দক্ষিণ এশিয়ায় সরকারি চাকরির সামরিকীকরণ

গোলাম সোহরাওয়ার্দী
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ৫৬

সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের বেসামরিক চাকরিতে কাঙ্ক্ষিত পদ পাওয়া উচিত কি না—এই প্রশ্নটি বেশ জটিল। বহু দৃষ্টিভঙ্গি এখানে উঠে আসবে। প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ভালো মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে। অন্যরা মেধা আর কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তিত।

বিজ্ঞাপন

অনেকেই মনে করেন, প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের চাকরিতে সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সামরিক সেবাকে সম্মান জানানো হয়। দেশের জন্য তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেন, এর মাধ্যমে তার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সামরিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সুবিধা দিলে অর্থনৈতিক পেনাল্টি এড়ানো যায়। সেনারা সময় দেন সামরিক বাহিনীতে। তারা বেসামরিক ক্যারিয়ার তৈরির জন্য কাজ করেন না। সামরিক কর্মকর্তারা কিছু দরকারি দক্ষতা অর্জন করেন। এর মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়া এবং কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়টি অন্যতম। তারা একই সঙ্গে টিমওয়ার্ক এবং দায়বদ্ধতার সংস্কৃতিও নিয়ে আসেন। এই দক্ষতাগুলো বেসামরিক গ্রুপগুলোকে সাহায্য করে। সামরিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা শৃঙ্খলা ও শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে আসতে পারেন। লক্ষ্যের প্রতি তারা দায়বদ্ধ থাকেন।

প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের বিপক্ষের যত যুক্তি

সামরিক সংস্কৃতিতে পদের স্তরবিন্যাস থাকে। কমান্ডের মাধ্যমে সেটি কাজ করে। অন্যদিকে, বেসামরিক কর্মক্ষেত্রে সাধারণত সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ হয়। এ কাজের প্রক্রিয়ায় বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থা থাকতে পারে। এতে একটা সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। সামরিক কর্মকর্তারা অতিরিক্ত কঠোর বা কমান্ডিং হতে পারেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধীর প্রক্রিয়ায় তারা ধৈর্য হারাতে পারেন। বেসামরিক কর্মীদের কাজ তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। তারা মনে করতে পারেন, দক্ষ বেসামরিক ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ সামরিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে কাজে নেওয়া হয়েছে।

সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেসামরিক সংস্কৃতিতে তেমন মানিয়ে নিতে পারেন না। এতে পুরো টিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা কর্তৃত্বমুখী ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। নামের প্রথমাংশ ধরে ডাকলেও তাদের অনেকে সেটা পছন্দ করেন না।

এই বিতর্কে উত্তেজনা আছে। এখানে যোগ্যতার চেয়ে সেবাকে বড় করে দেখা হচ্ছে। সরকার যখন বাছাই করে, তখন আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজে সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের বেছে নেওয়া হয়। নিরাপত্তার সঙ্গে তাদের যোগ্যতা মানানসই। ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে সামরিক দক্ষতাকে কাজে লাগানো যায়। এটি বেসামরিক চাকরিদাতা বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য সহায়ক হয়। তবে ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ এতে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাঠামো নষ্ট হতে পারে। বরং সাবেক সামরিক সদস্যদের দক্ষতার ভিত্তিতে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা উচিত। এতেও তাদের প্রতি সম্মান জানানো হয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় কী ঘটছে

দক্ষিণ এশিয়ায় সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থা বেশ শক্তিশালী। যুদ্ধ বা সামরিক শাসনের পরও এই শক্তিটি টিকে থাকে। এই প্রভাবটা সবসময় অভ্যুত্থান বা ট্যাংকের মাধ্যমে আসে না। বরং প্রভাবটা আসে বেসামরিক চাকরিতে তাদের অবস্থানের মাধ্যমে। বন্দর, হাসপাতাল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন পদে তারা এসব চাকরি করছেন।

এই চাকরিগুলো বেসামরিক বিশেষজ্ঞদের পাওয়া উচিত। কিন্তু এগুলো প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে নেপাল পর্যন্ত অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা এসব খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বন্দরের একজন চেয়ারম্যানের যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার দরকার নেই। হাসপাতালের ডিরেক্টর আর যুদ্ধের কমান্ডারের কাজ এক ধরনের নয়। এই ধারায় বেসামরিক-সামরিক খাতের মধ্যে ভারসাম্যের ঘাটতিটা বোঝা যায়। অথচ এই ভারসাম্য দিয়েই সুশাসন সংজ্ঞায়িত করা হয়।

সুশাসনের ছদ্মবেশে পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা

এ ধরনের নিয়োগ হলো রাজনৈতিক উপহার। এগুলো পেশাদার নিয়োগ নয়। সরকার চাপে থাকে। জোটের কারণে বা অস্থিরতা থেকে এই চাপ আসে। সামরিক বাহিনীকে তুষ্ট করতে হয় তাদের। সাবেক কর্মকর্তাদের ভালো ভালো চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিনিময়ে সামরিক বাহিনী স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। অথবা রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে দূরে থাকে। এই ইস্যুটা খুবই স্পষ্ট। এই ব্যবস্থার কারণে বেসামরিক পদগুলোর ক্ষতি হচ্ছে। জাহাজ পরিবহন কর্তৃপক্ষের দরকার বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ। তাদের লজিস্টিকসের জ্ঞান দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে থাকা উচিত শীর্ষপর্যায়ের একাডেমিকের। হাসপাতালের প্রধানের অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবার দক্ষতা থাকা দরকার। এই পদগুলো উর্দিপরা মানুষে ভরে গেলে এই খাতগুলো স্থবির হয়ে পড়ে।

বেসামরিক ক্যাডারকে আটকে দেওয়া

সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে বেসামরিক মানুষের। আমলাতন্ত্রের মধ্যে মেধাবী জনবল রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য তারা বহু দশক ধরে কাজ করেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মেধার ভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি হয়। বিশেষায়িত বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ থাকে।

কিন্তু শীর্ষপর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান। এতে কর্মীদের মনোবল ভেঙে যায়। নতুনরা এই চাকরিতে আসার আগ্রহ হারান। তারা ভাবেন, এই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জন করে কী লাভ? শীর্ষ পদগুলো অন্যরা নিয়ে নেন। হতাশা বাড়তে থাকে তাদের মধ্যে। তাদের ক্যারিয়ার থমকে যায়। মেধাবীরা দেশ ছেড়ে বিদেশি পাড়ি জমান।

অভ্যাস থেকে সংস্কৃতি বদলায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কমান্ড স্টাইলের প্রয়োগ হচ্ছে। তারা একাডেমিক স্বাধীনতা হারাচ্ছে। বন্দরগুলোয় কঠোর নিয়মের প্রয়োগ হচ্ছে। সেখানে বাণিজ্যিক নমনীয়তা দরকার। হাসপাতালে শৃঙ্খলার বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের সেবা সেখানে গৌণ হয়ে পড়ছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভেদরেখাগুলো ক্ষীণ হয়ে আসে। সামরিক ও বেসামরিকরা মিলেমিশে যায়। এতে আবার গণতন্ত্রের ক্ষতি হয়। সশস্ত্র বাহিনীকে তখন ক্ষমতাসীন শ্রেণি মনে হয়। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাণিজ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদে চলে যায়।

অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হচ্ছেন, হাসপাতালের পরিচালক হচ্ছেন। কেউ কেউ রাষ্ট্রদূতও হয়েছেন। হয়েছেন সামরিক অ্যাটাশে। অথচ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাস করে যারা কাজে ঢুকেছেন, শীর্ষ পদগুলো তাদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে।

পাকিস্তান : প্রাতিষ্ঠানিক সামরিক অর্থনীতি

পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর শিকড় অনেক গভীর। সামরিক বাহিনী সেখানে বড় বড় প্রতিষ্ঠান চালায়। সেগুলোর শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে। এটি করা হয় ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। ২০১৮ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের সিইও ছিলেন এয়ার মার্শাল আরশাদ মালিক। চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিলেন লে. জেনারেল (অব.) আসিম সেলিম বাজওয়া। করাচির মতো বন্দরের পরিচালনাতেও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা কাজ করছেন।

এই নিয়োগগুলো সামরিক বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করেছে। বেসামরিক চাকরি চরমসীমায় চলে গেছে। এয়ারলাইনসের মতো এন্টারপ্রাইজগুলো ভুগছে। সেখানে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। জনগণ শুধু কঠোর আইনকানুন দেখতে পাচ্ছে, কোনো দক্ষতার দেখা পাচ্ছে না তারা।

শ্রীলঙ্কা : গৃহযুদ্ধ থেকে বেসামরিক জবরদখল

শ্রীলঙ্কার যুদ্ধ তিন বছর জারি ছিল। সামরিক বাহিনী সেখানে অন্যতম খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিল। ২০০৯ সালের পর সরকার তাদের পুরস্কার দিয়েছে। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কা পোর্টস অথরিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন জেনারেল দায়া রত্নায়েক। ২০২০ সালে পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন অ্যাডমিরাল জয়নাথ কোলোমবেইজ। নর্দার্ন প্রভিন্সের গভর্নর ছিলেন মেজর জেনারেল জি এ চন্দ্রসিড়ি। পরে তিনি এয়ারপোর্ট অ্যান্ড অ্যাভিয়েশন সার্ভিসের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।

পর্যটন, শহর উন্নয়ন এবং শিক্ষা খাতেও সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা কাজ করছেন। সিভিল সার্ভেন্টরা জানিয়েছেন পক্ষপাতিত্বের কারণে মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে না।

নেপাল : শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নীরব সম্প্রসারণ

নেপালের সামরিক বাহিনী তুলনামূলক কম আধিপত্য বিস্তার করেছে। তবে রাজতন্ত্রের পর তাদের প্রভাব বেড়েছে। সাবেক জেনারেলদের অনেকে রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। বিভিন্ন বোর্ডে তারা চেয়ারম্যান হয়েছেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতে রাজনীতিকীকরণ হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সেনাবাহিনী বলছে, তারা জাতিকে সেবা দিচ্ছে।

ভারত : সূক্ষ্ম উপস্থিতি বাড়ছে

২০১৭ সালে আন্দামান ও নিকোবরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন অ্যাডমিরাল ডি কে যোশি। অরুণাচল প্রদেশের গভর্নর ছিলেন জেনারেল জে জে সিং। একইভাবে দায়িত্ব পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নির্ভয় শর্মা। এই নিয়োগগুলো বিরল। কিন্তু এগুলো নিয়ে উদ্বেগ জন্মেছে। সরকারি ব্যবস্থা থেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়—সবখানেই বেসামরিক জনবলের ভয় বাড়ছে।

মালদ্বীপ আর ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো

মালদ্বীপে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তারা সেখানে বিমানবন্দর, জাহাজ পরিবহন, পর্যটন নিরাপত্তা দেখাশোনা করছে। ছোট সিস্টেমের মধ্যে হাতে গোনা এই পদগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য সুযোগ সীমিত করে দিয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি

এ ধরনের নিয়োগের বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। এতে পেশাদারিত্বের ক্ষতি হয়। বিশেষজ্ঞ না থাকলে বিভিন্ন গ্রুপ ধসে পড়বে। বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকের নেতৃত্বের দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু তাদের সুরক্ষা বা নিরাপত্তা খাতে কাজে লাগানো দরকার। বন্দর বা হাসপাতালের মতো বেসামরিক কর্মক্ষেত্রে নয়। প্রতিযোগিতার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার মেধা লাগবে। বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উদ্ভাবন—সব খাতেই মেধাবী জনবল প্রয়োজন। দক্ষতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব গড়তে বেসামরিক জনবলকে শক্তি জোগাতে হবে। সশস্ত্র বাহিনী অবশ্যই শ্রদ্ধার দাবিদার। কিন্তু ভারসাম্য রক্ষার দিকে অবশ্যই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাউথ এশিয়া জার্নালের প্রকাশক

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত