্ত রূপ ছিল ২০১৩ সালের শাহবাগের জমায়েত। যেখান থেকে তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি দমনের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও বিচার বিভাগকে ব্যবহারের ভিত্তি তৈরি করা হয়।
ফ্যাসিস্ট শাসনের যে উৎপীড়ন, তার পক্ষে একধরনের গণসম্মতি আদায় করার চেষ্টা হয়েছিল শাহবাগ থেকে। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ছাড়া আর কারো রাষ্ট্রপরিচালনার কোনো অধিকার নেই, এ ধারণা প্রতিষ্ঠাই ছিল শাহবাগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। যদিও এই আন্দোলনের স্লোগান ছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। ন্যায়বিচারের কথা সেখানে কখনো উচ্চারিত হয়নি। কারণ তারা আইনের শাসনের পরিবর্তে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর শাসন কায়েম করতে চেয়েছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শাহবাগ আন্দোলন ছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচন হতো না। আর ২০১৪ সালের নির্বাচন না হলে ২০১৮ সালের নিশিরাতের নির্বাচন হতো না। এরই ধারাবাহিকতায় হয়েছিল ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন। শাহবাগের উত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শাসনের হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। এটি শুরু হয়েছিল মাওলানা সাঈদীর রায় ঘোষণার পর।
২০১৩ সালের মার্চে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর সারা দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ১৪৬ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। এর তিন মাসের মধ্যে মে মাসে শাপলা চত্বরে চালানো হয় আরেক গণহত্যা। যেখানে অন্তত শতাধিক আলেম ও মাদরাসাছাত্রকে হত্যা করা হয়।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান দমনের নামে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, তার শুরু হয়েছিল ২০১৩ সাল থেকে। এর মধ্যে শত শত বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। চোখ তুলে নেওয়া হয়েছে। পায়ে গুলি চালিয়ে পঙ্গু করা হয়েছে। এ রকম বহু নিহত, আহত বা গুম হওয়া ব্যক্তির খবর হয়তো এখন আর আলোচনায় নেই।
দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও তাদের লেজুড় বামপন্থি-ভারতপন্থি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া আর সবাই ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। যারা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এমনকি তাদের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আমরা তখন দেখেছি জামায়াত-শিবির পরিচয়ে বহু সাধারণ মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। সমাজে এমন একটি আবহ তৈরি করা হয়েছিল জামায়াত-শিবির পরিচয়ে যেকোনো ব্যক্তিকে হত্যা বা নির্যাতন করার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। এই আবহ শুধু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তৈরি করেছেন, তা নয়।
এর সঙ্গে জড়িত ছিল দেশের শিক্ষিত সমাজ এবং গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ব্যবসায়ী, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও বুদ্ধিজীবীরা। মানুষকে শুধু হত্যা বা পঙ্গু করার পক্ষে জনমত তৈরি করা হয়নি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে হরণ করা হয়েছে। সংবাদপত্র বন্ধ করার পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে। বিরোধী মতের সম্পাদককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। সত্য প্রকাশের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সম্পাদককে বিচারক বলছেন ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স। কী বিস্ময়কর বিচারব্যবস্থা! কিন্তু এ দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা তখন নীরব ছিলেন।
ফ্যাসিবাদ কায়েমের একটি সাংস্কৃতিক রূপ আছে। শাহবাগের নির্মমতার পেছনে এ দেশের বামপন্থি সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলোর ছিল প্রধান ভূমিকা। শাহবাগের ফ্যাসিবাদী বয়ান তৈরিতে শুরুতে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের সরব উপস্থিতি ছিল না। সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মতো খুচরা দলগুলো শাহবাগের ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নিয়েছে। ফলে
গত দেড় দশকের নিপীড়ন চালানোর দায় বাম সংগঠনগুলো এড়াতে পারে না। এ ছাড়া ইনু, মেনন ও দিলীপ বড়ুয়া তো নিপীড়ক সরকারের অংশীদার ছিলেন। সিপিবি সব সময় আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল সিপিবির বড় ধরনের ভূমিকা। ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টির যে ভূমিকা সিপিবির ভূমিকা কোনো অংশে তার চেয়ে কম নয়।
দেশের গণমাধ্যমগুলোও ফ্যাসিবাদী বয়ান প্রতিষ্ঠায় সে সময় বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। আমরা ভুলে যাইনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে পুলিশের আক্রমণে আহত-নিহত হওয়ার পর উল্টো বিরোধী দলগুলো তাণ্ডব চালিয়েছে বলে খবর প্রকাশ করা হতো। আমরা দেখেছি শাপলা চত্বরে মানুষ হত্যার পর গাছ কেটে বা কোরআন পুড়িয়ে কীভাবে অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
যদিও সবাই এখন কালিমালিপ্ত অতীত আর সামনে আনতে চাইছেন না। হাতের রক্ত মুছে ফেলে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সহযোগী হিসেবে অভিনয় করছেন। অথচ এই গণঅভ্যুত্থানে শিশু, ছাত্র ও শ্রমিকদের সঙ্গে অন্তত ৭৭ জন আলেম ও মাদরাসাছাত্র নিহত হয়েছে। যাদের আত্মত্যাগের কথা সুকৌশলে আলোচনার বাইরে রাখা হচ্ছে।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দিশাহীন আওয়ামী লীগ পাঁচ মাসের মাথায় আবার দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন যখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, তখন পরাজিত আওয়ামী লীগ বিভাজনের রাজনীতির সুযোগ নেবে, এটাই স্বাভাবিক। সিলেটে সম্প্রতি আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের বিজয় এর বড় প্রমাণ। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইউনিয়নের নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি পেশাজীবীরা বিজয়ী হয়েছেন।
আবার নানা ধরনের লবিংয়ের কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদল আওয়ামী লীগের দুজন নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। হাসিনার শাসনামলে ইউএনডিপির মতো প্রতিষ্ঠানে লুটেরা শেখ পরিবারের অন্যতম সদস্য রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের সিআরআইয়ের ট্রাস্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন।
এটি ছিল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের পক্ষে গুজব তৈরির কারখানা। অথচ বাংলাদেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পর্যালোচনার জন্য তাকে নিয়োগ দিয়েছিল ইউএনডিপি। এখন জাতিসংঘ ও ইউএনডিপির কাছে জানতে উচিত ফ্যাসিস্ট শাসকদের সমর্থন দিয়ে কি সুশাসন অর্জিত হয়েছিল? ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে জাতিসংঘের এই বৈঠক তাদের ফিরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
একই সময় আবার বাম সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শাহবাগী ন্যারেটিভ নিয়ে হাজির হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে লাল সন্ত্রাসের হুমকি। এই বাম সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক কাঠামোর ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ আবার বিভাজনের রাজনীতিতে নিজেদের স্থান করে নেওয়ার চেষ্টা করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে, ছাত্র আন্দোলনে জড়িত ও ফ্যাসিস্টবিরোধী সক্রিয় ছাত্রদের নাম-পরিচয় ও ছবি প্রকাশ করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিএনপির কিছু মধ্যম সারির নেতাও শাহবাগি বয়ানে বক্তব্য দিচ্ছেন।
পতিত সরকারের প্রচারবিদরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পুলিশ হত্যার বিচার চাইছে। কিন্তু জুলাই-আগস্টে শিশুসহ শত শত মানুষকে হত্যা, রাজপথে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়নের পরও তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুতাপ আমরা দেখছি না।
তাদের বক্তব্য, বিবৃতি ও হুমকির মধ্যে শাহবাগের খুনের নেশা যেন ফুটে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংকীর্ণ ভোটের রাজনীতির কৌশল হিসেবে যদি বিভাজনের রাজনীতি উসকে দেয়, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। আবারও সর্বশক্তি দিয়ে শাহবাগের রাজনীতি ফিরে আসার চেষ্টা করবে।
তবে আশার কথা হলো, এ দেশের তরুণ সমাজের কাছে শাহবাগের বিভাজনের রাজনীতির কৌশল পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বিদেশি মদতপুষ্ট নিপীড়নের রাজনীতির চেহারা তারা দেখে ফেলেছে। এই রাজনীতি মোকাবিলায় তারা নিজেরা যেমন রক্ত দিয়েছে, তেমনি শহীদ বন্ধুদের স্মৃতি তাদের তাড়া করে। তাদের আত্মত্যাগের কারণে স্বৈরশাসক ও তার দোসররা পালিয়ে গেছে। ফলে এই তরুণরা সাহসিকতার সঙ্গে আগামী দিনে শাহবাগের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি রুখে দেবে।
দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন হয়েছে জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এমন অভূতপূর্ব ঐক্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। মাত্র পাঁচ মাস আগের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমরা দেখছি রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় পরিচয়, পেশাগত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পরিচয় ভুলে সবাই রাজপথে নেমে এসেছিলেন। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে এতসংখ্যক নারীর উপস্থিতিও আগে কখনো দেখা যায়নি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাদরাসাছাত্রদের একসঙ্গে মিছিলে অংশ নিতে। শাড়ি কিংবা স্কার্টপরা নারীদের সঙ্গে হিজাব-বোরকা পরা নারীদের মিছিলে অংশ নিতে দেখা গেছে।
এ জাতীয় ঐক্য তৈরির এক মাসের কম সময়ের মধ্যে প্রাণ দিতে হয়েছে ১৫০০ মানুষকে। অন্ধ কিংবা পঙ্গু হয়েছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। এই ঐক্য ফ্যাসিস্ট ও তার প্রধান দোসরদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ১৮ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো পুরোটাই রয়ে গেছে। হাসিনার পতন ও পলায়নের পর রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটকেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিযোগিতার ফলে পাঁচ মাসের মাথায় আবার বিভক্তি ও বিভাজনের রাজনীতি ফিরে আসার আলামত দেখা যাচ্ছে।
গত দেড় দশকে ফ্যাসিস্ট শাসন টিকে ছিল জাতিকে বিভক্ত করার এক ন্যারেটিভ বা বয়ান থেকে। এটি ছিল চেতনার নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ করে জাতিকে বিভক্ত করা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ইসলামোফোবিয়া, যার লক্ষ্য ছিল ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে লিপ্ত থাকা পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আদায়। এতে ফ্যাসিবাদী শাসকরা বেশ ভালোভাবেই সফল হয়েছিল।
জাতিকে বিভক্ত করার এই রাজনীতির চূড়ান্ত রূপ ছিল ২০১৩ সালের শাহবাগের জমায়েত। যেখান থেকে তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি দমনের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও বিচার বিভাগকে ব্যবহারের ভিত্তি তৈরি করা হয়।
ফ্যাসিস্ট শাসনের যে উৎপীড়ন, তার পক্ষে একধরনের গণসম্মতি আদায় করার চেষ্টা হয়েছিল শাহবাগ থেকে। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ছাড়া আর কারো রাষ্ট্রপরিচালনার কোনো অধিকার নেই, এ ধারণা প্রতিষ্ঠাই ছিল শাহবাগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। যদিও এই আন্দোলনের স্লোগান ছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। ন্যায়বিচারের কথা সেখানে কখনো উচ্চারিত হয়নি। কারণ তারা আইনের শাসনের পরিবর্তে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর শাসন কায়েম করতে চেয়েছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শাহবাগ আন্দোলন ছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচন হতো না। আর ২০১৪ সালের নির্বাচন না হলে ২০১৮ সালের নিশিরাতের নির্বাচন হতো না। এরই ধারাবাহিকতায় হয়েছিল ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন। শাহবাগের উত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শাসনের হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। এটি শুরু হয়েছিল মাওলানা সাঈদীর রায় ঘোষণার পর।
২০১৩ সালের মার্চে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর সারা দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ১৪৬ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। এর তিন মাসের মধ্যে মে মাসে শাপলা চত্বরে চালানো হয় আরেক গণহত্যা। যেখানে অন্তত শতাধিক আলেম ও মাদরাসাছাত্রকে হত্যা করা হয়।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান দমনের নামে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, তার শুরু হয়েছিল ২০১৩ সাল থেকে। এর মধ্যে শত শত বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। চোখ তুলে নেওয়া হয়েছে। পায়ে গুলি চালিয়ে পঙ্গু করা হয়েছে। এ রকম বহু নিহত, আহত বা গুম হওয়া ব্যক্তির খবর হয়তো এখন আর আলোচনায় নেই।
দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও তাদের লেজুড় বামপন্থি-ভারতপন্থি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া আর সবাই ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। যারা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এমনকি তাদের বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আমরা তখন দেখেছি জামায়াত-শিবির পরিচয়ে বহু সাধারণ মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। সমাজে এমন একটি আবহ তৈরি করা হয়েছিল জামায়াত-শিবির পরিচয়ে যেকোনো ব্যক্তিকে হত্যা বা নির্যাতন করার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। এই আবহ শুধু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তৈরি করেছেন, তা নয়।
এর সঙ্গে জড়িত ছিল দেশের শিক্ষিত সমাজ এবং গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ব্যবসায়ী, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও বুদ্ধিজীবীরা। মানুষকে শুধু হত্যা বা পঙ্গু করার পক্ষে জনমত তৈরি করা হয়নি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে হরণ করা হয়েছে। সংবাদপত্র বন্ধ করার পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে। বিরোধী মতের সম্পাদককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। সত্য প্রকাশের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সম্পাদককে বিচারক বলছেন ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স। কী বিস্ময়কর বিচারব্যবস্থা! কিন্তু এ দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা তখন নীরব ছিলেন।
ফ্যাসিবাদ কায়েমের একটি সাংস্কৃতিক রূপ আছে। শাহবাগের নির্মমতার পেছনে এ দেশের বামপন্থি সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলোর ছিল প্রধান ভূমিকা। শাহবাগের ফ্যাসিবাদী বয়ান তৈরিতে শুরুতে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের সরব উপস্থিতি ছিল না। সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মতো খুচরা দলগুলো শাহবাগের ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নিয়েছে। ফলে
গত দেড় দশকের নিপীড়ন চালানোর দায় বাম সংগঠনগুলো এড়াতে পারে না। এ ছাড়া ইনু, মেনন ও দিলীপ বড়ুয়া তো নিপীড়ক সরকারের অংশীদার ছিলেন। সিপিবি সব সময় আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল সিপিবির বড় ধরনের ভূমিকা। ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টির যে ভূমিকা সিপিবির ভূমিকা কোনো অংশে তার চেয়ে কম নয়।
দেশের গণমাধ্যমগুলোও ফ্যাসিবাদী বয়ান প্রতিষ্ঠায় সে সময় বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। আমরা ভুলে যাইনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে পুলিশের আক্রমণে আহত-নিহত হওয়ার পর উল্টো বিরোধী দলগুলো তাণ্ডব চালিয়েছে বলে খবর প্রকাশ করা হতো। আমরা দেখেছি শাপলা চত্বরে মানুষ হত্যার পর গাছ কেটে বা কোরআন পুড়িয়ে কীভাবে অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
যদিও সবাই এখন কালিমালিপ্ত অতীত আর সামনে আনতে চাইছেন না। হাতের রক্ত মুছে ফেলে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সহযোগী হিসেবে অভিনয় করছেন। অথচ এই গণঅভ্যুত্থানে শিশু, ছাত্র ও শ্রমিকদের সঙ্গে অন্তত ৭৭ জন আলেম ও মাদরাসাছাত্র নিহত হয়েছে। যাদের আত্মত্যাগের কথা সুকৌশলে আলোচনার বাইরে রাখা হচ্ছে।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দিশাহীন আওয়ামী লীগ পাঁচ মাসের মাথায় আবার দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন যখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, তখন পরাজিত আওয়ামী লীগ বিভাজনের রাজনীতির সুযোগ নেবে, এটাই স্বাভাবিক। সিলেটে সম্প্রতি আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের বিজয় এর বড় প্রমাণ। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইউনিয়নের নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি পেশাজীবীরা বিজয়ী হয়েছেন।
আবার নানা ধরনের লবিংয়ের কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদল আওয়ামী লীগের দুজন নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। হাসিনার শাসনামলে ইউএনডিপির মতো প্রতিষ্ঠানে লুটেরা শেখ পরিবারের অন্যতম সদস্য রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের সিআরআইয়ের ট্রাস্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন।
এটি ছিল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের পক্ষে গুজব তৈরির কারখানা। অথচ বাংলাদেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পর্যালোচনার জন্য তাকে নিয়োগ দিয়েছিল ইউএনডিপি। এখন জাতিসংঘ ও ইউএনডিপির কাছে জানতে উচিত ফ্যাসিস্ট শাসকদের সমর্থন দিয়ে কি সুশাসন অর্জিত হয়েছিল? ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে জাতিসংঘের এই বৈঠক তাদের ফিরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
একই সময় আবার বাম সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শাহবাগী ন্যারেটিভ নিয়ে হাজির হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে লাল সন্ত্রাসের হুমকি। এই বাম সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক কাঠামোর ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ আবার বিভাজনের রাজনীতিতে নিজেদের স্থান করে নেওয়ার চেষ্টা করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে, ছাত্র আন্দোলনে জড়িত ও ফ্যাসিস্টবিরোধী সক্রিয় ছাত্রদের নাম-পরিচয় ও ছবি প্রকাশ করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিএনপির কিছু মধ্যম সারির নেতাও শাহবাগি বয়ানে বক্তব্য দিচ্ছেন।
পতিত সরকারের প্রচারবিদরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পুলিশ হত্যার বিচার চাইছে। কিন্তু জুলাই-আগস্টে শিশুসহ শত শত মানুষকে হত্যা, রাজপথে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়নের পরও তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুতাপ আমরা দেখছি না।
তাদের বক্তব্য, বিবৃতি ও হুমকির মধ্যে শাহবাগের খুনের নেশা যেন ফুটে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংকীর্ণ ভোটের রাজনীতির কৌশল হিসেবে যদি বিভাজনের রাজনীতি উসকে দেয়, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। আবারও সর্বশক্তি দিয়ে শাহবাগের রাজনীতি ফিরে আসার চেষ্টা করবে।
তবে আশার কথা হলো, এ দেশের তরুণ সমাজের কাছে শাহবাগের বিভাজনের রাজনীতির কৌশল পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বিদেশি মদতপুষ্ট নিপীড়নের রাজনীতির চেহারা তারা দেখে ফেলেছে। এই রাজনীতি মোকাবিলায় তারা নিজেরা যেমন রক্ত দিয়েছে, তেমনি শহীদ বন্ধুদের স্মৃতি তাদের তাড়া করে। তাদের আত্মত্যাগের কারণে স্বৈরশাসক ও তার দোসররা পালিয়ে গেছে। ফলে এই তরুণরা সাহসিকতার সঙ্গে আগামী দিনে শাহবাগের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি রুখে দেবে।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১২ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে