আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস : অধিকার, দায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

ড. সোহেল মিয়া
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৫, ০৯: ০৮

পহেলা মে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও অধিকার আদায়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেট’ ট্র্যাজেডি থেকে দিনটির সূচনা। ওইদিন হাজার হাজার শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নেন। ৪ মে এই আন্দোলনের চতুর্থ দিনে হে মার্কেট স্কয়ারে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে, যেখানে বোমা বিস্ফোরণ, গুলিবর্ষণ ও পুলিশের হামলায় বহু শ্রমিক প্রাণ হারান। এ ঘটনার পর আন্দোলনের নেতাদের একাংশকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যা পরে ইতিহাসে দমন-পীড়নের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশে শ্রমিকদের অধিকার, সংগ্রাম ও ন্যায্যতার প্রতীক হিসেবে পালিত হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন নানা চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সরকারি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা হলেও শ্রমিকরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ১৯৭০ সালে শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি, রেশন এবং বেতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে শ্রমিকদের অধিকারের জন্য আইন প্রণয়ন করা হলেও তা কার্যকর হয়নি।

বিজ্ঞাপন

১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষ বিভিন্ন খাতে কর্মরত, বিশেষ করে পোশাকশিল্পে নারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজও শ্রমিকরা তাদের অধিকার, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, যা প্রমাণ করে, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম কখনো থেমে থাকে না।

শ্রম অধিকার শুধু কিছু আইনগত ধারা বা নীতিমালার নাম নয়, এটি একটি দেশের মানবিক বিবেক, সামাজিক ন্যায়বিচার ও টেকসই উন্নয়নের প্রেরণাসূত্র। শ্রমিকরা যখন সম্মানজনক মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা এবং সংগঠনের স্বাধীনতা ভোগ করেন, তখন তারা শুধু উৎপাদনে অংশ নেন না, বরং নতুন উদ্যম ও আস্থায় আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এই অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা শ্রমিকের মর্যাদা ও মানবিক জীবনের ভিত্তি।

তবে আধুনিক সময়ের বাস্তবতায় শ্রমিকদের চাহিদা আরো প্রসারিত হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি শিক্ষার সুযোগ, কাজ-জীবনের ভারসাম্য এবং পরিবেশবান্ধব কর্মপরিবেশ এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং মৌলিক চাহিদা। শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা মানে শুধু তাদের কল্যাণ নয়, এটি শিল্পের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সামাজিক স্থিতি এবং একটি মানবিক, উন্নত রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। শ্রমিকের অধিকার রক্ষা নয়, বরং তা উদযাপনই হওয়া উচিত আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার।

অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তবে এসব আইনের বাস্তবায়নে এখনো বহু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। শ্রম পরিদর্শক ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার জনবল ও দক্ষতার ঘাটতি প্রকট। অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনাগ্রহ এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের ফলে প্রকৃত বিচার নিশ্চিত হয় না। ফলে শ্রমিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন এবং আইন প্রয়োগ কার্যকরভাবে হয় না।

অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিক শ্রমিকদের অধিকার রক্ষাকে ব্যয়বহুল ও উৎপাদনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেন। ফলে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, ন্যায্য মজুরি প্রদান বা শ্রমঘণ্টা সীমিত রাখার চেয়ে তারা উৎপাদন বাড়ানোকে প্রাধান্য দেন। এর ফলে শ্রমিকদের ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়, যা তাদের কর্মক্ষমতা ও জীবনমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

শ্রমিকরা অনেক সময় নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। শ্রম আইন ও বিধিমালার জটিলতা, শিক্ষার অভাব এবং আইনি সহায়তা পাওয়ার সীমিত সুযোগ তাদের আরো অসহায় করে তোলে। অধিকাংশ শ্রমিক ভয়ের মধ্যে কাজ করেন, কারণ তারা মনে করেন, অভিযোগ করলে চাকরি হারাতে হতে পারে। এই পরিস্থিতি শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে শ্রমবাজারে দ্রুত পরিবর্তন আসছে। অটোমেশন, রোবোটিকস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে কিছু কাজ বিলুপ্ত হচ্ছে, আবার নতুন দক্ষতার প্রয়োজন বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন এবং মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ এখন জরুরি। রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষের যৌথ দায়িত্ব এ পরিবর্তনের সঙ্গে শ্রমিকদের মানিয়ে নিতে সহায়তা করা।

এ ছাড়া নারীশ্রমিকদের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন খাতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও মাতৃত্বকালীন ছুটি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চিত নয়। এ জন্য প্রয়োজন পৃথক নীতিমালা, শিশু কেয়ার সুবিধা এবং নারী নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়নের বিকাশ, যাতে নারীরা নিরাপদ ও সম্মানজনক কর্মপরিবেশে কাজ করতে পারেন।

শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন এবং শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, শ্রম পরিদর্শন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন সঠিকভাবে পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ করা যায়। একই সঙ্গে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা জরুরি, যাতে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন। মালিকপক্ষের মধ্যেও মানবিক নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে তারা শুধু মুনাফা নয়, শ্রমিকদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব পালনের সক্ষমতাও অর্জন করেন।

এ ছাড়া শ্রমবিরোধে সহনশীলতা এবং দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করতে শিল্প-পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা বাড়ানো প্রয়োজন। আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শ্রমিকদের জন্য একটি সুরক্ষিত ও ন্যায্য পরিবেশ তৈরি হয়। পাশাপাশি, ‘Alternative Dispute Resolution (ADR)’ পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমিক-মালিক-সরকারের মধ্যে সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা যেতে পারে, যা শ্রমবাজারে স্থিতিশীলতা আনে।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস শুধু অতীত স্মরণ নয়; এটি ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনার দিন। এ দিনটি হোক শ্রমিকদের অধিকারের সম্মান, তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন ও শ্রম-শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের অঙ্গীকারের দিন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, দক্ষতা উন্নয়ন ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। ১ মে উপলক্ষে এই প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত-শ্রমিকদের অধিকার শুধু দাবি নয়, এটি তাদের প্রাপ্য।

লেখক : শ্রম সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত