শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, আর শহীদ ওসমান হাদি হয়ে গেলেন স্বাধীনতা রক্ষার প্রতীক। জিয়াউর রহমান শহীদ হয়েছিলেন মাত্র ৪৫ বছর বয়সে। আর ওসমান হাদি শহীদ হলেন মাত্র ৩২ বছর বয়সে। এ রকম ক্ষণজন্মা মহাপুরুষরাই জীবন উৎসর্গ করে একটি দেশ ও জাতিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে থাকেন। যুগে যুগে এ ধরনের বিপ্লবী মহাপুরুষদের আবির্ভাব না ঘটলে হয়তো এই পৃথিবী চিরকাল অত্যাচারী শাসকদের অধীনেই নিষ্পেষিত হতো।
এটা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও শহীদ উসমান হাদির মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার বিষয় নয়। পৃথিবীর ইতিহাসজুড়ে কীভাবে বিপ্লবীরা আত্মদানের মাধ্যমে সমাজকে বদলে দিয়েছেন, কিংবা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সে কথা বলাই আমাদের লক্ষ্য। যেমন কমিউনিস্ট বিপ্লবী চে গুয়েভারা বলিভিয়ার জঙ্গলে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন মাত্র ৩৯ বছর বয়সে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই বিপ্লবী নেতা একজন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট হলেও তিনি সব ধরনের নীতি ও আদর্শের মানুষের কাছে মহান বিপ্লবী হিসেবে বেঁচে আছেন এখনো। তাই তো বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চে গুয়েভারাকে নিয়ে লেখা তার বিখ্যাত কবিতার প্রথম লাইনটি মনে পড়ে যায় অবলীলায়—‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’ সুনীলের এই লাইনটির চেতনা ধারণ করে যদি আমরা বলি, ‘হাদি, তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দিয়েছে।’
চে গুয়েভারা একাধারে একজন আরজেন্টেনীয় মার্কসবাদী বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, গেরিলা নেতা, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ ও মিলিটারি তাত্ত্বিক হিসেবে বিশ্বে খ্যাতিমান। এভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বিপ্লবীর আত্মদান প্রত্যেক জাতির জন্য অনুকরণীয় হয়ে আছে। চে গুয়েভারা বলতেন, ‘হাঁটু গেড়ে বসে থাকার চেয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করা অনেক ভালো।’ আমাদের আলোচিত ওসমান হাদি তা-ই করেছেন। তিনি হাঁটু গেড়ে নত না হয়ে দাঁড়িয়ে জীবন দিয়েছেন। এ এক অসামান্য আত্মদানের ইতিহাস, যা আগামী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তরুণদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ। আর এই তরুণরাই ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অগ্রসৈনিক ছিলেন। এই তরুণেরাই ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। এই তরুণেরাই জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে। আর এই জুলাই বিপ্লবের সম্মুখ সারির বিপ্লবী ছিলেন শরীফ ওসমান হাদি। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য টিপু সুলতান যেমন করে সম্মুখে থেকে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে ওসমান হাদি জীবনের প্রতি হুমকি থাকা সত্ত্বেও সম্মুখে থেকেই দেশের জন্য রাজনৈতিক লড়াই করতে করতে জীবন দিয়ে গেছেন।
ওসমান হাদি বহুবার হত্যার হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাননি, বরং অসীম সাহস নিয়ে একা একা চলেছেন এক লোকালয় থেকে আরেক লোকালয়ে। মৃত্যুকে জয় করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি মাঠে নেমেছিলেন। সেটা প্রতিফলিত হয় গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত তার এক ভাষণের মাধ্যমে। সেই ভাষণে ওসমান হাদি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর ফয়সালা জমিনে না, আসমানে হয়। আমি চলে গেলে আমার সন্তান লড়বে, তার সন্তান লড়বে। যুগ থেকে যুগান্তরে আজাদির সন্তানেরা স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রাখবেই। মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।’
এটা যেন ‘বোকা বুড়োর পাহাড় সরানো’ নামক বিখ্যাত চীনা লোককথার মতো। এই লোককথাটা এরকম—“এক বৃদ্ধ তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল দুটি পাহাড় সরানোর জন্য হাতুড়ি নিয়ে কাজ শুরু করল। এই পাহাড়ের কারণে তাকে অনেক পথ ঘুরে চলাচল করতে হতো। তাই সে এই পাহাড়ের মাটি ও পাথর সাগরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। এটা দেখে কিছু লোক তাকে বিদ্রুপ করতে শুরু করল। একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি বৃদ্ধ হয়ে গেছ, তুমি কীভাবে এত বড় পাহাড় সরিয়ে রাস্তা করবে?’ তখন বৃদ্ধ উত্তরে বলল, ‘আমি না পারলে আমার ছেলে পারবে, সে না পারলে তার ছেলে পারবে। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটা চলবে। অন্যদিকে পাহাড় তো আর বৃদ্ধি পাবে না, তাই একদিন না একদিন পাহাড় অপসারিত হয়ে যাবে।’ বৃদ্ধের এই অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায় দেখ চীনা লোককথার দেবতারা খুশি হয়ে সেই পাহাড় সরিয়ে দিয়ে রাস্তা করে দেয়।”
এই গল্পটি চীনের মানুষের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে হাজার বছর ধরে, ঠিক যেভাবে ওসমান হাদি অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের জীবন উৎসর্গ করে আগামী প্রজন্মের জন্য নিজেকে প্রেরণাদায়ক করে গেছেন। এখন সারা পৃথিবীর তরুণেরা ওসমান হাদিকে প্রেরণার উৎস হিসেবে দেখবে।
অন্যদিকে যারা কাপুরুষের মতো হাদিকে হত্যা করে জুলাই বিপ্লবের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে, কিংবা যারা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ভারতসহ যেকোনো আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এদেশের জনগণের প্রতিরোধের স্পৃহাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে, তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে গেছে। কারণ শক্তি প্রয়োগ করে কোনো রাষ্ট্র বা জাতিকে পদানত করার চেষ্টা বারবারই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি এভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এটি করতে গিয়ে কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানসহ অনেক স্থানে ব্যর্থ হয়েছে।
এ ব্যাপারে ইসরাইলের দিকে তাকিয়ে দেখুন। এই দেশটি বারবার একেকজন নেতাকে হত্যা করে বড় ধরনের সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু এসব চেষ্টা বারবার বিপরীত ফলাফল বয়ে এনেছে। যেমন ইসরাইল ২০০৪ সালে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমদ ইয়াসিনকে হত্যা করে মনে করেছিল, ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘটল বিপরীত ফলাফল। কারণ তখন ফিলিস্তিনের জনগণ ইসরাইলের অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে ইটপাথর দিয়ে লড়াই করত, কিন্তু আহমদ ইয়াসিনকে হত্যার পর সেখানকার মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্মায়, তা হামাসকে আরো শক্তিশালী করার পথ প্রশস্ত করে দেয়। আর পরবর্তী সময়ে হামাস হয়ে ওঠে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এক শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন। সাম্প্রতিক সময়ে তার প্রমাণ হামাস যোদ্ধারা দিয়েছে।
ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশে তরুণ বিপ্লবী নেতা ওসমান হাদিকে হত্যা করার পর তরুণসমাজসহ দেশের আপামর জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তা ছিল অভাবিত। শুধু তা-ই নয়, লাখ লাখ মানুষ হাদির জানাজায় অংশ নিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে, এদেশের মানুষ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত। অনেকটা বিপ্লবী কবি সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনটির মতো—‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’
ওসমান হাদির এই বিশাল জানাজা আমাদের আরেকটি জানাজার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, সেটা হচ্ছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজা। আমি হাদির জানাজায় উপস্থিত না হলেও টেলিভিশনের পর্দায় দেখে মনে হয়েছে, ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের জানাজা আরো বড় ছিল। আমি সে জানাজায় উপস্থিত ছিলাম। দাঁড়িয়েছিলাম ফার্মগেটে। এই মহান নেতা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভিত্তি রচনা করে তরুণদের জাগ্রত করে তুলেছিলেন। ফলে এভাবে তার মৃত্যু জনগণের মধ্যে বিরাট শোক ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল, যা বিশাল জানাজার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এখন যেমনটা হাদির জানাজায় হয়েছে।
এই পটভূমিতে ভারতের নীতিনির্ধারকরা যদি ইসরাইলের পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশে আগ্রাসন প্রতিরোধকারীদের গুপ্তঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করতে চায়, তাহলে সেটার ফলাফল হবে সম্পূর্ণ বিপরীত, যা ওসমান হাদির হত্যার পর জনগণের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত হয়েছে। একজন হাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লাখ লাখ হাদি জেগে উঠেছেন। এটা জুলাই বিপ্লবের সেই ঘটনার মতো, যেখানে একজন পুলিশ অফিসার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল আহমদকে বলছিলেন, ‘একজনকে মারলে, আরেকজন সেখানে এসে দাঁড়িয়ে যায়।’ বাংলাদেশে এখন সেই অদম্য সাহসী যুবকের সংখ্যা লাখ লাখ। সুতরাং ভারতকে তার পুরোনো পথ ছেড়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারস্পরিক মর্যাদাপূর্ণ সহযোগিতার পথে এগিয়ে আসা ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই। কোনো দল বা ব্যক্তি নয়, জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়াই হতে পারে এই সময়কার সবচেয়ে সফল কূটনীতি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

