বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ কেন জরুরি?

আলী ওসমান শেফায়েত
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১৬

তরুণরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সব অন্যায়-অবিচার, বাধাবিপত্তি ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার উজ্জীবিত শক্তি হলো তরুণ প্রজন্ম। তরুণরাই পুরাতনকে ভেঙে নতুনের স্বপ্ন দেখায়। বিশেষ করে, তারুণ্যে ভরপুর এই বাংলাদেশ গঠনে তরুণ-যুবকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ যখন ‘বাংলা প্রদেশ’ ছিল, তখন থেকে আজ পর্যন্ত দেশের জন্য সব আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণ জনগোষ্ঠী মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধেও এ দেশের তরুণসমাজ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ; পরে ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তরুণ-যুবকদের আত্মত্যাগ আর সাহসী ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রেরণার হাতিয়ার হয়ে থাকবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ তরুণ। এই জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কেননা, যেকোনো দেশ বা জাতির সাফল্য ও অর্জন তার তরুণ প্রজন্মকে এড়িয়ে সম্ভব নয়। অদম্য তরুণরা তাদের দুরন্তপনা, অসীম সাহস এবং নবসৃষ্টির উদ্দীপনা নিয়ে যেকোনো কঠিন বাধা অতিক্রম করতে পারে। তাই তরুণদের শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সর্বোপরি দেশের অভ্যন্তরীণ ও যেকোনো বহিঃশত্রুর আগ্রাসী শক্তিকে দমন করার মতো উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশ জনবহুল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। প্রতিবছর বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশের মানুষ এবং সহায়-সম্পদ। তা ছাড়া বাংলাদেশ ভূপ্রকৃতিগতভাবে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে যদি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, তাহলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবছর বিভিন্ন কল-কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনার কারণেও অনেক প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় আমাদের।

এমতাবস্থায় আমাদের যদি একটি প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকে, তাহলে সেটি দেশের যেকোনো দুর্যোগে নিয়মিত বাহিনী ও উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। তাই দেশের তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীকে বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করতে সক্ষম এমন এক সামরিক বাহিনী বা এর আদলে একটি সামগ্রিক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা খুবই জরুরি। যদি আমরা বহির্বিশ্বের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব–উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, ব্রাজিল, ইসরাইল, ইরান, তুরস্ক, সিরিয়া, মিসর, কিউবা, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ইরিত্রিয়া, সুইডেনসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টির মতো দেশে অন্তত এক বছর থেকে তিন বছর পর্যন্ত তরুণদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক।

এর মধ্যে আমেরিকায় ১৮-২৫ বছর বয়সি, চীনে ১৮-২২ বছর বয়সি সবার জন্য (কমপক্ষে দুই বছরের জন্য), দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩০ বছরের নিচে সবার জন্য ১৮ মাস থেকে ২১ মাস সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। উত্তর কোরিয়ায় এটা সবচেয়ে বেশি; যার সময়কাল সাত বছর। এ ছাড়া ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে এ ধরনের আইনের প্রচলন ছিল, সে সময় ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সিরা ১৮ মাসের জন্য সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য হতেন। নরওয়ে, সুইডেনসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশেও একই ধরনের আইনের প্রচলন ছিল। দেশভেদে নিয়মকানুনের ভিন্নতা থাকলেও ওইসব দেশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রায় অভিন্ন।

বাংলাদেশেও বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ধারণা সাম্প্রতিককালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশে এসে আমার দেশ সম্পাদক মজলুম সাংবাদিক ড. মাহমুদুর রহমান সর্বপ্রথম এ ব্যাপারে কথা বলেন। এর আগেও অনেকে এ ব্যাপারে কথা বললেও তা এভাবে আলোচনায় আসেনি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ব্যাপারে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতের নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা বিবেচনায় নিয়ে দেশের সামরিক ভারসাম্য, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, নাগরিকদের শৃঙ্খলা ও একটি সুস্বাস্থ্যকর জাতি গঠনের মানসে আমাদের তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীকে সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। তাতে করে দেশের তারা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের প্রতিরক্ষা, আত্মগঠন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত পূর্বাপর প্রস্তুতি ও দেশপ্রেমের দীক্ষা পাবে।

সঙ্গে সঙ্গে দেশের দুঃসময়ে দেশ রক্ষায় এবং সুস্থ ও বুদ্ধিদীপ্ত তরুণসমাজ গড়ে তুলতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষের ‘ডিজিটাল নেটিভ’ বা শিশুকাল থেকে ডিজিটাল ডিভাইসের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে তরুণ-যুবকরা যেভাবে অলস ও কর্মবিমুখ হয়ে পড়ছে, তা থেকেও তাদের মন-মানসিকতাকে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি হবে।

যেকোনো প্রশিক্ষণ মানুষকে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, সাহস জোগায় এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার দৃঢ় মানসিক শক্তির জোগান দেয়। সামরিক প্রশিক্ষণ তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকাসক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সম্মিলিতভাবে কোনো কাজ করার মানসিকতা সৃষ্টি করবে, বাস্তবজীবনে তারা দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে, যেকোনো বিষয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবে।

পরের কল্যাণে বা যে কারো দুঃখ-দুর্দশায়, বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় তারা উদ্বুদ্ধ হবে। দেশের তরুণ-যুবকরা যেভাবে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তা থেকে সরিয়ে আনার জন্য সামরিক একটি প্রশিক্ষণ সত্যিই দারুণ ভূমিকা পালন করবে। আর দেশের মানুষ যে হারে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি বিশেষ করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে, তা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শারীরিক প্রশিক্ষণ, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে এবং সেটি সম্ভব হবে যদি দেশের এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো জনবহুল এবং উন্নয়নশীল দেশে তরুণ-যুবকদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বা সামগ্রিক প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব? প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ, প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও প্রশিক্ষক দরকারÑতা আমাদের এই মুহূর্তে নেই। তবে এখন থেকে যদি পরিকল্পনা নিয়ে আগানো যায়, তাহলে তা বাস্তবায়ন করা কোনো ব্যাপার নয়। সরকার যদি চায়, তাহলে যেকোনো বিষয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

বিষয়টি ব্যয়বহুল হলেও বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার এবং তাদের দোসররা যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছে, তার চেয়ে বেশি হবে না। দরকার একটি সুন্দর পরিকল্পনা আর দৃঢ় সিদ্ধান্ত। সরকার যদি চায় সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমন উদ্যোগ নিতে পারে অথবা সামরিক বাহিনীর বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে পারে। আমাদের সীমিত সম্পদ ও আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছি।

একটি নির্দিষ্ট বয়সের সব সুস্থ পুরুষ বা নারীকে এই প্রশিক্ষণের জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে, শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা, ধর্মীয় বিশ্বাস বা অন্যান্য ব্যক্তিগত কারণে ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে পারে। সরাসরি সামরিক বাহিনীই এই প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেবে। তবে, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা অন্যান্য সরকারি সংস্থাও সহযোগিতা করতে পারে।

প্রশিক্ষণের মেয়াদ কয়েক মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের দেশের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। সামরিক ক্যাম্প, বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা স্কুল-কলেজগুলো প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধি, অস্ত্রশস্ত্র চালানো, প্রাথমিক চিকিৎসা, দলগত কাজ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ পূর্বাপর প্রস্তুতি, ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার অভিযান, সততা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করতে হবে। পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষক, উপকরণ এবং অবকাঠামো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের বিষয়টিও বিবেচনা করা জরুরি।

সারাদেশে বিভিন্ন সামরিক ক্যাম্পের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় অস্থায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে।

মোট কথা, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তরুণ-যুবকদের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হতে পারে। এদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত মানবসম্পদে পরিণত করা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি এলে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশরক্ষায় যেন আত্মনিয়োগ করতে পারে, সেই শারীরিক যোগ্যতা ও মানসিকতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তরুণদের যদি যৌবনের এ রকম একটি প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যায়, তাহলে প্রতিটি নাগরিক দেশের জন্য সম্পদে পরিণত হবে এবং প্রকৃত অর্থেই দেশ সোনার বাংলাদেশ হয়ে উঠবে এবং পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত