আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষা কতটা গুরুত্ব পাবে?

অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমান

নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষা কতটা গুরুত্ব পাবে?

অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে শিক্ষা নিয়ে যতটা সংস্কার, পরিবর্তন ও উন্নয়ন আশা করা হয়েছিল, বাস্তবে ততটা হয়নি। শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন মহল থেকে একটি কমিশন গঠনের জোরালো দাবি উঠলেও শেষ পর্যন্ত সে উদ্যোগও আর নেওয়া হয়নি। বিষয়টি আরো হতাশাজনক এই কারণে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন অধ্যাপক ও নোবেলবিজয়ী, আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাও একজন প্রথিতযশা অধ্যাপক ও শিক্ষা গবেষক। ফলে শিক্ষা খাতের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও উন্নয়ন নিয়ে জনমনে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো—ব্যাপক প্রয়োজনীয়তার মুখেও শিক্ষা খাতের সংস্কার ও বিদ্যমান বহুমাত্রিক সংকট নিরসনে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এর ফলে শিক্ষা খাত আবারও সেই চিরচেনা অনিশ্চয়তা ও স্থবিরতার মধ্যেই পড়ে রয়েছে। অথচ বহুল প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে অন্তত একটি শিক্ষা কমিশন গঠন না হওয়ায় শিক্ষাঙ্গনে এক ধরনের গভীর হতাশা বিরাজ করছে।

এরই মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনেও নতুন করে উত্তাপ দেখা দিয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা জনসমক্ষে তুলে ধরতে তাদের নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশ করবে। কিন্তু যে বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিয়েছে সেটি হলো—রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষা কতটা গুরুত্ব পাবে? এ দেশে বহু বছর ধরে শিক্ষা খাতে নানামুখী অস্থিরতা ও বঞ্চনা, বেকারত্ব, নিয়োগবৈষম্য, দুর্নীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থায় সিদ্ধান্তহীনতা চলে আসছে। কার্যত এসব নিরসনের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন হতে দেখা গেছে, তার প্রেক্ষাপটে এই আলোচনা আরো প্রাসঙ্গিক।

বিজ্ঞাপন

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ বহুমাত্রিক সংকটে নিমজ্জিত। এসব সমস্যা এক দিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতাই আজ শিক্ষা খাতে নানা ধরনের সংকটের সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা খাতে যেসব সংকট বা সমস্যা লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো—১. মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে বারবার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন, কিন্তু বাস্তবায়নে দেখা যায় বিশৃঙ্খলা; ২. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন ও মর্যাদার ঘাটতি; ৩. বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ও রাজনৈতিক প্রভাব; ৪. বেসরকারি শিক্ষার নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার; ৫. উপেক্ষিত ও প্রায় বিনিয়োগহীন শিক্ষা গবেষণা খাত; ৬. পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় জমজমাট কোচিং ব্যবসা। এসব সংকট উপেক্ষা করে একটি মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা কিছুতেই সম্ভব নয়। শিক্ষা খাতে বিদ্যমান সংকট নিরসনের লক্ষ্যে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তাই রাজনৈতিক দলগুলো কতটা গভীরভাবে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার কর্মপরিকল্পনা তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারের অতীত রেকর্ড বলছে, বেশিরভাগ দলই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা বলে; কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না। লক্ষ্য করার বিষয়, প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগ থাকে অনির্দিষ্ট। পরিতাপের বিষয় হলো, নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে প্রতিশ্রুতির বড় অংশই হারিয়ে যায় বাস্তবতার জটিলতায়। তবে এবার পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে শিক্ষা নিয়ে হয়তো চমকপ্রদ কিছু ঘটতে পারে। কারণ চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক জাগরণ এবং জনগণের সচেতনতা—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর এবার নির্বাচনকেন্দ্রিক অন্যরকম নতুন চাপ তৈরি করবে। এই চাপের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের ইশতেহার নতুন করে সাজাবে বলে ধারণা করি। তবে সব রাজনৈতিক দল তাদের ইশতেহারে ‘দেশে সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক সহাবস্থান ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে জনগণের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন গড়ে তোলা হবে’ মর্মে একটি সাধারণ প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বিবেচনা করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে শিক্ষা নিয়ে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে মনে করি—১. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম সংস্কার ও মানোন্নয়ন; ২. শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতির মৌলিক সংস্কার; ৩. উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসৃজনমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন; ৪. সরকারি নিয়োগে পূর্ণ স্বচ্ছতা, মেধাভিত্তিক নির্বাচন ও জবাবদিহি নিশ্চিতের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি; ৫. শিক্ষা খাতে গবেষণা কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করা এবং এ লক্ষ্যে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা; ৬. দক্ষতা ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ, পাশাপাশি ডিজিটাল শিক্ষার জন্য টেকসই অবকাঠামো ও সংযোগব্যবস্থার উন্নয়ন; ৭. প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের গুণগত মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে একটি পৃথক শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Education) স্থাপন; ৮. শিক্ষকদের সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি, ন্যায্য বেতন-ভাতা, পদোন্নতি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে শিক্ষকতাকে একটি আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক পেশায় পরিণত করা; ৯. শিক্ষা খাতে জিডিপির তুলনায় আর্থিক বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি এবং বরাদ্দের কার্যকর, সুষম ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা; ১০. শিক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিই শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে শিক্ষার্থী ও জন-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিতে চায় এবং দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতিকে ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়, তাহলে এই বিষয়গুলো শুধু ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করলেই হবে না, বাস্তবায়ন রূপরেখাতেও এগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে মনে করি।

শিক্ষাই একটি জাতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি—সবকিছুর উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষার গুণগত মানের ওপর। তাই আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক, উন্নয়নমূলক যেকোনো পরিকল্পনার ভিত্তি হিসেবে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধু স্কুল-কলেজ নয়; বরং শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। কোথাও কোথাও প্রয়োজন হবে পুরো শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি ঢেলে সাজানোর। রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থেই এ পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী কর্তব্য হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের ইশতেহারে কী লিখবে, কী ধরনের রূপরেখা প্রণয়ন করবে, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন ও রাজনৈতিকভাবে সদাজাগ্রত। তাই শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো রাজনৈতিক দলই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আস্থা অর্জন করতে পারবে না—এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষার গুরুত্ব শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, পরিবর্তন ও উন্নয়ন নিয়ে জনমনে যতটুকু অপ্রাপ্তি থেকে গেল, আশা করি নতুন সরকারে আসীন রাজনৈতিক সরকার সেটুকু পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ হবে।

লেখক : অধ্যাপক (শিক্ষা) ও সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

mujibur29@gmail.com

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন