খানের আখ্যান

যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে কোন পথে নেবে

মারুফ কামাল খান
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ০৯: ১৪

মধ্যপ্রাচ্যে এখন ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলছে তুমুল সংঘাত। ওই অঞ্চলের দুষ্টগ্রহ ইসরাইল রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজন কমান্ডার ও পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করে। এই কাপুরুষোচিত হামলার প্রতিশোধ নিতে ইরান মিসাইল হামলার প্রবাহ শুরু করে। ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এতকাল যা দুর্ভেদ্য বলে প্রচারিত ছিল, তা ইরানি হামলায় অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়ে। ওরাও পাল্টা বিমান হামলা চালাতে থাকে ইরানে। চলমান হামলা-পাল্টা হামলায় দুপক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিস্তীর্ণ জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। উভয় পক্ষের বেসামরিক নাগরিকরা কেউ নিষ্কৃতি পাচ্ছে না এই প্রাণঘাতী হামলা থেকে। ইসরাইল নামের সাম্প্রদায়িক জায়নবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্রটির স্রষ্টা ব্রিটেন তাদের ঘোর দুর্দিনে অস্ত্র পাঠিয়েছে। ইসরাইলের প্রধান মদতদাতা যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর হুংকার দিয়ে চলেছে। ফলে এই সংঘাত একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেওয়ার এবং তা পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন অনেকেই। এ যুদ্ধে প্রাণহানি ও ধ্বংসলীলা ছাড়াও জীবাশ্ম জ্বালানি সরবরাহ এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুতর প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার অবশ্যম্ভাবী আশঙ্কা রয়ে গেছে। তবে চলমান এ সংঘাতের হাল অবস্থায় এর প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল সম্পর্কে কোনো উপসংহারে পৌঁছা সম্ভব নয়। তাই পারিপার্শ্বিক কিছু আলোচনার মধ্যেই আজ এ লেখা শেষ করব।

ইরানে শিয়া মতবাদভিত্তিক আয়াতুল্লাহ্দের ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব থেমে থেমেই চলে আসছে। মার্কিনি প্রকাশ্য ও গুপ্ত হানায় বিভিন্ন সময় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাজনীতিক, সমরবিদ, প্রশাসক এবং ধর্মীয় নেতাকে জীবন দিতে হয়েছে। প্রতিটি হামলার পর ইরানের নেতৃত্ব ও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক শক্তির ভারসাম্যের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা ইরানের পক্ষে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিকার করা বা প্রতিশোধ নেওয়া কখনোই সম্ভব হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইরান গ্লোবাল থিয়েটারের কোনো অ্যাক্টর বা প্লেয়ার নয়। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক পটভূমিতে ইরান তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রথম দিকে ডিফেন্সিভ রোল প্লে করেছে। তবে সৌদি আরবের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে মক্কার কর্তৃত্ব সম্মিলিত ইসলামিক বডির হাতে ন্যস্ত করার দাবিতে অঘটন ঘটিয়ে প্রথম দিককার একটা হঠকারিতার পর অনেক দিন ইরান সংযতই ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার তারা অফেন্সিভ ভূমিকায় নেমেছিল। কেউ কেউ মনে করেন, নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে এবং চাপ ও অবরোধের মধ্যে ফেলে ইরানকে পরাশক্তিগুলোই বেপরোয়া হয়ে উঠতে বাধ্য করে। ইরানের এই অফেন্সিভ ভূমিকার যেগুলো বিশ্ব পরাশক্তির পক্ষে গিয়েছে, সেগুলোতে তারা নীরবে-নিভৃতে সায় দিয়েছে। সুন্নি মুসলিমদের একটি উগ্রবাদী অংশ রহস্যময় শক্তির মদতে হঠাৎ শক্তিশালী হয়ে ওঠা দায়েশ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাকীর্ণ ইরাক ও সিরিয়ার বিরাট অংশ দখল করে আইএসআইএল নামে এক তথাকথিত খেলাফতি রাষ্ট্র কায়েম করে। এই দায়েশ ও তাদের সহযোগী অন্যান্য স্থানীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয় ইরান। এ লড়াই ইরানকে ইরাক ও সিরিয়ায় বিরাট সাফল্য এনে দেয়। এতে ইরান অফেন্সিভ ভূমিকার ব্যাপারে আরো বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠে। সিরিয়ার রণাঙ্গণে সরাসরি লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিভিন্ন দেশে সমর্থনপুষ্ট যোদ্ধাগোষ্ঠী গঠন, প্রক্সি ওয়ার ও গেরিলা হামলায় তারা সর্বপ্রকার সহায়তা দিতে থাকে। শিয়া ছাড়াও তারা তাদের সমর্থনপুষ্ট কিছু সুন্নি যোদ্ধা গ্রুপের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সাহায্য দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ওপর ইরানি প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

বিজ্ঞাপন

ইরানের এই অফেন্সিভ প্রথমদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন ইরানি জুজুর ভয় দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশগুলোর কাছে বিপুল সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ইরানি প্রক্সি ওয়ারের অ্যাডভেঞ্চারিজম ও অ্যাসিমিট্রিক ওয়ারফেয়ার সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ‘ভ্যাসল স্টেট’ ইসরাইলের স্বার্থে আঘাত হানতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের যে চরিত্র, তাতে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে, মধ্যপ্রাচ্য ও বহির্বিশ্বে তার কর্তৃত্বের আবহ বজায় রাখার স্বার্থে, মিত্রদের আস্থা টেকাতে এবং মার্কিন স্বার্থবিরোধী ধারাবাহিক অ্যাডভেঞ্চারিজম রোধ করতে তাদের পক্ষ থেকে এমন কঠোর মেসেজ যে এই পর্যায়ে এসে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল, সেটা আগাম অনুধাবন করে সতর্কতা অবলম্বন করতে না পারাটা ইরানের এক বড় ব্যর্থতা। সেই ভুলের যে চরম মাশুল তারা দিয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে শোধরানোর বা পূরণ করার কোনো সুযোগ আপাতত নেই।

মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটছে তা মূলত বিভিন্ন দেশের জাতীয় স্বার্থ, জাতীয়তাবাদী ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ, রাজনীতি, কর্তৃত্বপ্রবণতা, অর্থনীতি, সমরকৌশল, জ্বালানি চাহিদা, বাণিজ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিযোগিতার ফলাফল। এই প্রতিযোগিতায় ধর্মীয় আবেগ, ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করা হলেও ধর্ম এখানে বিরোধের প্রধান কারণ নয়। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শিয়া-সুন্নির মতো ধর্মীয় দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে সামনে এলেও ঘটনাগুলো এই দ্বন্দ্বের কারণে ঘটছে না।

ইহুদিদের সঙ্গে খ্রিষ্টানদের গোড়া থেকে যে দ্বন্দ্ব এবং এর জের ধরে যে বিপুল রক্তপাত, নৃশংসতা ও জীবনহানি ঘটেছে, তা সবারই জানা। সেই খ্রিষ্টানরা প্রায় সবাই মিলেই মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ইসরাইল স্থাপন করে দিয়েছে, কি ধর্মীয় কোনো তাগিদ থেকে?

ইসলামের মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর নেতৃত্বের উত্তরাধিকার ও ধারা নিয়ে তার সাহাবিদের মধ্যে যে মতান্তর ঘটে, সেখান থেকেই শিয়া-সুন্নি মতবাদের উদ্ভব। উত্তরাধিকার সূত্রে মহানবী (সা.)-এর বংশধারা অর্থাৎ আহলে বায়াত বা হাউস অব প্রোফেট থেকে নেতৃত্বের পক্ষাবলম্বনকারীরা শিয়া পরিচিতি লাভ করে। অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা প্রবীণ সাহাবিদের পরামর্শসভা বা মজলিসে শূরার মাধ্যমে যোগ্যতম ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচনের পক্ষে মতপোষণ করেন, তারাই কালক্রমে সুন্নি হিসেবে পরিচিতি পান। এই মতান্তর প্রথমে খুব বেশি তীব্র হয়নি। আহলে বায়াত থেকে রাশেদিন খেলাফতের চতুর্থ বা শেষ খলিফা হিসেবে হজরত আলী নির্বাচিত হন। তখন সুন্নিরা যেমন আহলে বায়াতের নেতৃত্ব মেনেছে, তেমনিভাবে শিয়ারাও খেলাফতকে অস্বীকার করেনি। বিরোধটা তীব্র, তিক্ত ও অমীমাংসিত পর্যায়ে চলে যায় বিশেষ করে কারবালার মর্মন্তুদ শাহাদাতের ঘটনার পর। খেলাফত অধিকার প্রতিষ্ঠায় বারবার ব্যর্থ হয়ে শিয়ারা একসময় খেলাফত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই চলে যায়। তারা এর বিপরীতে উত্তরাধিকার সূত্রে আহলে বায়াতের আধ্যাত্মিক ইমামত বা নেতৃত্বের থিওরি প্রবর্তন করে। আর সুন্নিরা খেলাফতের অপভ্রংশ হিসেবে অনৈতিক সালতানাত বা রাজতন্ত্রকেই মুখ বুজে সমর্থন দিতে থাকে। এই যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ, এর সঙ্গে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার চেয়ে ইহলৌকিক নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও রাজনৈতিক আধিপত্যের দ্বন্দ্বটাই যে প্রবল ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানবসৃষ্ট এই দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে স্থান-কাল-পাত্রভেদে ঈমান, আকিদা, ফিকাহ ও শরিয়তি বিধিবিধানেও কিছু কিছু পার্থক্য এবং ব্যবধান তৈরি করেছে। কালক্রমে সেই ব্যবধান ও দ্বন্দ্বগুলো ক্রমান্বয়ে দুরতিক্রম্য হয়ে উঠেছে।

১২ ইমামে বিশ্বাসী টুয়েলভার শিয়াদের শক্তিশালী ঘাঁটি ইরান। পাহলবি বংশের সেক্যুলার ও পারস্য জাতীয়তাবাদী শাহেনশাহকে হটিয়ে জনবিপ্লবে শিয়া ইমাম বা ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ্দের কর্তৃত্বাধীন এই ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদার আরব মুসলিম খলিফাদের পারস্য জয়ের পর দেশটির জরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারীরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর প্রায় ৮৫০ বছরজুড়ে ইরানে ইসলামের সুন্নি মতাবলম্বীরাই ছিল বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শাহ্ ইসমাইল ইরান বা পারস্য দখল করে সাফাভি রাজবংশের শাসন প্রবর্তন করেন। এই পারস্য সাম্রাজ্যের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তুর্কি খেলাফত নামের ওসমানীয় বা অটোমান সাম্রাজ্য। ওসমানীয়রা ছিলেন সুন্নি মুসলমান এবং সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম ছিল ইসলামের সুন্নি স্কুল অব থট। আর তাই তাদের সঙ্গে পার্থক্য নিরুপণের উদ্দেশ্যেই শাহ্ ইসমাইল-১ শিয়া তরিকাকে সাফাভি সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর রাষ্ট্রশক্তির জোরে পারস্য বা ইরান সাম্রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের জোর করে ১২ ইমামে বিশ্বাসী শিয়া ধর্মমতে ধর্মান্তরিত করা হয়। দ্রুতই সাফাভি রাজবংশ শাসিত ইরানে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সুন্নিরা সংখ্যালঘু হয়ে যায়। সাফাভি রাজবংশ-শাসিত পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল আজারবাইজান, বাহরাইন ও আর্মেনিয়া। এ ছাড়া জর্জিয়া, উত্তর ককেসাস, ইরাক, কুয়েত ও আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা এবং তুরস্কের, সিরিয়ার, পাকিস্তানের, তুর্কমেনিস্তানেরও উজবেকিস্তানের অংশবিশেষ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে ইরানের বাইরে এসব অঞ্চলেও শিয়া ধর্মমতের বিস্তার ঘটে। অর্থাৎ বর্তমান ইরানে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সন্নিহিত অঞ্চল ও দেশগুলোয় শিয়া মতের বিস্তারের পেছনের কারণও ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিক। একইভাবে মিশনারি কার্যক্রমের মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্ম ও দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে সুন্নি ইসলামের দীক্ষার পাশাপাশি এই দুটি ধর্মের বিস্তারের ইতিহাসকে রাজনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেখার উপায় নেই।

ভারতের মুঘল শাসকরা সুন্নি হলেও এদেশে ইসলাম প্রচারকাজে শিয়া-সুন্নি উভয় স্কুল অব থটের সুফিরা অবদান রেখেছেন। তা ছাড়া পারস্য ও সন্নিহিত অঞ্চল থেকে আসা অনেক শিয়া জেনারেল ও অমাত্য মুঘল সম্রাটের দরবারে বা মুঘলশাসিত প্রদেশগুলোয় উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। ব্যবসা উপলক্ষেও ইরানি শিয়া অভিজাতরা এদেশে এসেছেন। এসেছেন আওলিয়া, দরবেশ, অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীরাও। কাজেই সংখ্যায় কম হলেও ভারতে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব-প্রতিপত্তির কমতি ছিল না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ভারতে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলোর মতো কখনো তীব্র হয়নি। মীর জাফর আলী খান এ অঞ্চলে শিয়া হওয়ার কারণে নয়, বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ঘৃণিত হয়েছেন। আবার শিয়া সিরাজুদ্দৌলা, মির্জা গালিব, আগা খান, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্, ইস্পাহানি পরিবার, হারুন পরিবার, হাজী মুহাম্মদ মহসিনের মতো মানুষরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে মর্যাদার আসন লাভ করেছেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান, আল্লামা ইকবাল ও নবাব স্যার সলিমুল্লাহর মতো ব্যক্তিরা শিয়া-সুন্নি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকার চেষ্টা করেছেন। বিহার থেকে আসা মুসলিম মুহাজিরদের সঙ্গে শিয়া হওয়ার কারণে নয়; বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে এ অঞ্চলের মানুষের বিরোধ হয়েছে। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ইরানের প্রতি আমাদের অঞ্চলের সুন্নি মুসলিমদের বিদ্বেষের কোনো লক্ষণ অতীতে তেমন দেখা যায়নি।

কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশে আগেকার সেই অবস্থা এখন নেই। পাকিস্তানে, ভারতে এবং বাংলাদেশেও সাম্প্রতিককালে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব অনেকটাই প্রকট। এটা কি শিয়া আয়াতুল্লাহ্দের থিয়োক্র‍্যাটিক স্টেট প্রতিষ্ঠার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? নাকি এই দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষের পেছনেও ধর্মীয় কারণের চেয়ে রাজনৈতিক কারণই প্রধান কি না, তা নিয়ে বিতর্ক ও গবেষণা হতে পারে।

ইরানকে এই বাস্তবতাগুলো মাথায় রাখতে হবে। তাদের ভূমিকার কারণেই হোক কিংবা প্রতিপক্ষের প্রচারণার কারণেই হোক, সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বিশ্বে শিয়া ধর্মগুরু বা আয়াতুল্লাহ্‌দের শাসিত ধর্মরাষ্ট্র ইরানের সমর্থনের ভিত খুব নাজুক। হাজারো মজলুম হলেও ইরানের পাশে মুসলিম জনমত ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াবে নাÑএটাই বর্তমান বাস্তবতা। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্রদেশগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত ও নাজুক দশায়। রাশিয়া, চীন, তুরস্কও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলেও ইরানের পক্ষে সরাসরি কোনো ভূমিকা রাখবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আরব শাসকরা কেউ কেউ ইরানের পক্ষে ‘লিপ সার্ভিস’ দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের ইশারার বাইরে তাদের কারুর যাওয়ার উপায় নেই। কাজেই বাস্তবতার আলোকে ইরানের স্ট্র্যাটেজিকে নতুন করে বিন্যস্ত করতে হবে।

ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি নাগরিক বিক্ষোভ ও আন্দোলনের চেষ্টায় বোঝা গেছে ভেতরে ধূমায়িত অসন্তোষ রয়েছে। যে ইসলাম মানবতার মুক্তি দিয়েছে, নারীদের সম্মানিত করেছে, সেই ইসলামের নামেই ইরানে মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নারীরা সেখানে আজ আবার দাসত্বের নিগড়ে বন্দি। জুলুম-পীড়ন সেখানে নিত্যকার চিত্র। সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে ইসলামের নামে এই জুলুমের শাসন ইরানের বিপুলসংখ্যক মানুষকে ইসলামবিমুখ করে তুলেছে। ইরানে বহু মসজিদ মুসল্লির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এই ক্ষোভ ইরানে পতিত শাহের নির্বাসিত যুবরাজের সমর্থক সংখ্যা বাড়িয়েছে। অনেকে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট হয়ে অন্তর্ঘাতে লিপ্ত হয়েছে। এই সুযোগে ইরানের দুশমনরা সেখানে হামলার ছত্রছায়ায় রেজিম বদলের পরিকল্পনা নিয়েও অগ্রসর হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সব মাস্তানি সবসময় ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়নি। তাদের ইরাক অভিযান ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বলয়কে বিস্তৃতি দিয়েছে। সাদ্দাম আমলের চরম বৈরী ইরাক এখন ইরানের অনুগত মিত্র। সিরিয়ায় আসাদের পতনের আগ পর্যন্ত ছিল ইরানের কর্তৃত্ব প্রবল। এ ছাড়া রাষ্ট্রবহির্ভূত বেশ কিছু শক্তির সঙ্গে ইরানের রয়েছে চমৎকার মিতালি। কুর্দিদের একটা অংশের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো। ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ বা হুতি বিদ্রোহী, লেবানিজ শিয়া হিজবুল্লাহ্ তো আছেই, ফিলিস্তিনের সুন্নি হামাসরা পর্যন্ত ইরানের মিত্র। ইরানের চারপাশেই স্থাপিত হয়েছে মিত্রদের শক্ত প্রতিরোধবেষ্টনী। কাজেই ইরানের অস্থির না হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে অগ্রগতির ভুয়া অজুহাতে ইসরাইলকে দিয়ে ইরানকে আক্রমণ করিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টাই যে জোরদার করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ▫️

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

ই-মেইল : mrfshl@gmail.com

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত