পলাতক জননীর অটুট ‘চোরতন্ত্র’

মারুফ কামাল খান
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ২৯

লর্ড অ্যাক্টন ছিলেন উনিশ শতকের একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবেত্তা। লর্ড খেতাবে ভূষিত এই ভদ্রলোক বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই মারা যান। তার পুরো নাম ছিল জন এমেরিক এডওয়ার্ড ডলবার্গ অ্যাক্টন। তিনি ছিলেন তার সমকালের অন্যতম বিশিষ্ট পণ্ডিত। ওই সময়কার আরেক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক, অ্যাংলিকান খ্রিষ্টান ধর্মযাজক, বিশপ ম্যান্ডেল ক্রাইটনকে এক চিঠিতে অ্যাক্টন একটা বিখ্যাত কথা লিখেছিলেন। শতাব্দী পেরিয়ে এখনও ‘কোটেবল কোট’ বা উদ্ধৃতিযোগ্য উদ্ধৃতি হিসেবে চালু সেই বাক্যটি হচ্ছে : ‘Power tends to corrupt; absolute power corrupts absolutely.’

বিজ্ঞাপন

অ্যাক্টনের এই উক্তি থেকে আমরা জানি ও মানি, ক্ষমতা দুর্নীতিপ্রবণ এবং চরম ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। এর প্রমাণও আছে ঢের। অনেক আপাত ভালো মানুষকে ক্ষমতাশালী হওয়ার পর দুর্নীতি ও অনিয়মে লিপ্ত হতে দেখা যায়। তবে এই কোটেশনের উল্টো পিঠেও কিন্তু আরেক পরম সত্য লুকিয়ে আছে। কিছু মানুষ, কিছু পরিবার ও কোনো কোনো বংশধারার পরিচয় আমরা পাই, যারা সহজাতভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত। ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক, মওকা পেলেই এরা দুর্নীতি করে। এদের অস্থিমজ্জায় ও রক্তধারায় দুর্নীতি, জিনগতভাবেই এরা দুর্নীতিগ্রস্ত। আর কোনো ভণিতা না করে বাংলাদেশ থেকে এর চাক্ষুষ উদাহরণ দিতে গেলে সবার আগে আসে মুজিব পরিবারের নাম।

পাকিস্তানের প্রথম দশকেই শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট ও কোয়ালিশন সরকারের প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলেন। আইউব খান ক্ষমতা দখল করে মার্শাল ল’ জারির পর মুজিবের বিরুদ্ধে ৯টি মামলা হয় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে। তার ভাই শেখ নাসেরও অভিযুক্ত হন। এসব মামলায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আব্দুস সালাম খান, জহিরউদ্দীন ও শাহ আজিজুর রহমানের মতো খ্যাতনামা দলীয় আইনজীবীরা আদালতে লড়েন মুজিবের পক্ষে। তারপরও একটি মামলায় ঢাকার জেলা ও সেশন জজ আবদুল মওদুদ ১৯৬০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দেওয়া রায়ে দুর্নীতির দায়ে শেখ মুজিবকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন।

এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে আইনজীবী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাইকোর্টে যুক্তি দেখান, মন্ত্রী হিসেবে জনপ্রতিনিধি শেখ মুজিবকে সরকারি কর্মচারী গণ্য করা যায় না। কাজেই সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি নিরোধকল্পে প্রণীত আইন জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। এই যুক্তি গ্রহণ করে ১৯৬১ সালের ২১ জুন হাইকোর্ট শেখ মুজিবকে ওই মামলা থেকে মুক্তি দেয়।

তবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব যখন সব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তখন তার ভাই শেখ নাসেরের বিরুদ্ধে চোরাচালান ও অন্যদের সম্পদ দখলের অভিযোগ ওঠে। তার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি ভবন, প্রেস ও সম্পদ দখল করেন। মুজিবের পুত্রদের বিরুদ্ধেও ওঠে এন্তার অভিযোগ। তার জ্যেষ্ঠ কন্যা হাসিনা বদরুন্নেসা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স ক্লাসে ভর্তি হলেও ১৯৬৮ সালে তার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর লেখাপড়া ছেড়ে গৃহবধূ হাসিনা দুই সন্তানের মা হন। স্বাধীনতার পর তিনি বাসায় বসে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করেছেন বলে সার্টিফিকেট অর্জন করেন এবং সেই সনদের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। তার শিক্ষাজীবনও ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়ম-দুর্নীতির নজির হয়ে আছে।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কবর দিয়ে শেখ মুজিব মুজিববাদ কায়েমের নামে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। তিনি রাজতান্ত্রিক ধাঁচের এই ব্যবস্থার নাম দেন দ্বিতীয় বিপ্লব বা শোষিতের গণতন্ত্র। তার সহকর্মীদের মধ্যে যারা অগণতান্ত্রিক এ পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছিলেন, তারা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের একাংশের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে বাকশাল সরকার উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। তার দুই কন্যা ইউরোপ সফরে থাকায় বেঁচে যান এবং ভারতে এসে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের কাছে আশ্রিত হন। একই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশ ভারতে গিয়ে তাদের অস্ত্র-রসদ, প্রশিক্ষণ ও মদদে বাংলাদেশে নাশকতামূলক তৎপরতা শুরু করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই পরিস্থিতি নিরসনের উদ্যোগ নেন। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তিনি হাসিনার ফিরে আসার ব্যবস্থা করেন। ভারতে থাকতেই হাসিনা আওয়ামী লীগের একাংশের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং তিনি স্বদেশে ফেরার ১৩ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে একদল বিপথগামী সেনা অফিসারের ঝটিকা হামলায় নিহত হন। এরপর শহীদ জিয়ার উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকার ধানমণ্ডির তখনকার ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ৬৭৭ হোল্ডিং নম্বর বাড়িটি শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করেন ১৯৮১ সালের ১২ জুন।

মুজিব নিহত হওয়ার পর থেকে বাসাটি সরকারি জিম্মায় ছিল। ওই বাড়িতে যেসব মালামাল পাওয়া যায়, তার একটি সিজার লিস্ট করা হয়েছিল। ৭১ পৃষ্ঠার সেই জব্দ-তালিকায় ছিল কয়েক শ ভরির স্বর্ণালংকার, কয়েক হাজার ভরির রুপার গয়না, দেশি-বিদেশি মুদ্রা মিলিয়ে কয়েক লাখ টাকা, গুলি-বারুদসমেত বেশ কিছু লাইসেন্সবিহীন বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র ও অন্যান্য মালামালের বিবরণ। ৯ জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা নিজের হাতে ‘আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া সব মালামাল বুঝিয়া পাইলাম’ লিখে জব্দ-তালিকার পাতায় পাতায় সই করে সমস্ত মালপত্র গ্রহণ করেন। এত কাহিনির সারকথা হচ্ছে, গরিব দেশের একজন রাজনীতিবিদের বাড়িতে এত নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান মালামাল থাকাটা তাদের পারিবারিক সততাকে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর লাইসেন্স ছাড়া বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকার ব্যাপারটা তো রীতিমতো দুর্বৃত্তপনার শামিল।

স্বাধীনতার পর দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, ব্যাপক চোরাচালান ও মজুতদারি হয়েছে, বামপন্থি ও মুক্তিযোদ্ধাসহ হাজার হাজার ভিন্নমতের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, মানুষ লজ্জা নিবারের বস্ত্র পায়নি, আইনশৃঙ্খলার দারুণ অবনতি হয়েছে, ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, পাবলিক পরীক্ষায় নকলের মচ্ছব হয়েছে, পাটের গুদামগুলো নাশকতামূলক আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে এমন হাজারো ব্যর্থতা শাসক হিসেবে মুজিবের ছিল। কিন্তু মুজিব যখন দুর্ভিক্ষের দিনে ৫২ পাউন্ড ওজনের কেক কেটে নিজের জন্মদিনের উৎসব করেন, তখন তা আর ব্যর্থতা থাকে না, অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়। বেলী ফুলের মালা দিয়ে অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী ও নাজমুন আরা মিনুর বিয়েকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে দেখতে চেয়ে মুজিব যখন তার ছেলেদের বিয়েতে মাথায় সোনার টোপর পরান তখন, তা নির্লজ্জ অপরাধ হয়। বন্দি সিরাজ সিকদারকে বিনাবিচারে হত্যার পর মুজিব পার্লামেন্টে ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার’ বলে দম্ভোক্তি করে নিজেকে খুনের অনুমোদনকারী প্রমাণ করেন। কিন্তু মুজিবের পর হাসিনা নিজে যা করেছেন এবং তার দোসরদের যা যা করার অনুমোদন দিয়েছেন, তাতে তার অপরাধের তুলনায় মুজিবের অপরাধ নস্যি বলেই মনে হতে পারে।

এইচএম এরশাদের শাসনামলে তার অধীনে যারা নির্বাচনে যাবেন, তারাই জাতীয় বেঈমান চিহ্নিত হবেন বলে শেখ হাসিনা ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের এক সমাবেশে ঘোষণা দেন। ঢাকায় ফিরে তিনি নিজেই সদলবলে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেন। এরশাদের তখনকার ঘনিষ্ঠ ও হাসিনার আত্মীয় নাজিউর রহমান মঞ্জুর, মওদুদ আহমেদ এবং আসম আব্দুর রব পরবর্তীকালে জানান, এরশাদের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা ঘুষ খেয়ে হাসিনা ওই পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী হন।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তার বিরুদ্ধে মিগ ও ফ্রিগেট কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া তিনি রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ গণভবন ১০১ টাকায় নিজের নামে লিখে নেন। তার বোন রেহানার নামে আরেকটি ভবন বরাদ্দ করেন ধানমণ্ডিতে। উভয় বরাদ্দ বিএনপি সরকার বাতিল করলে পরে আবার ক্ষমতায় এসে তিনি জাতির পিতার বংশধরদের নিরাপত্তার নামে আইন করে ফের গণভবন অধিকার করেন এবং রেহানার নামে গুলশানে বিলাসবহুল বাড়ি বরাদ্দ দেন। এ ছাড়া আইন ভেঙে হাসিনা ও তার স্বজনরা মিলে পূর্বাচলে ১০ কাঠা আকারের ছয়টি প্লটে ৬০ কাঠা জমি গোপনে বরাদ্দ নেন। এগুলো এই পরিবারের সদস্যদের লোভের জাজ্বল্যমান প্রমাণ। অথচ হাসিনা রোজ তার স্বরে প্রচার করতেন, তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, তারা ক্ষমতায় এসেছেন শুধু জনগণকে কিছু দিতে। একই সঙ্গে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে হরদম কুৎসা রটাতেন দুর্নীতির। অথচ হাসিনার আনুকূল্যে আজিজ খান সিঙ্গাপুরের সেরা ধনীদের একজন হয়েছেন। এস আলম হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেছেন। বসুন্ধরা ও বেক্সিমকোর মতো গোষ্ঠী বেশুমার অন্যায় সুবিধা পেয়েছে। তার অন্য অলিগার্করাও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। হাসিনার মন্ত্রী, এমপি, সেনাপ্রধান ও পুলিশের কর্মকর্তারা একেকটা ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন। আর হাসিনা নিজে, তার পুত্র ও কন্যা, বোন, ভাগনে, ভাগনি দেশের সম্পদ লুটে বিদেশে পাচার করে সম্পদের যে বিশাল পাহাড় গড়েছে, তার কিছু কিছু উন্মোচিত হচ্ছে। কল্পনাতীত ও বিস্ময়কর ওদের চুরি, দুর্নীতি ও লুটতরাজের পরিমাণ।

ওরা শুধু নিজেরাই চুরি-চামারি করেনি। ক্ষমতায় অন্যায়ভাবে টেকার জন্য যাদের প্রয়োজন মনে করেছেন তাদেরই হাসিনা অবাধে লুটপাট ও দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন। এদের মধ্যে যারা বাঁধা বেতনের সরকারি চাকুরে, তাদেরও মাসে লাখ লাখ টাকা খরচের অভ্যাস করে দিয়ে গেছেন হাসিনা। তাই ওরা তাকে ভুলতে পারেন না। এদের দিয়ে দেশ পরিচালনা হাসিনা অসম্ভব করে দিয়ে গেছেন সবার জন্য। শুধু পরিবারকে নয়, পুরো রাষ্ট্রটাকেই হাসিনা বানিয়ে গেছেন ‘চোরতন্ত্র’। এই চোরতন্ত্রের জননী হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে গেলেও রেখে গেছেন তার সৃষ্ট শোধনের অযোগ্য চোরতন্ত্র। হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, দলীয়করণ, ভোটডাকাতি, সংবিধান লঙ্ঘনের মতো অজস্র অপরাধের কথা বাদ দিলেও শুধু রাষ্ট্রকে চোরতন্ত্রে পরিণত করার অপরাধের জন্যই হাসিনার শতবার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। এই রাষ্ট্রকে পরিচালনযোগ্য করতে হলে একটি সামাজিক বিপ্লব ছাড়া আর কোনো পথ খোলা আছে বলে আমার মনে হয় না।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক, ই-মেইল : mrfshl@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত