বিভেদের সুযোগ নিচ্ছে ফ্যাসিবাদী শক্তি

মিনার রশীদ
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ৩২
মিনার রশীদ

আক্ষরিক অর্থেই বটতলার উকিল। ৭১ সালে বড় ভাই নেজামে ইসলামীর নেতার সহযোগী ছিলেন কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পর নামের আগে যোগ করে নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কাউন্সিলর হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন কিন্তু ২০০৮ সালে এক-এগারোর তস্কর শামসুল হুদা-সাখাওয়াতদের বদৌলতে এমপি এবং পরে আইন প্রতিমন্ত্রী বনে যান। এর পরেরবারও এমপি এবং খাদ্যমন্ত্রী হয়ে ৪০০ কোটি টাকার পচা গম কিনে গমরুল উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন! গত পনেরো বছর তার ইতরামি ও ঔদ্ধত্য সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখাতে করা আবেদনের শুনানির জন্য তাকে হাজির করা হয়েছিল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে। তবে লিফটে না তুলে সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় উঠিয়ে আদালতের এজলাসে নেওয়ায় পুলিশের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যান কামরুল। তিনি বলেন, ‘আদালতের লিফট কি নষ্ট? এত ওপরে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটানো হচ্ছে কেন? এরপর রাগে চিৎকার করে বলেন, ‘ইতরামির একটা সীমা আছে। ফাজলামি পাইছেন? দোতলা বলে চারতলায় তুলছেন।’

বিজ্ঞাপন

আপনাদের হয়তোবা স্মরণে আছে যে মাত্র কিছুদিন আগে ৮৪ বছর বয়স্ক ড. ইউনূসকে হাঁটিয়ে আটতলায় উঠিয়েছিলেন ইতরকুল শিরোমণি শেখ হাসিনা। সম্ভবত সিসিটিভিতে লাইভে সেই দৃশ্য দেখে বিকৃত আনন্দ পেয়েছিলেন সেই সাইকোপ্যাথ। কাজেই ঐকিক নিয়মে সহজেই আমরা ইতরামির সীমাটি নির্ণয় করতে পারি। ৮৪ বছর বয়সি ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে ইতরামির সীমা যদি আটতলা হয়, তবে ৭৪ বছর বয়স্ক কামরুলের ক্ষেত্রে ইতরামির এই সীমা কয়তলা হওয়া উচিত? ক্যালকুলেটর বলে নয়তলা। কাজেই ইতরামির এখনো আরো পাঁচতলা বাকি আছে।

এই হাসিনা-কামরুলরা ইতরামির যে নমুনা বা সীমানা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা স্থানে সেট করে গেছেন, তাকে অতিক্রম করার হিম্মত অন্য কারো হবে না। এদের ইতরামির আসলেই কোনো সীমা ছিল না, সবচেয়ে বড় ইতরামি একক জাতিসত্তার চমৎকার জাতিরাষ্ট্রটিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অপরাধে চার সন্তানের জননীকে গ্যাং রেপ করা হয়েছে। স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে রেপ করেছে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা।

সন্তানকে না পেয়ে বাবাকে, স্বামীকে না পেয়ে স্ত্রীকে তুলে নিয়েছে। এ রকম ইতরামি আইয়ামে জাহিলিয়াতের যুগেও দেখা যায়নি। সব ইতরামির কথা লিখতে গেলে শত শত পৃষ্ঠা হয়ে পড়বে। জাতীয় পর্যায়ের নেতাদেরও হাতে হাতকড়া এবং পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়েছে। বিএনপির এক নেতা প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মায়ের জানাজায় শরিক হলেও সেই ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের অনেক ছেলেকে শুধু গুম, খুনই করেনি, নির্যাতন করে অনেকের পুরুষত্ব চিরতরে নষ্ট করেছে সর্বযুগের সর্ব নিকৃষ্ট এই ইতররা।

আমাদের গোল্ডফিশ মেমরির কারণে এই ইতরদের সব ইতরামি ভুলে গেছি। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এখন বিএনপি কিংবা জামায়াতের শত্রু আওয়ামী লীগ নহে, এখন বিএনপির শত্রু জামায়াত এবং জামায়াতের শত্রু বিএনপি।

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, বিপ্লবের পক্ষের শক্তিগুলো মাত্র পাঁচ মাসেই গমরুলদের সব ইতরামি বেমালুম ভুলে গেছে। তাদের ওপর জুলুম করা সেই জালেমের চেয়েও একে অন্যকে বেশি শত্রুজ্ঞান করছে। বিএনপি মহাসচিব এসব জুলুম দেখে বেশ কয়েকবার নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন! সেদিন যারা কাঁদিয়েছিল, তাদের কথা ভুলে গিয়ে মনে হয় যাদের সঙ্গে একসঙ্গে কেঁদেছেন, তারাই পারস্পরিক শত্রু হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সবাই কেমন যেন একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি।

কমন শত্রুর কথা ভুলে গিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করেছে। সংগত কারণেই এ সুযোগটি গ্রহণ করছে পতিত ফ্যাসিবাদ শক্তি। অথবা আড়াল থেকে এরাই এই আগুনে হাওয়া দিচ্ছে। এরা কীভাবে কাজ করে তার একটি নমুনা দেখুন!

দৈনিক জনকণ্ঠ একটি রিপোর্ট করে ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ মির্জা ফখরুলের কথিত একটা উক্তি নিয়ে। ‘রাজনীতির সঙ্গে কোরআনের কোনও সম্পর্ক নেই : ফখরুল’, এই শিরোনামে। অথচ ভেতরের প্রেক্ষাপট ২০১৮ সালের, নির্বাচনের প্রাক্কালে যখন জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জামায়াত এবং বামপন্থিদের নিয়ে বিএনপির তখন শ্যাম রাখি নাকি কুল রাখি অবস্থা! বিএনপির মুখ থেকে এ জাতীয় কথা বের করার জন্য নানা ফায়দা বের করে এবং জবাব যাই হোক তাকে আরেকটু টুইস্ট করে এ জাতীয় মসলাদার শিরোনাম করে। এই ইবলিশকণ্ঠ তৌহিদী জনতার কোন জায়গায় এবং কেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।

সমস্যা হলো, আমাদের অবস্থা এমন হয়েছে যে কেউ যদি বলে, চিলে আপনার কান নিয়ে গেছে। আমরা তখন কানে হাত না দিয়েই চিলের পেছনে দৌড়ানো শুরু করি। আগেও একই কাজ করতাম, ইদানীং এই ফ্যানোমেনাটি বেড়ে গেছে!

জামায়াতের বিরুদ্ধে একটা নিউজ বের হলেই সেটা যেমন বিএনপি লুফে নেয়, তেমনি বিএনপির বিরুদ্ধে একই ধরনের নিউজ বের হলে জামায়াতও একই আচরণ করে। সংবাদটি যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে না। আর এই সুযোগটি পুরোপুরি গ্রহণ করছে মতলববাজ ইবলিশকণ্ঠরা। পেছনে কারা, তা আর বলার প্রয়োজন পড়ে না।

দেশের ভেতর থেকে ইবলিশকণ্ঠগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাইরে বসে এ আরাফাত, নিঝুম মজুমদারের মতো আরো কয়েকজন সক্রিয় হয়ে পড়েছেন। ‘আগেই ভালো ছিলাম’ এ রকম একটা বয়ান ছড়াতে চাচ্ছে ।

বিএনপি, জামায়াত এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়কদের পারস্পরিক মুখোমুখি করার চেষ্টা সক্রিয় রয়েছে! বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াত পরস্পরের দুর্বল জায়গাগুলোয় আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। চিহ্নিত শত্রুপক্ষের প্রচারণা যতটুকু ক্ষতি না করে, প্রাক্তন বন্ধুর প্রচারণায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হয়।

জামায়াত তাদের প্রচারণায় বিএনপি নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টিকে হাইলাইট করার চেষ্টা করছে। বিষয়টি যে একেবারে মিথ্যা, তাও না। বিএনপি ফেরেশতাদের দল নহে কিংবা সবাই ফেরেশতা নহেন। ক্যাডারভিত্তিক ও ছোটখাটো দল হিসেবে জামায়াতের পক্ষে নৈতিকতার যে ফিল্টারিং করা সম্ভব, উদারবাদী ও বিশাল দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে তা সম্ভব নহে। সমাজের সামগ্রিক আর্থিক ও নৈতিকতার মান সাপেক্ষে জামায়াতকে যদি বিএনপির মতো বিশাল দল হতে হয়, তবে নৈতিকতার এই মান কতটুকু ধরে রাখতে পারবে, সেটাও গবেষণার বিষয়!

চাঁদাবাজির সঙ্গে একই সঙ্গে ওঠে দখলবাজির অভিযোগ। বিএনপি এবং জামায়াত উভয়ের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগটি উঠছে। এসব দখলবাজির অনেকগুলো আছে নিজের সম্পত্তি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পুনর্দখল যেসব আওয়ামী মাফিয়ারা জোর করে দখল করেছিল।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কিন্তু সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, প্রতি জেলায় একটা কমিটি করে এসব দখলকৃত সম্পত্তি তাদের নিজ নিজ মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। তারেক রহমানের সেই পরামর্শটি মানলে এসব বিশৃঙ্খলা অনেকটা কমানো যেত।

চাঁদাবাজিতে নৈতিকতার সংকটের সঙ্গে সঙ্গে কাঠামোগত ত্রুটি বা স্ট্রাকচারাল কিছু ডিফেক্ট রয়ে গেছে। বালুমহালসহ আরো অনেক জায়গায় চাঁদাবাজি হয় সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা না থাকায়। পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া চাঁদাবাজি সম্ভব নহে। অথচ পুলিশের নিয়ন্ত্রণ বিএনপির হাতে নেই। পুলিশিংয়ের এই ব্যর্থতাও চাপছে বিএনপির কাঁধে।

তবে বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো ‘ডিনায়েল অব দ্য ট্রুথ’ করছে না। বিএনপির টপ নেতৃত্ব থেকে এসব থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে, অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে যারা চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য অপকর্ম করবে, তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিন। এরপরও সহযোগী বন্ধুদের এই নির্দয় খোঁচা মারা দুঃখজনক, যে কাজটি জামায়াত-শিবিরের লোকজন বিশেষ করে অনলাইনে ব্যাপক হারে করে যাচ্ছেন। সংগত কারণেই এসব প্রচারণায় আরও হাওয়া দিচ্ছে আওয়ামী বটবাহিনী।

এর বিপরীতে বিএনপির প্রতিক্রিয়া আরো ভয়াবহ ও আত্মবিধ্বংসী বলে গণ্য হচ্ছে । জামায়াতকে আওয়ামী বলয় যে ভঙ্গিতে আক্রমণ করত, যেসব বয়ান দিয়ে কুপোকাত করত, অনেকটা তাই নকল করছে বিএনপি। এমনকি সেই আওয়ামী গরম মসল্লা হিসেবে পরিচিত ‘রগ-কাটা’ বয়ান হাজির করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে বিএনপির বড় ফাইটার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ২০১৮ সালে নিজের দলকে ব্ল্যাকমেইলিং করে ছয়টি এমপি হজম করতে বাধ্য করা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই হারুন অর রশীদ! উত্তেজনার একপর্যায়ে তিনি বীর দর্পে ঘোষণা করেছেন, বিএনপির উচিত হবে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক শুরু করা যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা! অথচ ম্যাডাম খালেদা জিয়া কথিত এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নামক প্রহসনটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।

এই হারুনরা এখন ম্যাডামের চেয়েও বড় বিএনপি হয়ে পড়েছেন! বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকেও এই প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। বিএনপির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস, এমনকি বর্তমান মহাসচিব সাহেবের বাবা জীবিত থাকলে তাদেরও ফাঁসিতে ঝোলানো হতো। তাদের অনেক অনুসারী এখন বিএনপিতে রয়েছেন এবং সম্ভবত বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে ইন্ডিয়ানবিরোধী হিসেবে পরিচিত এরাই এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ!

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি ফজলুর রহমান মুজিববাদের পুনরুজ্জীবনে প্রকাশ্যে এগিয়ে এলেও অনেকে আড়াল থেকে এই কাজটি করছেন বলে অনুমিত হচ্ছে। ফজলুর রহমান এবং গোলাম মাওলা রনি এরা হয়েছেন সেসব নিবেদিতপ্রাণ নারী ইসরায়েলি গুপ্তচরদের মতো, যারা দেশের স্বার্থে বিভিন্ন আরব দেশের আর্মি অফিসারদের বিয়ে করে প্রায় পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পর বোঝা গিয়েছিল যে এরা ছিলেন আসলে ইসরায়েলের গুপ্তচর!

সুপ্ত, গুপ্ত এবং নব্য চেতনাবাজদের প্ররোচনায় বিএনপি আরো সংকটে পতিত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই । আওয়ামী লীগের মতো বিএনপির গায়ে ইন্ডিয়ার গন্ধ লাগাতে পারলে শত্রুদেরই জয় হবে।

উভয় পক্ষের অতি-উৎসাহীদের নিবৃত করতে না পারলে আমরা যারা এন্টি ইন্ডিয়ান ও এন্টি আওয়ামী নামক জাতীয়তাবাদী জাহাজে পা রেখেছি, সবাইকে একসঙ্গে ডুবতে হবে! দেশটির বর্তমান সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আমাদের নিবেদন, ভিক্ষা (সুখ) চাই না, মাগো-বাবাগো, কুত্তা সামলান! কারণ আপনারা যেদিকে এগোচ্ছেন, তাতে আগের ইতরদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন সময় লাগবে না।

লেখক : কলামিস্ট

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত