
ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম খাঁন

প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রতিবছর এখানে শিল্প, বাণিজ্যিক, আবাসিকসহ বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচ হয়। প্রচলিত শক্তির উৎস হিসেবে বর্তমান সময়ে তেল, গ্যাস, কয়লা ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব শক্তির উৎসের বেশিরভাগই একবার ব্যবহার হয়ে গেলে তা আবার আর ব্যবহার করা যায় না।
শক্তির উৎপাদনের চেয়ে দ্রুততর ব্যবহার এবং এর পরিমাণের সীমাবদ্ধতার কারণে তা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ফলে আগামী দিনের শক্তির চাহিদা পূরণে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশেই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা এই শক্তি সংকট। বিশ্বজুড়ে শক্তির চাহিদা ক্রমেই বেড়েই চলছে আর দিন দিন বাড়বে।
শক্তির এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিককে গুরুত্ব দিতে হবে। আর কীভাবে বর্তমান শক্তির অভাব পূরণ করা যাবে ও ভবিষ্যৎ চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কীভাবে তার উৎপাদন বাড়ানো যায়, তা চিন্তা করা দরকার। এসব সমস্যার কথা মাথায় রেখে বিকল্প শক্তির উৎস খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এই বিকল্প শক্তির উৎস হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে সূর্য। হ্যাঁ, সূর্যের আলো হতে পারে আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগানদাতা।
এই সূর্যের আলো হচ্ছে এক ধরনের শক্তি এবং আলোর কণাকে বলা হয় ফোটন। এই ফোটনকে সোলার সেলের মাধ্যমে সংগ্রহ করে আলোকশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। আপেক্ষিক অর্থে অফুরন্ত এই আলোকশক্তি পৃথিবীতে আসছে। এই শক্তিকে যদি ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়, তাহলে আমাদের শক্তি উৎপাদনের দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। সোলার সেল হলো এমন একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যা সরাসরি সৌর শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
সিলিকনজাতীয় সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়ালস দিয়ে এসব ফটোভোল্টাইক সেল তৈরি করা হয়। যখন সূর্যের আলো এই সেলের ওপর এসে পড়ে, তখন এসব সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটারিয়াল ফোটন শক্তি শোষণ করে নেয় এবং ইলেকট্রন মুক্ত হয়।
এভাবে অনেক সেল মিলে একটি মডিউল এবং অনেক মডিউল মিলে সোলার প্যানেল তৈরি হয়, যা ব্যাটারির মতো কাজ করে। প্রচলিত ব্যাটারির ক্ষেত্রে ইলেকট্রন উৎপাদন হয় কেমিক্যাল থেকে, যেখানে সোলার সেলের ক্ষেত্রে আলো থেকে ইলেকট্রন উৎপাদন করা হয়। বিদ্যুতের অপ্রতুলতা ও খরচ কমানোর জন্য আবাসিক, ব্যবসায়িকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন- ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, গাড়ি এমনকি কৃষিজমিতে সেচের ক্ষেত্রেও সোলার এনার্জি ব্যবহার করা হচ্ছে।
অনেক দিন ধরে সোলার সেল আবিষ্কার হলেও এর বহুল ব্যবহার ও প্রসারে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এর দক্ষতা বা ইফিসিয়েন্সি। প্রথমদিকে যেসব সোলার সেল ব্যবহার করা হতো, তার দক্ষতা ৩ থেকে ৪ শতাংশেরর বেশি হতো না। এ কারণে তা ব্যবহার করার জন্য অনেক প্যানেল ব্যবহার করতে হতো, তাই ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে যেত। কিন্তু বিগত দুই দশকে ক্যাটালিস্ট হিসেবে ন্যানোম্যাটেরিয়ালস ব্যবহারের ফলে সোলার সেলের দক্ষতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রচলিত সোলার সেলগুলোর দক্ষতা কম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এদের আলোকরশ্মি শোষণ করার ক্ষমতা অনেক কম। উচ্চ শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন ন্যানোকণা কোটিং করে এদের শোষণক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়ানো যায়, ফলে এরা বেশি আলোকশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে। কিছু ন্যানোকণা কোটিংয়ের ফলে আলোকরশ্মির রিফ্লেকশন কমে যায়। আমরা জানি, সেলে রিফ্লেকশন বেশি হলে প্রাপ্ত আলোকশক্তি কমে যায়। তাই এন্টি-রিফ্লেকটিভ ন্যানোকণা কোটিং করে রিফ্লেকশন কমানো তথা ইফিসিয়েন্সি বাড়ানো যায়।
বিগত কয়েক বছরে কোয়ান্টাম ডট ব্যবহার করে সোলার সেলের ইফিসিয়েন্সি বাড়ানো হচ্ছে। কোয়ান্টাম ডট হচ্ছে এমন এক ন্যানোকণা, যার আকার পাঁচ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে। ফলে এক বর্গ সেন্টিমিটারের মধ্যে কয়েক বিলিয়ন কোয়ান্টাম ডট সহজে ধরে যায়, ফলে আলোর শোষণ বেড়ে যায় অর্থাৎ ইফিসিয়েন্সি বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক সময়ের সফলতা হলো ন্যানোপেইন্ট। সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ন্যানোক্রিস্টাল থেকে ন্যানোপেইন্ট আবিষ্কার করেন।
ন্যানোপেইন্টের মধ্যে প্রতিটি ক্রিস্টাল এক-একটি সোলার সেল হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ কোনো বাড়ির বাইরে ন্যানোপেইন্ট দ্বারা রঙ করা হলে এটা সোলার প্যানেল হিসেবে কাজ করবে। এভাবে পাওয়া যাবে অফুরন্ত শক্তি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই ধরনের ন্যানোপেইন্ট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না? আসলে এখন পর্যন্ত গবেষণাগারে যে ধরনের ন্যানোপেইন্ট আবিষ্কার করা হয়েছে। তার অন্যতম উপাদান হচ্ছে ক্যাডমিয়াম, যা একটি টক্সিক উপাদান হওয়ায় ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এখন পর্যন্ত এটি ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তবে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে ক্যাডমিয়ামের বিকল্প ন্যানোক্রিস্টাল আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, যা থেকে ন্যানোপেইন্ট তৈরি করা যায়। তাহলে তা হবে সোলার এনার্জির ক্ষেত্রে একটি বড় মাইলফলক।
এই সোলার এনার্জি ব্যবহারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সূর্যের আলোর অপ্রতুলতা, তথা মেঘলা দিন বা রাতের বেলায়। কী হবে সমাধান? এ জন্য সৌর শক্তিকে সংরক্ষণ করার জন্য ব্যবহার করা হয় ব্যাটারি। ব্যাটারি হচ্ছে সৌরশক্তি বা অন্য যেকোনো ধরনের শক্তিকে সঞ্চিত রাখার একটা বড় উপায়। প্রচলিত ব্যাটারিগুলো বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে ইলেকট্রোলাইট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব ব্যাটারি একবার আয়নাইজড হয়ে গেলে তা রিচার্জড করা যায় না। এর বিকল্প হিসেবে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি আবিষ্কার হলো।
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে গ্রাফাইট ন্যানোসিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতে করে ব্যাটারির স্টোরেজ ক্যাপাসিটি এবং টাইম ডিওরেশন অনেক বেড়ে যায়, যা বর্তমান সময়ে মোবাইল, ঘড়ি, ক্যালকুলেটর এমনকি গাড়িতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাটারির একটি সমস্যা হলো এটি চার্জ নিতে অনেক সময় নেয়। আমরা দেখি, আমাদের মোবাইল চার্জ থেকে ২০/৩০ মিনিট বা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। আবার এসব ব্যাটারি প্রস্তুতের খরচও বেশি। বর্তমান সময়ে শক্তি সঞ্চয়ের বিকল্প হিসেবে ক্যাপাসিটরের ব্যবহার চিন্তা করা হচ্ছে।
আমরা জানি, ক্যাপাসিটরের দুদিকে পরিবাহী লেয়ার আর মাঝখানে ডাই-ইলেকট্রিক লেয়ার থাকে। তাই এরা দুদিকে চার্জ ধরে রাখতে পারে। বর্তমান সময়ে ডাই-ইলেকট্রিক লেয়ারের পরিবর্তে কার্বন ন্যানোসিট ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে সুপার ক্যাপাসিটর এবং এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন কার্বন কণা থাকে, ফলে চার্জ ধারণক্ষমতা অনেক অনেক গুণ বেড়ে যায়। এগুলোর ক্ষমতা লিথিয়াম আয়রন ব্যাটারির চেয়ে অনেক বেশি।
এই সুপার ক্যাপাসিটর চার্জিং হতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেবে, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমরা যদি একটি মোবাইলে বা গাড়িতে সুপার ক্যাপাসিটর ব্যবহার করি, তাহলে পূর্ণ চার্জ হতে ১০ সেকেন্ড সময় নেবে, চিন্তাই করা যায় না। এই সুপার ক্যাপাসিটরের মতো করে বাড়ি তৈরির ইট ডিজাইন করা হচ্ছে। দেখা গেছে, ৫০টি ইট সম্পূর্ণ বাড়ির তড়িৎ শক্তির চাহিদা মেটাতে পারে। তার মানে আমরা যদি এ ধরনের ইট দ্বারা বাড়ি তৈরি করি আর তার বাইরে ন্যানোপেইন্ট করি, তাহলে প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠবে এক-একটি শক্তি ট্যাংক।
ভবিষ্যতে এমনটার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৯৬ ইউনেসকো ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ২০০১ সালে ন্যাশনাল ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ গঠন করে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেমন চীন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ সার্কভুক্ত কয়েকটি দেশে ন্যানোটেকনোলজির সহযোগী গবেষণার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে টেকসই উন্নয়ন করছে। বর্তমানে ন্যানোটেকনোলজির মার্কেটের আকার এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি।
যেহেতু ন্যানোটেকনোলজি একটি ক্রমবর্ধমান খাত, ২০২৬ সাল নাগাদ এর আনুমানিক মূল্য ধরা হয় প্রায় দুই-তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ যদি এই বৈশ্বিক বাজারের ১% ও ধরতে পারে, তা আনুমানিক সম্পূর্ণ জিডিপি এরই প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ হতে পারে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে
ন্যানোটেকনোলজিবিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ইনস্টিটিউশন অব ন্যানোটেকনোলজি স্থাপন শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ন্যানোটেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে দেশের শিক্ষা, গবেষণা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন

প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রতিবছর এখানে শিল্প, বাণিজ্যিক, আবাসিকসহ বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচ হয়। প্রচলিত শক্তির উৎস হিসেবে বর্তমান সময়ে তেল, গ্যাস, কয়লা ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব শক্তির উৎসের বেশিরভাগই একবার ব্যবহার হয়ে গেলে তা আবার আর ব্যবহার করা যায় না।
শক্তির উৎপাদনের চেয়ে দ্রুততর ব্যবহার এবং এর পরিমাণের সীমাবদ্ধতার কারণে তা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ফলে আগামী দিনের শক্তির চাহিদা পূরণে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশেই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা এই শক্তি সংকট। বিশ্বজুড়ে শক্তির চাহিদা ক্রমেই বেড়েই চলছে আর দিন দিন বাড়বে।
শক্তির এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিককে গুরুত্ব দিতে হবে। আর কীভাবে বর্তমান শক্তির অভাব পূরণ করা যাবে ও ভবিষ্যৎ চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কীভাবে তার উৎপাদন বাড়ানো যায়, তা চিন্তা করা দরকার। এসব সমস্যার কথা মাথায় রেখে বিকল্প শক্তির উৎস খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এই বিকল্প শক্তির উৎস হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে সূর্য। হ্যাঁ, সূর্যের আলো হতে পারে আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগানদাতা।
এই সূর্যের আলো হচ্ছে এক ধরনের শক্তি এবং আলোর কণাকে বলা হয় ফোটন। এই ফোটনকে সোলার সেলের মাধ্যমে সংগ্রহ করে আলোকশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। আপেক্ষিক অর্থে অফুরন্ত এই আলোকশক্তি পৃথিবীতে আসছে। এই শক্তিকে যদি ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়, তাহলে আমাদের শক্তি উৎপাদনের দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। সোলার সেল হলো এমন একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যা সরাসরি সৌর শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
সিলিকনজাতীয় সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়ালস দিয়ে এসব ফটোভোল্টাইক সেল তৈরি করা হয়। যখন সূর্যের আলো এই সেলের ওপর এসে পড়ে, তখন এসব সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটারিয়াল ফোটন শক্তি শোষণ করে নেয় এবং ইলেকট্রন মুক্ত হয়।
এভাবে অনেক সেল মিলে একটি মডিউল এবং অনেক মডিউল মিলে সোলার প্যানেল তৈরি হয়, যা ব্যাটারির মতো কাজ করে। প্রচলিত ব্যাটারির ক্ষেত্রে ইলেকট্রন উৎপাদন হয় কেমিক্যাল থেকে, যেখানে সোলার সেলের ক্ষেত্রে আলো থেকে ইলেকট্রন উৎপাদন করা হয়। বিদ্যুতের অপ্রতুলতা ও খরচ কমানোর জন্য আবাসিক, ব্যবসায়িকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন- ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, গাড়ি এমনকি কৃষিজমিতে সেচের ক্ষেত্রেও সোলার এনার্জি ব্যবহার করা হচ্ছে।
অনেক দিন ধরে সোলার সেল আবিষ্কার হলেও এর বহুল ব্যবহার ও প্রসারে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এর দক্ষতা বা ইফিসিয়েন্সি। প্রথমদিকে যেসব সোলার সেল ব্যবহার করা হতো, তার দক্ষতা ৩ থেকে ৪ শতাংশেরর বেশি হতো না। এ কারণে তা ব্যবহার করার জন্য অনেক প্যানেল ব্যবহার করতে হতো, তাই ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে যেত। কিন্তু বিগত দুই দশকে ক্যাটালিস্ট হিসেবে ন্যানোম্যাটেরিয়ালস ব্যবহারের ফলে সোলার সেলের দক্ষতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রচলিত সোলার সেলগুলোর দক্ষতা কম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এদের আলোকরশ্মি শোষণ করার ক্ষমতা অনেক কম। উচ্চ শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন ন্যানোকণা কোটিং করে এদের শোষণক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়ানো যায়, ফলে এরা বেশি আলোকশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে। কিছু ন্যানোকণা কোটিংয়ের ফলে আলোকরশ্মির রিফ্লেকশন কমে যায়। আমরা জানি, সেলে রিফ্লেকশন বেশি হলে প্রাপ্ত আলোকশক্তি কমে যায়। তাই এন্টি-রিফ্লেকটিভ ন্যানোকণা কোটিং করে রিফ্লেকশন কমানো তথা ইফিসিয়েন্সি বাড়ানো যায়।
বিগত কয়েক বছরে কোয়ান্টাম ডট ব্যবহার করে সোলার সেলের ইফিসিয়েন্সি বাড়ানো হচ্ছে। কোয়ান্টাম ডট হচ্ছে এমন এক ন্যানোকণা, যার আকার পাঁচ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে। ফলে এক বর্গ সেন্টিমিটারের মধ্যে কয়েক বিলিয়ন কোয়ান্টাম ডট সহজে ধরে যায়, ফলে আলোর শোষণ বেড়ে যায় অর্থাৎ ইফিসিয়েন্সি বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক সময়ের সফলতা হলো ন্যানোপেইন্ট। সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ন্যানোক্রিস্টাল থেকে ন্যানোপেইন্ট আবিষ্কার করেন।
ন্যানোপেইন্টের মধ্যে প্রতিটি ক্রিস্টাল এক-একটি সোলার সেল হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ কোনো বাড়ির বাইরে ন্যানোপেইন্ট দ্বারা রঙ করা হলে এটা সোলার প্যানেল হিসেবে কাজ করবে। এভাবে পাওয়া যাবে অফুরন্ত শক্তি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই ধরনের ন্যানোপেইন্ট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না? আসলে এখন পর্যন্ত গবেষণাগারে যে ধরনের ন্যানোপেইন্ট আবিষ্কার করা হয়েছে। তার অন্যতম উপাদান হচ্ছে ক্যাডমিয়াম, যা একটি টক্সিক উপাদান হওয়ায় ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এখন পর্যন্ত এটি ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তবে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে ক্যাডমিয়ামের বিকল্প ন্যানোক্রিস্টাল আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, যা থেকে ন্যানোপেইন্ট তৈরি করা যায়। তাহলে তা হবে সোলার এনার্জির ক্ষেত্রে একটি বড় মাইলফলক।
এই সোলার এনার্জি ব্যবহারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সূর্যের আলোর অপ্রতুলতা, তথা মেঘলা দিন বা রাতের বেলায়। কী হবে সমাধান? এ জন্য সৌর শক্তিকে সংরক্ষণ করার জন্য ব্যবহার করা হয় ব্যাটারি। ব্যাটারি হচ্ছে সৌরশক্তি বা অন্য যেকোনো ধরনের শক্তিকে সঞ্চিত রাখার একটা বড় উপায়। প্রচলিত ব্যাটারিগুলো বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে ইলেকট্রোলাইট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব ব্যাটারি একবার আয়নাইজড হয়ে গেলে তা রিচার্জড করা যায় না। এর বিকল্প হিসেবে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি আবিষ্কার হলো।
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে গ্রাফাইট ন্যানোসিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতে করে ব্যাটারির স্টোরেজ ক্যাপাসিটি এবং টাইম ডিওরেশন অনেক বেড়ে যায়, যা বর্তমান সময়ে মোবাইল, ঘড়ি, ক্যালকুলেটর এমনকি গাড়িতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাটারির একটি সমস্যা হলো এটি চার্জ নিতে অনেক সময় নেয়। আমরা দেখি, আমাদের মোবাইল চার্জ থেকে ২০/৩০ মিনিট বা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। আবার এসব ব্যাটারি প্রস্তুতের খরচও বেশি। বর্তমান সময়ে শক্তি সঞ্চয়ের বিকল্প হিসেবে ক্যাপাসিটরের ব্যবহার চিন্তা করা হচ্ছে।
আমরা জানি, ক্যাপাসিটরের দুদিকে পরিবাহী লেয়ার আর মাঝখানে ডাই-ইলেকট্রিক লেয়ার থাকে। তাই এরা দুদিকে চার্জ ধরে রাখতে পারে। বর্তমান সময়ে ডাই-ইলেকট্রিক লেয়ারের পরিবর্তে কার্বন ন্যানোসিট ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে সুপার ক্যাপাসিটর এবং এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন কার্বন কণা থাকে, ফলে চার্জ ধারণক্ষমতা অনেক অনেক গুণ বেড়ে যায়। এগুলোর ক্ষমতা লিথিয়াম আয়রন ব্যাটারির চেয়ে অনেক বেশি।
এই সুপার ক্যাপাসিটর চার্জিং হতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেবে, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমরা যদি একটি মোবাইলে বা গাড়িতে সুপার ক্যাপাসিটর ব্যবহার করি, তাহলে পূর্ণ চার্জ হতে ১০ সেকেন্ড সময় নেবে, চিন্তাই করা যায় না। এই সুপার ক্যাপাসিটরের মতো করে বাড়ি তৈরির ইট ডিজাইন করা হচ্ছে। দেখা গেছে, ৫০টি ইট সম্পূর্ণ বাড়ির তড়িৎ শক্তির চাহিদা মেটাতে পারে। তার মানে আমরা যদি এ ধরনের ইট দ্বারা বাড়ি তৈরি করি আর তার বাইরে ন্যানোপেইন্ট করি, তাহলে প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠবে এক-একটি শক্তি ট্যাংক।
ভবিষ্যতে এমনটার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৯৬ ইউনেসকো ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ২০০১ সালে ন্যাশনাল ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ গঠন করে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেমন চীন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ সার্কভুক্ত কয়েকটি দেশে ন্যানোটেকনোলজির সহযোগী গবেষণার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে টেকসই উন্নয়ন করছে। বর্তমানে ন্যানোটেকনোলজির মার্কেটের আকার এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি।
যেহেতু ন্যানোটেকনোলজি একটি ক্রমবর্ধমান খাত, ২০২৬ সাল নাগাদ এর আনুমানিক মূল্য ধরা হয় প্রায় দুই-তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ যদি এই বৈশ্বিক বাজারের ১% ও ধরতে পারে, তা আনুমানিক সম্পূর্ণ জিডিপি এরই প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ হতে পারে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে
ন্যানোটেকনোলজিবিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ইনস্টিটিউশন অব ন্যানোটেকনোলজি স্থাপন শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ন্যানোটেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে দেশের শিক্ষা, গবেষণা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন

এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৮ ঘণ্টা আগে
‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৮ ঘণ্টা আগে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৮ ঘণ্টা আগে
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে