মাহবুব উল্লাহ
বিদেশে খালেদা জিয়ার বহু প্রতীক্ষিত চিকিৎসা গ্রহণ শেষ পর্যন্ত সফল হতে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনও ভারতে পলায়নের আগে আমরা ভাবতে পারিনি খালেদা জিয়া বিদেশে উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারবেন। শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন কারাগারেই তার মৃত্যু হোক। এর আগে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, বারবার শুনি যায় যায়, মরে মরে।
খালেদা জিয়া মরলেই তিনি আনন্দ পাবেন- এমনটাই ছিল তার অভিব্যক্তিময় উক্তি। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়েও শেখ হাসিনা বিদ্রূপের হুল ফুটিয়েছেন। খালেদা জিয়া নানা রোগে আক্রান্ত। তার হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি ও আর্থ্রারাইটিসের জটিলতা রয়েছে। একজন বয়স্ক মানুষ একসঙ্গে এতগুলো রোগে ভুগলে তার আয়ু নিয়ে দুশ্চিন্তা হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।
তিনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেত্রী। তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন, একাধিকবার একজন প্রার্থী যে কটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে তার সবগুলোতেই জয়ী হয়ে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার এ ধরনের সাফল্যের কোনো রেকর্ড নেই। রংপুরের নির্বাচনে শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছেন। পরাজিত হয়েছেন সাদেক হোসেন খোকা ও মেজর (অব.) মান্নানের সঙ্গে নির্বাচন করে। এ রকম একজন মানুষ খালেদা জিয়ার চরম বিদ্বেষী হবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার একটি অসুস্থতা নিয়ে খুবই আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, লিভার সিরোসিস কাদের হয়? তিনি আকারে-ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছেন খালেদা জিয়া মদ্যপান করতেন বলেই তার লিভার সিরোসিস হয়েছে। চিকিৎসাবিশেষজ্ঞরা জানেন মদ্যপান ছাড়াও লিভার সিরোসিস হতে পারে। হতে পারে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার থেকে। হতে পারে কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়।
হতে পারে স্লো পয়োজনিংয়ের ফলে। অনেকে আশঙ্কা করেন, খালেদা জিয়া যখন কারাবন্দি ছিলেন, তখন তার খাবারে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। ফলে এই সন্দেহ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিস নিয়ে শেখ হাসিনা যে মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ। শেখ হাসিনা কখনোই বুঝতে পারেননি তার জিহ্বা তার বড় শত্রু।
শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন করছিলেন, তখন শেখ হাসিনার একটি মন্তব্য দাবানল সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গালমন্দ করে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা চাকরি পাবে না, তো পাবে কি রাজাকারের সন্তান ও নাতিপুতিরা? নিষ্পাপ, নির্দোষ শিক্ষার্থীদের ওপর রাজাকারের লেবেল সেঁটে দেওয়া ছিল অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং শতসহস্র শিক্ষার্থীর ক্রুদ্ধ প্রতিবাদে জ্বলে ওঠার জন্য যথেষ্ট।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যগুলোই শুধু তার অসূয়া প্রকাশের একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। তারও আগে যখন ঢাকা সেনানিবাসে খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তখন গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে সেই বাড়ি থেকে কিছু মদের বোতল ও আপত্তিকর ছবি উদ্ধারের দৃশ্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। অথচ পুরো ব্যাপারটি ছিল একটি সাজানো নাটক। উদ্দেশ্য ওই একটিই। খালেদা জিয়ার চরিত্র হনন।
খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় দণ্ডিত করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পুরাতন ভবনে দুই বছর কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। এই কারাভবনে খালেদা জিয়াই ছিলেন একমাত্র বন্দি। খালেদা জিয়াকে বস্তুত সলিটারি ইমপ্রিজনমেন্টে আবদ্ধ রাখা হয়। শুধু তাই নয়, পুরাতন কারাগারের যে প্রকোষ্ঠে তাকে রাখা হয়, সেই প্রকোষ্ঠটি ছিল স্যাঁতসেতে এবং ইঁদুর, চামচিকা ও তেলাপোকার আবাস।
মনে হচ্ছিল, জার্মানির স্পান্ডো কারাগারে নাজি যুদ্ধাপরাধী বন্দি উইলহেম স্ট্রসকে যেভাবে দিনের পর দিন একলা এক বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল, খালেদা জিয়ার প্রতিও শেখ হাসিনার সরকার অনুরূপ আচরণ করেছে। খালেদা জিয়াকে কি নাজি যুদ্ধাপরাধীদের সমতুল্য ভাবা যায়?
কারাযন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা, রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদের বাড়বাড়ন্ত খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ওপর অনেক ধকল সৃষ্টি করেছে। অবশেষে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর দিন ৬ আগস্ট তিনি কারাযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান। তার দল তাকে মুক্ত করার জন্য নানা ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু হাসিনার টনক নড়াতে পারেনি। কারণ হাসিনা লৌহদৃঢ় মুষ্টিতে দেশ শাসন করছিলেন। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা মামলা ও আয়নাঘরের বিভীষিকা দিয়ে সাড়ে ১৫ বছর শেখ হাসিনা সব প্রতিবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে রেখেছিলেন।
মনে হয়েছিল এই অমানিসার অবসান আমরা হয়তো আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যাব না। খালেদা জিয়াও চারদিকের হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে তীব্র থেকে তীব্রতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তাকে যখন কারাগার থেকে নিজ গৃহে বন্দি করা হয়, সে সময় তিনি বেশ কবার ভয়াবহ অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার দলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, তিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। দেশীয় চিকিৎসকরা তার প্রাণরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন।
কিন্তু তাদেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। ঢাকার হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না। একপর্যায়ে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন চিকিৎসক ঢাকায় এসে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাকে চিকিৎসা দেন। এই চিকিৎসাও ছিল সাময়িক স্বস্তিদায়ক। কিন্তু তার চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশের হাসপাতালে পাঠানোর দাবি হাসিনার সরকার মেনে নেয়নি। নির্দয়তা, নিষ্ঠুরতা আর কাকে বলে? স্বৈরশাসকরা তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণই করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেকার্থিজমের যুগে মতাদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি ভয়ংকর নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছিল। বিজ্ঞানী রোজেনবার্গ দম্পতিকে মিথ্যা অভিযোগে ইলেকট্রিক চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ গঠন করা হয়, তা ছিল ডাহা মিথ্যা। এভাবেই যখন একটি দেশ গণতন্ত্রের পথ থেকে পদস্খলিত হয়, তখনই নাগরিকদের ওপর এমন নিষ্ঠুরতার চর্চা করা হয়।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে নাগরিকদের ভোটাধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যে একনায়কত্ববাদী শাসন কায়েম করেছিলেন, তা ২৪-এর ৫ আগস্ট নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শেখ হাসিনাকে তার তীর্থস্থান ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। অন্যদিকে গণতন্ত্রের সংগ্রামীরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিশান বরদাররা নতুন মুক্ত স্বাধীন জীবনের স্বাদ খুঁজে পায়। কারামুক্ত হওয়ার কয়েক মাস আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল।
আমার অনুজ মাহফুজ উল্লাহর ইংরেজি ভাষায় রচিত খালেদা জিয়ার জীবনী গ্রন্থ, ‘বেগম খালেদা জিয়া, হার লাইফ হার স্টোরি’র বাংলা অনুবাদ গ্রন্থটি তার হাতে তুলে দিতে গিয়ে বন্দি খালেদা জিয়ার দেখা পেয়েছিলাম। তাকে সেই সন্ধ্যায় খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছিল এবং তিনি কণ্ঠ উঁচু করে কথা বলতে পারছিলেন না। তবে বুঝতে পারছিলাম তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন।
আমার মনে হয়েছে কারামুক্তির পর খালেদা জিয়া নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছেন। তার চেহারার নিষ্প্রভতা কেটে গেছে। তাকে আগের মতোই অনেকটা উজ্জ্বল মনে হয়েছে। ৭ জানুয়ারি তিনি লন্ডনের পথে উন্নততর চিকিৎসার জন্য তার বাসভবন থেকে রওনা হয়েছিলেন। বিমানবন্দরের পথে সড়কের দুই পাশে তার কর্মী, সমর্থক ও গুণগ্রাহীরা যেভাবে হৃদয় নিংড়ানো সুভাশিস নিয়ে বিদায় জানিয়েছেন, তাও ছিল তুলনারহিত।
দীর্ঘ বছর পর তিনি উৎফুল্ল জনতার মুখ দেখতে পেয়েছেন। তার মনোবেদনা লাঘবে উৎফুল্ল জনতার মুখ এক শক্তিশালী এলিক্সির হিসেবে কাজ করেছে। প্রার্থনা করি, তিনি যেন পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সেনা দিবসে তাকে সেনাকুঞ্জে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে বিরল সংবর্ধনা দিয়েছে এবং তার বিদেশযাত্রার আগে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ও তার স্ত্রী তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে রাজনীতিতে মাইনাস টু আশঙ্কার বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন। এখন ভাবতে পারি খালেদা জিয়ার চিকিৎসাযাত্রা ও দেশের গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা এক ও অভিন্ন হয়ে উঠেছে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক
এমবি
বিদেশে খালেদা জিয়ার বহু প্রতীক্ষিত চিকিৎসা গ্রহণ শেষ পর্যন্ত সফল হতে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনও ভারতে পলায়নের আগে আমরা ভাবতে পারিনি খালেদা জিয়া বিদেশে উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারবেন। শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন কারাগারেই তার মৃত্যু হোক। এর আগে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, বারবার শুনি যায় যায়, মরে মরে।
খালেদা জিয়া মরলেই তিনি আনন্দ পাবেন- এমনটাই ছিল তার অভিব্যক্তিময় উক্তি। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়েও শেখ হাসিনা বিদ্রূপের হুল ফুটিয়েছেন। খালেদা জিয়া নানা রোগে আক্রান্ত। তার হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি ও আর্থ্রারাইটিসের জটিলতা রয়েছে। একজন বয়স্ক মানুষ একসঙ্গে এতগুলো রোগে ভুগলে তার আয়ু নিয়ে দুশ্চিন্তা হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।
তিনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেত্রী। তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন, একাধিকবার একজন প্রার্থী যে কটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে তার সবগুলোতেই জয়ী হয়ে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার এ ধরনের সাফল্যের কোনো রেকর্ড নেই। রংপুরের নির্বাচনে শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছেন। পরাজিত হয়েছেন সাদেক হোসেন খোকা ও মেজর (অব.) মান্নানের সঙ্গে নির্বাচন করে। এ রকম একজন মানুষ খালেদা জিয়ার চরম বিদ্বেষী হবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার একটি অসুস্থতা নিয়ে খুবই আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, লিভার সিরোসিস কাদের হয়? তিনি আকারে-ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছেন খালেদা জিয়া মদ্যপান করতেন বলেই তার লিভার সিরোসিস হয়েছে। চিকিৎসাবিশেষজ্ঞরা জানেন মদ্যপান ছাড়াও লিভার সিরোসিস হতে পারে। হতে পারে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার থেকে। হতে পারে কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়।
হতে পারে স্লো পয়োজনিংয়ের ফলে। অনেকে আশঙ্কা করেন, খালেদা জিয়া যখন কারাবন্দি ছিলেন, তখন তার খাবারে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। ফলে এই সন্দেহ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিস নিয়ে শেখ হাসিনা যে মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ। শেখ হাসিনা কখনোই বুঝতে পারেননি তার জিহ্বা তার বড় শত্রু।
শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন করছিলেন, তখন শেখ হাসিনার একটি মন্তব্য দাবানল সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গালমন্দ করে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা চাকরি পাবে না, তো পাবে কি রাজাকারের সন্তান ও নাতিপুতিরা? নিষ্পাপ, নির্দোষ শিক্ষার্থীদের ওপর রাজাকারের লেবেল সেঁটে দেওয়া ছিল অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং শতসহস্র শিক্ষার্থীর ক্রুদ্ধ প্রতিবাদে জ্বলে ওঠার জন্য যথেষ্ট।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যগুলোই শুধু তার অসূয়া প্রকাশের একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। তারও আগে যখন ঢাকা সেনানিবাসে খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তখন গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে সেই বাড়ি থেকে কিছু মদের বোতল ও আপত্তিকর ছবি উদ্ধারের দৃশ্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। অথচ পুরো ব্যাপারটি ছিল একটি সাজানো নাটক। উদ্দেশ্য ওই একটিই। খালেদা জিয়ার চরিত্র হনন।
খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় দণ্ডিত করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পুরাতন ভবনে দুই বছর কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। এই কারাভবনে খালেদা জিয়াই ছিলেন একমাত্র বন্দি। খালেদা জিয়াকে বস্তুত সলিটারি ইমপ্রিজনমেন্টে আবদ্ধ রাখা হয়। শুধু তাই নয়, পুরাতন কারাগারের যে প্রকোষ্ঠে তাকে রাখা হয়, সেই প্রকোষ্ঠটি ছিল স্যাঁতসেতে এবং ইঁদুর, চামচিকা ও তেলাপোকার আবাস।
মনে হচ্ছিল, জার্মানির স্পান্ডো কারাগারে নাজি যুদ্ধাপরাধী বন্দি উইলহেম স্ট্রসকে যেভাবে দিনের পর দিন একলা এক বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল, খালেদা জিয়ার প্রতিও শেখ হাসিনার সরকার অনুরূপ আচরণ করেছে। খালেদা জিয়াকে কি নাজি যুদ্ধাপরাধীদের সমতুল্য ভাবা যায়?
কারাযন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা, রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদের বাড়বাড়ন্ত খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ওপর অনেক ধকল সৃষ্টি করেছে। অবশেষে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর দিন ৬ আগস্ট তিনি কারাযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান। তার দল তাকে মুক্ত করার জন্য নানা ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু হাসিনার টনক নড়াতে পারেনি। কারণ হাসিনা লৌহদৃঢ় মুষ্টিতে দেশ শাসন করছিলেন। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা মামলা ও আয়নাঘরের বিভীষিকা দিয়ে সাড়ে ১৫ বছর শেখ হাসিনা সব প্রতিবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে রেখেছিলেন।
মনে হয়েছিল এই অমানিসার অবসান আমরা হয়তো আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যাব না। খালেদা জিয়াও চারদিকের হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে তীব্র থেকে তীব্রতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তাকে যখন কারাগার থেকে নিজ গৃহে বন্দি করা হয়, সে সময় তিনি বেশ কবার ভয়াবহ অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার দলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, তিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। দেশীয় চিকিৎসকরা তার প্রাণরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন।
কিন্তু তাদেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। ঢাকার হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না। একপর্যায়ে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন চিকিৎসক ঢাকায় এসে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাকে চিকিৎসা দেন। এই চিকিৎসাও ছিল সাময়িক স্বস্তিদায়ক। কিন্তু তার চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশের হাসপাতালে পাঠানোর দাবি হাসিনার সরকার মেনে নেয়নি। নির্দয়তা, নিষ্ঠুরতা আর কাকে বলে? স্বৈরশাসকরা তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণই করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেকার্থিজমের যুগে মতাদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি ভয়ংকর নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছিল। বিজ্ঞানী রোজেনবার্গ দম্পতিকে মিথ্যা অভিযোগে ইলেকট্রিক চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ গঠন করা হয়, তা ছিল ডাহা মিথ্যা। এভাবেই যখন একটি দেশ গণতন্ত্রের পথ থেকে পদস্খলিত হয়, তখনই নাগরিকদের ওপর এমন নিষ্ঠুরতার চর্চা করা হয়।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে নাগরিকদের ভোটাধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যে একনায়কত্ববাদী শাসন কায়েম করেছিলেন, তা ২৪-এর ৫ আগস্ট নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শেখ হাসিনাকে তার তীর্থস্থান ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। অন্যদিকে গণতন্ত্রের সংগ্রামীরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিশান বরদাররা নতুন মুক্ত স্বাধীন জীবনের স্বাদ খুঁজে পায়। কারামুক্ত হওয়ার কয়েক মাস আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল।
আমার অনুজ মাহফুজ উল্লাহর ইংরেজি ভাষায় রচিত খালেদা জিয়ার জীবনী গ্রন্থ, ‘বেগম খালেদা জিয়া, হার লাইফ হার স্টোরি’র বাংলা অনুবাদ গ্রন্থটি তার হাতে তুলে দিতে গিয়ে বন্দি খালেদা জিয়ার দেখা পেয়েছিলাম। তাকে সেই সন্ধ্যায় খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছিল এবং তিনি কণ্ঠ উঁচু করে কথা বলতে পারছিলেন না। তবে বুঝতে পারছিলাম তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন।
আমার মনে হয়েছে কারামুক্তির পর খালেদা জিয়া নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছেন। তার চেহারার নিষ্প্রভতা কেটে গেছে। তাকে আগের মতোই অনেকটা উজ্জ্বল মনে হয়েছে। ৭ জানুয়ারি তিনি লন্ডনের পথে উন্নততর চিকিৎসার জন্য তার বাসভবন থেকে রওনা হয়েছিলেন। বিমানবন্দরের পথে সড়কের দুই পাশে তার কর্মী, সমর্থক ও গুণগ্রাহীরা যেভাবে হৃদয় নিংড়ানো সুভাশিস নিয়ে বিদায় জানিয়েছেন, তাও ছিল তুলনারহিত।
দীর্ঘ বছর পর তিনি উৎফুল্ল জনতার মুখ দেখতে পেয়েছেন। তার মনোবেদনা লাঘবে উৎফুল্ল জনতার মুখ এক শক্তিশালী এলিক্সির হিসেবে কাজ করেছে। প্রার্থনা করি, তিনি যেন পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সেনা দিবসে তাকে সেনাকুঞ্জে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে বিরল সংবর্ধনা দিয়েছে এবং তার বিদেশযাত্রার আগে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ও তার স্ত্রী তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে রাজনীতিতে মাইনাস টু আশঙ্কার বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন। এখন ভাবতে পারি খালেদা জিয়ার চিকিৎসাযাত্রা ও দেশের গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা এক ও অভিন্ন হয়ে উঠেছে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক
এমবি
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৩ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৩ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৪ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে