ডেরেক লিবার্ট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ওপর বই লেখার জন্য হ্যারি ট্রুম্যান বুক অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হিসেবে আমার এ কথা শুনতে খুবই বিস্ময়কর লাগে, ‘হ্যারি ট্রুম্যান থেকে শুরু করে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট’ ইসরাইলের প্রতি ‘অটুট সমর্থন’ দিয়েছেন।
গাজায় গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি ইসরাইল সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সম্পর্কে এই দাবিটি প্রায়ই করে ইসরাইল, যা মোটেও সত্য নয়।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভকে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে যে তুলনা করেছেন, তা ঐতিহাসিকভাবে অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। অশিক্ষিত লোকরাই এ ধরনের কথা বলবে। ইসরাইলের প্রতি আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের ‘অটুট সমর্থন’ এবং নাৎসি জার্মানি নিয়ে ইঙ্গিত করার বিষয়টি যাচাই করে দেখা যেতে পারে।
ট্রুম্যান ১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন, ইহুদিরা শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করার পথে অগ্রসর হচ্ছে। ট্রুম্যানের পর প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ারও ফিলিস্তিনি গণহত্যার জন্য ইসরাইলের নিন্দা করেছিলেন।
ফিলিস্তিনি গণহত্যার প্রথম ঘটনাটি ঘটে পশ্চিমতীরের কিবায়া গ্রামে। ইসরাইলের ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের নেতৃত্বে প্যারাট্রুপাররা ওই গ্রামের ‘প্রত্যেক পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে’। টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছিল।
নিউ ইয়র্ক পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে কিবায়া হত্যাকাণ্ডকে ১৯৪২ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার লিডিস এলাকাকে ইহুদিমুক্ত করার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছিল।
ইসরাইলি ইতিহাসবিদ বেনি মরিসের তথ্য অনুযায়ী ‘১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ২ হাজার ৭০০ আরব অনুপ্রবেশকারী এবং এবং প্রায় ৫ হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও পুলিশ।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘নিহতদের অধিকাংশই ছিল নিরস্ত্র’। এর অর্থ হচ্ছে নিহত এই ফিলিস্তিনিরা ছিল ভেড়া চরানো রাখাল, কৃষক ও শরণার্থী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার ফিলিস্তিনি গণহত্যার নিন্দা করেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে মিসরে আক্রমণ সংগঠিত করার জন্য দুই ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন এবং ফ্রান্সেরও নিন্দা করেছিলেন তিনি।
ইসরাইলের যুদ্ধের ধরন ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। তেল আবিবের কাছে কাফির কাসিম এলাকায় ৪৯ জন ফিলিস্তিনি গ্রামবাসীকে হত্যা করার মাধ্যমে ইসরাইলের হামলা শুরু হয়। এরপর তারা গাজার খান ইউনিস ও রাফায় শরণার্থীদের ওপর গণহত্যা চালায়। ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইজেনহাওয়ার ইসরাইলকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, যদি তারা গাজা উপত্যকা থেকে সরে না আসে, তাহলে তিনি ইসরাইলের বন্ড বিক্রি বন্ধ করে দেবেন। ফলে ইসরাইল বাধ্য হয় গাজা থেকে দ্রুত সেনা প্রত্যাহার করতে।
এরপরের বছরই ইসরাইল পরমাণু বোমা তৈরির উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়নকে বলেন, তারা যদি তাদের পরমাণু কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে না দেয়, তাহলে ‘ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন’ মারাত্মক অচলাবস্থার মধ্যে পড়বে। তখন বেন গুরিয়ন দাবি করেছিলেন, ইসরাইল পরমাণু জ্বালানির জন্য তার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
ইসরাইল ১৯৬৬ সালে জর্ডান আক্রমণ করার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ইসরাইলের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এ সময় তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘ইসরাইল আমাদের এবং একই সঙ্গে তাদেরও স্বার্থের মারাত্মক ক্ষতি করেছে। সহযোগিতার একটি চমৎকার ব্যবস্থাকে তারা তছনছ করে দিয়েছে।’
এই ‘চমৎকার ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটে আরবদের বিরুদ্ধে ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ইসরাইলের জয়লাভের মাধ্যমে। এই দুটি যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিমতীর, গাজা ও পূর্ব জেরুসালেম দখল করে। এসব এলাকায় ইহুদিদের আগমন শুরু হয় বসতি স্থাপন করার জন্য। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এটাকে ইসরাইলের বর্ণবাদী পদক্ষেপ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখার কোনো চেষ্টা করেনি। বরং ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের সমর্থকরা বা ‘ইসরাইলি লবি’ কংগ্রেস সদস্যদের মতামতকে প্রভাবিত করার জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ সব ধরনের সমর্থন পেতে শুরু করে।
জিমি কার্টারের পর থেকে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান বসতি স্থাপন দুই রাষ্ট্র সমাধানকে ক্রমেই অসম্ভব করে তুলেছে। এমনকি ইসরাইল ১৯৮০ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ছয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকারকে সহযোগিতা করে। এসব বোমা ফেলার জন্য দেশটির যুদ্ধবিমানে প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তি ও সরঞ্জামও যুক্ত করে দেয় ইসরাইল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সবকিছু জেনেও এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নীরবতার সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ১৯৮২ সালে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচিম বেগিন লেবাননে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) শরণার্থীশিবিরগুলোয় হামলা চালায়। ইসরাইলের এই সামরিক আগ্রাসনে ফিলিস্তিনি ও লেবানিজসহ ১৮ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ মানুষ।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান লেবাননে ইসরাইলের এই ‘হলোকাস্ট’ বন্ধ করার দাবি জানান। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আদালত লেবাননে ইসরাইলি বাহিনীর এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডকে ‘হলোকাস্ট’ না বলে ‘সম্ভাব্য গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু এটাকে যে ভাষাতেই বলা হোক না কেন, ইসরাইল ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে, লেবানন হত্যাকাণ্ড তারই ধারাবাহিকতা মাত্র এবং তা এখন গাজায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মেনাচিম বেগিন, অ্যারিয়েল শ্যারন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো ইহুদি বর্ণবাদী দস্যুরা মধ্যপ্রাচ্যে ‘ইসরাইলি শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ফিলিস্তিনি গণহত্যার পাশাপাশি তাদের ভূখণ্ড দখলের ওপর জোর দিচ্ছেন।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা কখনোই ইসরাইলের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে তাদের হাতিয়ার করেনি। এমনকি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলাও ইসরাইলের সন্ত্রাসী তৎপরতার ধারে-কাছেও নেই। হামাস সেদিন বিশ্বের ‘বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার’ পাহারারত ইসরাইলি সেনা ইউনিটগুলোকে টার্গেট করে এই হামলা করেছিল।
কিন্তু ইসরাইলি কর্মকর্তারা ও মিডিয়া দাবি করতে থাকে, হামাস সদস্যরা ১ হাজার ২০০-এর বেশি সাধারণ লোককে হত্যা করেছে এবং ৪০টি শিশুকে হত্যার পর তাদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, যা ছিল মারাত্মক একটি অপপ্রচার। কোনো তদন্তেই এ ধরনের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এসব অপপ্রচারের মূল লক্ষ্য ছিল গাজায় গণহত্যা শুরু করা।
ইসরাইলের ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক ও লেখক গিদিওন লেভি বলেছেন, ‘নব্য নাৎসিবাদী’ ইসরাইল গাজাকে দুর্ভিক্ষকবলিত একটি উন্মুক্ত বাংকারে পরিণত করেছে। অন্যদিকে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টও গাজায় ইসরাইলি বর্বরতাকে নাৎসিবাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সম্প্রতি ইসরাইলির সেনাবাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দা প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় হামলায় নিহত প্রতি ছয়জন ফিলিস্তিনিদের মধ্যে পাঁচজনই বেসামরিক মানুষ। এই হিসেবে নিহত ফিলিস্তিনিদের শতকরা ৮৩ জনই বেসামরিক মানুষ। ইসরাইলের +৯৭২ ম্যাগাজিনের হিব্রু ভাষার সহযোগী প্রকাশনা ‘লোকাল কল’ এবং প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের যৌথ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রতিবেদনের এই তথ্য প্রকাশ্যে আসে। এ তথ্য উঠে এসেছে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোপন গোয়েন্দা তথ্যভান্ডারে নাম-পরিচয়সহ ৮ হাজার ৯০০ জন হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) যোদ্ধাকে নিহত বা ‘সম্ভাব্য নিহত’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এই সময় পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ইসরাইলি সেনাদের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৩ হাজার। অর্থাৎ এই হিসাব অনুযায়ী নিহত ফিলিস্তিনির মাত্র ১৭ শতাংশ যোদ্ধা এবং ৮৩ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক।
এ বিষয়ে জানার জন্য +৯৭২ ম্যাগাজিন ও লোকাল কল ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এ তথ্যভান্ডারের নিহত হামাস এবং পিআইজে সদস্যদের সংখ্যার ব্যাপারে কোনো আপত্তি করেনি।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এই বর্বরতায় মার্কিন সমর্থন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মার্কিন স্বার্থের দোহাই দিয়ে ইসরাইলের প্রতি শর্তহীন সমর্থন বন্ধে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট নীতিগতভাবে কঠোর অবস্থান নেবেন কি না—সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ওপর বই লেখার জন্য হ্যারি ট্রুম্যান বুক অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হিসেবে আমার এ কথা শুনতে খুবই বিস্ময়কর লাগে, ‘হ্যারি ট্রুম্যান থেকে শুরু করে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট’ ইসরাইলের প্রতি ‘অটুট সমর্থন’ দিয়েছেন।
গাজায় গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি ইসরাইল সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সম্পর্কে এই দাবিটি প্রায়ই করে ইসরাইল, যা মোটেও সত্য নয়।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভকে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে যে তুলনা করেছেন, তা ঐতিহাসিকভাবে অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। অশিক্ষিত লোকরাই এ ধরনের কথা বলবে। ইসরাইলের প্রতি আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের ‘অটুট সমর্থন’ এবং নাৎসি জার্মানি নিয়ে ইঙ্গিত করার বিষয়টি যাচাই করে দেখা যেতে পারে।
ট্রুম্যান ১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন, ইহুদিরা শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করার পথে অগ্রসর হচ্ছে। ট্রুম্যানের পর প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ারও ফিলিস্তিনি গণহত্যার জন্য ইসরাইলের নিন্দা করেছিলেন।
ফিলিস্তিনি গণহত্যার প্রথম ঘটনাটি ঘটে পশ্চিমতীরের কিবায়া গ্রামে। ইসরাইলের ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের নেতৃত্বে প্যারাট্রুপাররা ওই গ্রামের ‘প্রত্যেক পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে’। টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছিল।
নিউ ইয়র্ক পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে কিবায়া হত্যাকাণ্ডকে ১৯৪২ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার লিডিস এলাকাকে ইহুদিমুক্ত করার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছিল।
ইসরাইলি ইতিহাসবিদ বেনি মরিসের তথ্য অনুযায়ী ‘১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ২ হাজার ৭০০ আরব অনুপ্রবেশকারী এবং এবং প্রায় ৫ হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও পুলিশ।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘নিহতদের অধিকাংশই ছিল নিরস্ত্র’। এর অর্থ হচ্ছে নিহত এই ফিলিস্তিনিরা ছিল ভেড়া চরানো রাখাল, কৃষক ও শরণার্থী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার ফিলিস্তিনি গণহত্যার নিন্দা করেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে মিসরে আক্রমণ সংগঠিত করার জন্য দুই ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন এবং ফ্রান্সেরও নিন্দা করেছিলেন তিনি।
ইসরাইলের যুদ্ধের ধরন ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। তেল আবিবের কাছে কাফির কাসিম এলাকায় ৪৯ জন ফিলিস্তিনি গ্রামবাসীকে হত্যা করার মাধ্যমে ইসরাইলের হামলা শুরু হয়। এরপর তারা গাজার খান ইউনিস ও রাফায় শরণার্থীদের ওপর গণহত্যা চালায়। ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইজেনহাওয়ার ইসরাইলকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, যদি তারা গাজা উপত্যকা থেকে সরে না আসে, তাহলে তিনি ইসরাইলের বন্ড বিক্রি বন্ধ করে দেবেন। ফলে ইসরাইল বাধ্য হয় গাজা থেকে দ্রুত সেনা প্রত্যাহার করতে।
এরপরের বছরই ইসরাইল পরমাণু বোমা তৈরির উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়নকে বলেন, তারা যদি তাদের পরমাণু কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে না দেয়, তাহলে ‘ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন’ মারাত্মক অচলাবস্থার মধ্যে পড়বে। তখন বেন গুরিয়ন দাবি করেছিলেন, ইসরাইল পরমাণু জ্বালানির জন্য তার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
ইসরাইল ১৯৬৬ সালে জর্ডান আক্রমণ করার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ইসরাইলের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এ সময় তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘ইসরাইল আমাদের এবং একই সঙ্গে তাদেরও স্বার্থের মারাত্মক ক্ষতি করেছে। সহযোগিতার একটি চমৎকার ব্যবস্থাকে তারা তছনছ করে দিয়েছে।’
এই ‘চমৎকার ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটে আরবদের বিরুদ্ধে ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ইসরাইলের জয়লাভের মাধ্যমে। এই দুটি যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিমতীর, গাজা ও পূর্ব জেরুসালেম দখল করে। এসব এলাকায় ইহুদিদের আগমন শুরু হয় বসতি স্থাপন করার জন্য। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এটাকে ইসরাইলের বর্ণবাদী পদক্ষেপ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখার কোনো চেষ্টা করেনি। বরং ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের সমর্থকরা বা ‘ইসরাইলি লবি’ কংগ্রেস সদস্যদের মতামতকে প্রভাবিত করার জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ সব ধরনের সমর্থন পেতে শুরু করে।
জিমি কার্টারের পর থেকে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান বসতি স্থাপন দুই রাষ্ট্র সমাধানকে ক্রমেই অসম্ভব করে তুলেছে। এমনকি ইসরাইল ১৯৮০ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ছয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকারকে সহযোগিতা করে। এসব বোমা ফেলার জন্য দেশটির যুদ্ধবিমানে প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তি ও সরঞ্জামও যুক্ত করে দেয় ইসরাইল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সবকিছু জেনেও এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নীরবতার সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ১৯৮২ সালে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচিম বেগিন লেবাননে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) শরণার্থীশিবিরগুলোয় হামলা চালায়। ইসরাইলের এই সামরিক আগ্রাসনে ফিলিস্তিনি ও লেবানিজসহ ১৮ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ মানুষ।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান লেবাননে ইসরাইলের এই ‘হলোকাস্ট’ বন্ধ করার দাবি জানান। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আদালত লেবাননে ইসরাইলি বাহিনীর এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডকে ‘হলোকাস্ট’ না বলে ‘সম্ভাব্য গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু এটাকে যে ভাষাতেই বলা হোক না কেন, ইসরাইল ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে, লেবানন হত্যাকাণ্ড তারই ধারাবাহিকতা মাত্র এবং তা এখন গাজায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মেনাচিম বেগিন, অ্যারিয়েল শ্যারন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো ইহুদি বর্ণবাদী দস্যুরা মধ্যপ্রাচ্যে ‘ইসরাইলি শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ফিলিস্তিনি গণহত্যার পাশাপাশি তাদের ভূখণ্ড দখলের ওপর জোর দিচ্ছেন।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা কখনোই ইসরাইলের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে তাদের হাতিয়ার করেনি। এমনকি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলাও ইসরাইলের সন্ত্রাসী তৎপরতার ধারে-কাছেও নেই। হামাস সেদিন বিশ্বের ‘বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার’ পাহারারত ইসরাইলি সেনা ইউনিটগুলোকে টার্গেট করে এই হামলা করেছিল।
কিন্তু ইসরাইলি কর্মকর্তারা ও মিডিয়া দাবি করতে থাকে, হামাস সদস্যরা ১ হাজার ২০০-এর বেশি সাধারণ লোককে হত্যা করেছে এবং ৪০টি শিশুকে হত্যার পর তাদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, যা ছিল মারাত্মক একটি অপপ্রচার। কোনো তদন্তেই এ ধরনের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এসব অপপ্রচারের মূল লক্ষ্য ছিল গাজায় গণহত্যা শুরু করা।
ইসরাইলের ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক ও লেখক গিদিওন লেভি বলেছেন, ‘নব্য নাৎসিবাদী’ ইসরাইল গাজাকে দুর্ভিক্ষকবলিত একটি উন্মুক্ত বাংকারে পরিণত করেছে। অন্যদিকে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টও গাজায় ইসরাইলি বর্বরতাকে নাৎসিবাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সম্প্রতি ইসরাইলির সেনাবাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দা প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় হামলায় নিহত প্রতি ছয়জন ফিলিস্তিনিদের মধ্যে পাঁচজনই বেসামরিক মানুষ। এই হিসেবে নিহত ফিলিস্তিনিদের শতকরা ৮৩ জনই বেসামরিক মানুষ। ইসরাইলের +৯৭২ ম্যাগাজিনের হিব্রু ভাষার সহযোগী প্রকাশনা ‘লোকাল কল’ এবং প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের যৌথ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রতিবেদনের এই তথ্য প্রকাশ্যে আসে। এ তথ্য উঠে এসেছে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোপন গোয়েন্দা তথ্যভান্ডারে নাম-পরিচয়সহ ৮ হাজার ৯০০ জন হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) যোদ্ধাকে নিহত বা ‘সম্ভাব্য নিহত’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এই সময় পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ইসরাইলি সেনাদের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৩ হাজার। অর্থাৎ এই হিসাব অনুযায়ী নিহত ফিলিস্তিনির মাত্র ১৭ শতাংশ যোদ্ধা এবং ৮৩ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক।
এ বিষয়ে জানার জন্য +৯৭২ ম্যাগাজিন ও লোকাল কল ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এ তথ্যভান্ডারের নিহত হামাস এবং পিআইজে সদস্যদের সংখ্যার ব্যাপারে কোনো আপত্তি করেনি।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এই বর্বরতায় মার্কিন সমর্থন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মার্কিন স্বার্থের দোহাই দিয়ে ইসরাইলের প্রতি শর্তহীন সমর্থন বন্ধে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট নীতিগতভাবে কঠোর অবস্থান নেবেন কি না—সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১২ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে