১৯৪৭ সাল, ১৯০ বছরের দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের পর আজাদির পাকিস্তান। কিন্তু এরপরই শুরু সেই পুরোনো ঔপনিবেশিক শাসনের পুনরুৎপাদন। গণতন্ত্র থেকে শুরু করে, অধিকারের প্রশ্নে সব যেন বন্দি হয়েছিল তথাকথিত ব্রিটিশ ধারায় শিক্ষিত ও ব্যবসায়ী এলিটদের হাতেই।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান-সবখানে জারি ছিল সেই একই ধারা। সেই বঞ্চনা আর অধিকারহীনতার, যার হাত ধরেই পূর্ব পাকিস্তানের এই অংশে নেমে আসে অকথ্য নিপীড়ন এবং শুরু হয় স্বাধিকারের চূড়ান্ত লড়াই।
১৯৭১ সালের সেই লড়াইয়ে রক্ত দিয়েছিল এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও তরুণ-জনতা। অথচ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ক্ষমতার অলিন্দে বসে কিছু নেতা ভারতের সঙ্গে করে বসল গোলামির সাত দফা বন্দোবস্ত। কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়াও রচিত হয়েছিল দিল্লির ছায়াতলে। একের পর এক ভারতীয় সমর্থনধারীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল, হোক সেটা সামরিক বা বেসামরিক। আর যারা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, তাদের জন্য নেমে এলো নির্মম পরিণতি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন সেই চ্যালেঞ্জের প্রতীক, তাই তাকে হত্যা করা হলো। বাংলাদেশপন্থি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদেরও পরিকল্পিতভাবে সাইডলাইন করা হলো। কেউ গুম হলো, কেউ নির্বাসিত, যেমন : সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের গুম তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এভাবে ধীরে ধীরে ভারত বাংলাদেশকে তার পূর্ণ জালে আবদ্ধ করল। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বয়ান তথা স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সুবিচার, ন্যায় ও সমতার কথা মুছে ফেলে, সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হলো ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের এমন ব্যাখ্যা, যা মূলত দিল্লির ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে। ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিনের ছদ্মবেশী শাসনে, ভারতের সাউথ ব্লকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, ভারতের দাসত্বশীল আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় বসানো হলো।
পরবর্তী ১৫ বছরে বাংলাদেশকে কার্যত ভারতের একটি উপনিবেশে রূপান্তর করা হলো। ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দমন’-এর নামে বিএনপি, জামায়াতপন্থি রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা, ফাঁসি, কারাবন্দিত্ব ও নির্বাসনের শিকার করা হলো। রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, অর্থনীতি যেন সবকিছুই পরিণত হলো আধিপত্যবাদের হাতিয়ারে। বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করার সব আয়োজন যখন প্রায় সম্পন্ন, ঠিক তখনই আল্লাহর অশেষ রহমতে এই দেশের তরুণ সমাজ জেগে উঠল। জেনারেশন জেডের নেতৃত্বে সংঘটিত হলো এক অভূতপূর্ব গণবিপ্লব, যেখানে ভারত-সমর্থিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দল পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। ভয়, দমন আর গোলামির শৃঙ্খল ভেঙে বাংলাদেশ আবার স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল।
৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে বর্তমান
সত্যিকারার্থে, ৩৬ জুলাই ২০২৪-এর বিপ্লব ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের যুদ্ধ। এই দেশের দামাল ছেলেরা বুলেট ও গুলির মুখে খালি হাতে বুক পেতে দিয়ে ভয়কে পরাজিত করেছে আর বিজয়ের নতুন ইতিহাস রচনা করেছে।
৪৭-এ বাংলাদেশ পেয়েছিল পাকিস্তান নামের নতুন একটি রাষ্ট্র আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পেয়েছিল পাকিস্তান থেকে ভূখণ্ডে স্বাধীনতা; আর ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছে জনগণের মালিকানার স্বাধীনতা। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হলোÑযেভাবে ৪৭, ৭১-এর রক্ত, চেতনা ও স্বপ্ন যেভাবে একটি শ্রেণি বাঙালি জাতিবাদের নামে হাইজ্যাক করেছিল, ঠিক সেই একই শক্তি আজ ২০২৪-এর বিপ্লবকেও ছিনতাই করার সর্বাত্মক আয়োজন সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশকে আবার দিল্লির করদ রাজ্যে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এর প্রথম শিকার হলো জুলাইযোদ্ধারা। তাদের ওপর নেমে এলো সশস্ত্র হামলা। মিডিয়া ও তথাকথিত ‘সুশীল সমাজ’-এর নামে কলঙ্কিত এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী মাঠে নেমে পড়েছে। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পতিত ফ্যাসিস্টদের ‘ইসলাম বনাম মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামে বিকৃত বয়ান নির্মাণে লিপ্ত হয়েছে। টেলিভিশন টকশোগুলো দখল করে বসেছে ফ্যাসিবাদের সহযোগীরা, বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি বা সাংবাদিক প্রতিনিধি সেজে তারা জনমত বিষাক্ত করে তুলছে।
মনে রাখতে হবে, ২০২৪-এর বিপ্লব কোনো ক্ষমতার পালাবদল নয়, এটি ভারতীয় আধিপত্যবাদকে পরাজিত করার ঐতিহাসিক সংগ্রাম। আর ২০২৬ সালের নির্বাচন হবে সেই সংগ্রামের চূড়ান্ত ময়দান, যেখানে ভারতীয় আধিপত্যবাদের দোসর আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে অপ্রাসঙ্গিক করার সিদ্ধান্ত জনগণ নেবে। এ কারণেই সরকার যখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করল, তখন ভারত ও তার দালাল আওয়ামী লীগ চরম হতাশায় ভেঙে পড়ল। গণরায় ঠেকাতে তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। নির্বাচন বানচালের জন্য শুরু হয়েছে টার্গেট কিলিং মিশন তথা জুলাইয়ের যোদ্ধা ও ভারতবিরোধী নেতৃত্বকে একে একে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা। সাম্প্রতিক সময়ে শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। হাদির আঘাত এতটাই মারাত্মক যে, তার ফিরে আসা অলৌকিকতার কম কিছু নয়। এ ঘটনা এবং এর আগের ও পরের অসংখ্য আক্রমণ প্রমাণ করে যে মিডিয়া, সচিবালয়, প্রশাসন, ইউনিভার্সিটি, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভারতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও ফ্যাসিস্টরা আবার চাঙা হয়েছে। তারা নির্বাচন বানচাল করতে প্রাণপণ লড়াইয়ে নেমেছে। আজ বাংলাদেশের সামনে প্রশ্ন একটাই, ২০২৪-এর বিপ্লবকে রক্ষা করা হবে, নাকি দিল্লির আধিপত্যের কাছে আবার আত্মসমর্পণ করা হবে?
সাধারণত, ফ্যাসিবাদ বন্দুক দিয়ে নয়, বয়ান দিয়ে ফিরে আসে। ওসমান হাদির ওপর হামলার পর বাংলাদেশের মিডিয়ার এক শ্রেণির ব্যক্তিত্ব, সুশীলসমাজ, পত্রিকার সম্পাদক বা প্রথিতযশা সাংবাদিকরা কার্যত নীরব থেকেছে। বরং অনেকে সমাজে ফ্যাসিবাদের পক্ষে ন্যায্যতা ও বৈধতা তৈরির কাজে নেমেছে। অনেকে মনে করেন, এই হামলা প্রশাসন, পুলিশ ও গোয়েন্দা কাঠামোর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। শুটারকে ধরাই যথেষ্ট নয়। যে পুরো ব্যবস্থা, পৃষ্ঠপোষকতা, লজিস্টিক, কভার-আপ, এই মিশন চালিয়েছে, সে চেইন ভাঙতেই হবে। নয়তো জুলাইযোদ্ধাদের ওপর শুরু হওয়া এ রক্তপাত থামবে না।
সুতরাং এ কথা স্পষ্ট, দেশ যখন ভারতীয় আধিপত্য থেকে মুক্তির জন্য জীবন দিচ্ছে, তখন ভেতর থেকেই অনেকে দেশদ্রোহী চালাচ্ছে। এদের অবাধ চলাফেরার অনুমতি কারা দিচ্ছে? কোন দলের ছত্রছায়ায় এরা? রাষ্ট্র কেন দেশদ্রোহীর অভিযোগে এদের গ্রেপ্তার ও দণ্ডিত করতে পারছে না? যেসব দলে এদের পরিচয়, তাদের দায়িত্ব এদের দলীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা। বাস্তবতা হলো পুলিশ এদের গ্রেপ্তার করে না, ধরা পড়লে বিচারক জামিন দেয়, ওপর মহল ফোন করে, সাংবাদিক-শিক্ষক হত্যার বৈধতা তৈরি করে আর গোয়েন্দা-সেনা পালানোর রাস্তা খুলে দেয়। আমরা শুধু ‘টিপ অব দ্য বাকশাল’ ভেঙেছি। পুরো বাকশাল উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত এই রক্তের স্রোত থামবে না।
সুতরাং, বিষয়টি এখন আর বিতর্কের নয়; জনগণ যদি সংগঠিত গণপ্রতিরোধ গড়ে না তোলে, তবে জুলাইও হাইজ্যাক হবে আর ভারতীয় আধিপত্যবাদ আবার ফিরে আসবে। বাংলাদেশকে স্বাধীন রাখতে চাইলে বাংলাদেশপন্থি দেশপ্রেমিক জনতাকে সচেতন থাকতে হবে। এর একমাত্র পথ হলো ‘জুলাই সুরক্ষা কমিটি’ নামের গণভিত্তিক প্রতিরোধ কাঠামো। এর খসড়া কেমন হতে পারে, তার একটি আলোচনা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
এক.
বয়ানযুদ্ধ জিততে হবে। ফ্যাসিবাদী ও বিভাজনমূলক বয়ানের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালাতে হবে। ‘ইসলাম বনাম মুক্তিযুদ্ধ’ কিংবা ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ’ এই ভুয়া ফাঁদ ভেঙে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি শক্তিকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, আলেম সবাইকে নিয়ে একটি যৌথ বয়ান ফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে।
দুই.
জুলাইযোদ্ধাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শহীদ ও আহতদের নাম, গল্প ও দাবি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত জাতীয় দলিলে রূপ দিতে হবে এবং প্রয়োজনে নিম্ন আয়ের জুলাইযোদ্ধাদের নিয়মিত ভাতা দেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে ।
তিন.
বিদেশি স্বার্থসংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্ক উন্মোচন করতে হবে। প্রশাসন, মিডিয়া ও নিরাপত্তা কাঠামোয় সক্রিয় বিদেশি গোয়েন্দা এবং সহযোগী নেটওয়ার্ককে প্রমাণভিত্তিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। গুজব নয়, রিপোর্ট, হোয়াইট পেপার, তদন্ত ও আন্তর্জাতিকভাবে উপস্থাপনযোগ্য ডসিয়ার চাই।
চার.
নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র আগেই প্রতিহত করতে হবে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক, নাগরিক ভলান্টিয়ার ও ডিজিটাল মনিটরিং গড়ে তুলতে হবে। তরুণদের কাছে এই বার্তা পরিষ্কার করা যে ভোট না দেওয়া মানে আধিপত্যবাদের পক্ষে দাঁড়ানো।
পাঁচ.
নেতৃত্ব সংকট এড়াতে হবে। ইতিহাস বলে, বিপ্লব ধ্বংস হয় বিপ্লবের পর। তাই একজন নয়, দরকার নৈতিক, যৌথ ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব। ব্যক্তিপূজা নয়, দরকার নীতিপূজা। অর্থ, বিদেশি ফান্ড ও ক্ষমতার লোভ থেকে দূরে থাকতে হবে। ৪৭ বা ৭১-এর ভুল আর করা যাবে না।
ছয়.
সহিংসতার ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। প্রতিপক্ষ সেটাই চায়। প্রতিটি হামলার জবাব হবে আইনি, রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত রাষ্ট্র ধ্বংস নয়, রাষ্ট্রকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে নেওয়া। সবশেষে বলা যায়, জুলাইকে রক্ষা করা মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে রক্ষা।
লেখক : একাডেমিক ডিরেক্টর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ
khaled.du502@gmail.com
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

