বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক সুদীর্ঘ ও ঘটনাবহুল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। বেগম খালেদা জিয়া, যিনি কেবল একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেত্রীই ছিলেন না, বরং ছিলেন এ দেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এবং আপসহীনতার জীবন্ত প্রতীক। তাঁর প্রয়াণে আজ গোটা জাতি শোকস্তব্ধ। এ শোকের মুহূর্তে আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, একজন জাতীয় নেতাকে তাঁর প্রাপ্য সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদায় বিদায় জানানো।
এক আজন্ম লড়াইয়ের মহাকাব্য
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি কখনোই ক্ষমতার মোহে নীতি বিসর্জন দেননি। ১৯৮২ সালে স্বামী হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি যখন রাজপথে নামেন, তখন থেকেই তিনি ‘আপসহীন’। ১৯৮৬ সালের পাতানো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তিনি যে নৈতিক দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন, তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করেছিল। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে মানিক মিয়া এভিনিউতে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন “আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা, অন্যদের হাতে গোলামীর জিঞ্জির।” তাঁর সেই দৃঢ়তা এখনও এ দেশের মানুষের দেশপ্রেমকে জাগ্রত করে।
বৈদেশিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন হিমালয় সদৃশ। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে সৈন্য পাঠানোর মার্কিন চাপ উপেক্ষা করা কিংবা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিবেশী দেশের সাথে কোনো অসম চুক্তিতে না যাওয়া তাঁকে এক অনন্য রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা দিয়েছে। এমনকি কারান্তরীণ অবস্থায় সুচিকিৎসার অভাব এবং বিদেশের মাটিতে যাওয়ার সুযোগবঞ্চিত হয়েও তিনি মাথা নত নোয়াননি ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছ।ে ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও ছিল তাঁর অনড় অবস্থানের আরেক বড় প্রমাণ। এসব অনন্য দৃষ্টান্ত তাঁকে প্রতিষ্ঠা করেছে, ’ইতিহাসের বাঁক বদলের এক নির্ভীক কারিগর’ রুপে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও জানাজার প্রস্তাব
বেগম খালেদা জিয়া কোনো সংকীর্ণ দলীয় গণ্ডির মানুষ নন। তিনি ছিলেন দেশের তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী। তাই তাঁর বিদায় অনুষ্ঠানটি কোনো দলের একক আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। এটি হতে হবে রাষ্ট্রীয় শোকের বহিঃপ্রকাশ। আমাদের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জরুরি জাতীয় সভা আহ্বান করবেন। সেই সভায় সর্বসম্মতভাবে তাঁর জানাজা ও দাফন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া প্রয়োজন। ইসলামের বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিকে দ্রুত দাফন করা উত্তম। তবে একজন জাতীয় নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষের আসার সুযোগ করে দিতে প্রয়োজনীয় সময়ের সমন্বয় করে জানাজার সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে।
প্রস্তাব করছি, বেগম জিয়ার প্রথম এবং প্রধান জানাজা যেন জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে দেশের সকল স্তরের মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন। এরপর তাঁকে তাঁর স্বামী, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে জিয়া উদ্যানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হোক। এতে জাতি হিসেবে আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাবে এবং এটি ইতিহাসের এক সুন্দর মেলবন্ধন হয়ে থাকবে।
ইতিহাসের শিক্ষা ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতা পরিহার
বিশ্বজুড়ে জাতীয় নেতাদের বিদায় সবসময়ই রাষ্ট্রীয় মহিমায় ভাস্বর হয়। ১৯৮১ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজায় মানিক মিয়া এভিনিউতে যে জনসমুদ্রের সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও বিশ্বের ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মানুষ সেদিন নেতার টানে নয়, বরং এক মহান দেশপ্রেমিকের বিদায়ে অঝোরে কেঁদেছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সম্প্রতি শহীদ শরীফ ওসমান বিন হাদির জানাজায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে ‘পরিকল্পিত নকশা’ বা ‘ষড়যন্ত্র’ বলে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। বেগম জিয়ার জানাজায় যে কোটি মানুষের ঢল নামবে, তা নিয়ে যেন এমন কোনো নেতিবাচক প্রচারণা বা সস্তা রাজনীতির সুযোগ না থাকে। এটি কোনো রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ নয়, বরং এটি একজন মহীয়সী নারীর প্রতি জাতির বিনম্র শ্রদ্ধার মুহূর্ত। ১ কোটি সিম কার্ডের হিসাব বা সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের এই বিদায়কে জাতীয় শোকের আবহে পালন করতে হবে।
শেষ কথা
বেগম খালেদা জিয়া তাঁর জীবনে অনেক হারিয়েছেন। অল্প বয়সে হারিয়ছেন স্বামীকে। সন্তানদের থেকে দূরে থেকেছেন। খেটেছেন জেল। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি অবস্থায় থেকেছেন। এতকিছুর পরও তিনি হারাননি তাঁর আত্মসম্মান ও দেশপ্রেম। আজ তাঁর প্রয়াণের পর জাতি হিসেবে আমরা যদি তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হই, তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বেগম খালেদা জিয়াকে জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। তাঁর কর্ম ও ত্যাগ যেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সার্বভৌমত্ব রক্ষার চিরন্তন প্রেরণা হয়ে থাকে।
লেখক, রেজাউল হক কৌশিক: যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল কমিউনিকেশনে পিএইচডি গবেষক।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

