ঋণ, ভ্যাট এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য

আব্দুল্লাহ আল-রায়হান
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২: ৪০

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে বাংলাদেশে সম্প্রতি ১৫ শতাংশ ভ্যাটবৃদ্ধির ঘোষণা এসেছে। ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় বাংলাদেশ। এই ঋণ এবং তার ফলে ভ্যাটবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, কীভাবে এই পদক্ষেপ বিদ্যমান আয়বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, তা একটু বোঝার চেষ্টা করব আমরা।

বিজ্ঞাপন

আইএমএফ সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণ প্রদানের শর্ত হিসেবে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব করে । এর মধ্যে থাকে ভর্তুকি কমানো, সরকারি ব্যয়ের পুনর্গঠন এবং কর-কাঠামোর পরিবর্তন। যেমনÑ খাদ্য, জ্বালানি, এবং কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো, যা সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। একইভাবে, সরকারি ব্যয়ের পুনর্বিন্যাসের ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে প্রতিরক্ষা বা পরিকাঠামো প্রকল্পে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা সামাজিক সুরক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করে। এ ধরনের নীতির ফলাফল কী হতে পারে, তা ১৯৯৮ এবং ২০০২ সালে আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে ইন্দোনেশিয়ার সরকার কর্তৃক যথাক্রমে চাল এবং তেলের ভর্তুকি কমানোর পরের অবস্থা দেখলে টের পাওয়া যায়।

ভ্যাট একটি পরোক্ষ কর, এটি আয়ের ভিত্তিতে নয়, বরং ভোগের ভিত্তিতে আরোপিত হয়। ধরা যাক, অর্থনীতির উচ্চস্তরে থাকা একজন ব্যক্তি ১০ হাজার টাকা আয় করেন এবং একটি পণ্যের জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেন। অন্যদিকে, অর্থনীতির নিম্নস্তরে থাকা একজন ব্যক্তি ৫০০ টাকা আয় করেন এবং একই হারে ভ্যাট দেন। যদিও ভ্যাটের হার উভয়ের জন্যই ১৫ শতাংশ, তবে ধনী ব্যক্তির আয়ের তুলনায় ভ্যাটের প্রভাব তার জীবনযাত্রায় তেমন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু স্বল্প-আয়ের ব্যক্তির জন্য এটি বড় অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। অর্থনীতির সংবেদী বিশ্লেষণে এটি একটি রিগ্রেসিভ ট্যাক্স, যেখানে নিম্ন-আয়ের ব্যক্তিদের মোট আয়ের আনুপাতিকভাবে বড় অংশ কর হিসেবেই নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে এই নীতির মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমতা ব্যাহত হয়।

ধরা যাক, একটি পণ্যের দাম ১০০ টাকা। এই পণ্যের ওপর ১৫ টাকা ভ্যাট আরোপিত হলে: যার আয় ১০ হাজার টাকা, তার আয়ের মাত্র শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ খরচ হচ্ছে। আর যার আয় ৫০০ টাকা, তার আয়ের ৩ শতাংশ খরচ হচ্ছে।

এ ধরনের কর বৃদ্ধি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তোলার মাধ্যমে এরই মধ্যে ব্যাপকমাত্রায় বিরাজমান ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্যকে আরও ব্যাপকতর করে তোলে। ভ্যাটবৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিক্ষাব্যয় আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা উচ্চভ্যাটের কারণে তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হন, আর এর প্রভাব পড়ে তাদের বিক্রি-বাট্টাতে। দ্রব্যের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই এর চাহিদা কমে। এর চাপ পড়ে ব্যবসায়ীর ওপর। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলকভাবে এই চাপ সামাল দিতে পারলেও স্থানীয় ছোট ব্যবসায়-কাঠামো ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে।

সমস্যা হচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক পলিসি প্রণয়নে। প্রণয়নগুলো এমনভাবে প্রণীত, যার সুফল শুধু রাষ্ট্রের উঁচ্চপর্যায়ে থাকা ব্যক্তিরাই উপভোগ করতে পারবেন। আর রাষ্ট্রের নিচের ধাপে থাকা মানুষ এই নীতিগুলোর শোষণে পড়ে। অর্থনৈতিক পলিসি প্রণয়নের এই পদ্ধতিকে কেতাবি ভাষায় বলা হয় ট্রিকল-ডাউন অ্যাপ্রোচ।

ট্রিকল-ডাউন অ্যাপ্রোচ এমন একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব, যার দাবি হচ্ছে অর্থনীতির শীর্ষস্তরে থাকা ব্যক্তিদের সম্পদ বৃদ্ধি পেলে নিচের স্তরে থাকা ব্যক্তিদের সম্পদও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, শীর্ষস্তরে সম্পদ জমা হলেও তা ভোগের প্রান্তিক প্রবণতা অনুযায়ী নিচের স্তরে যথাযথভাবে পৌঁছায় না; বণ্টন প্রক্রিয়ায় নিম্নস্তরের মানুষদের কাছে যেতে যেতে সম্পদের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। যার ফলে ওপরের স্তর আর নিচের স্তরের মধ্যে আয়বৈষম্য বাড়তে থাকে। এই পদ্ধতিতে সম্পদ শুধু একটি ক্ষুদ্র ধনী গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে, যা সামাজিক বৈষম্যের অন্যতম কারণ।

অর্থনীতির এই প্রক্রিয়া কার্যত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মেরূকরণ ঘটায়। ধনী গোষ্ঠীগুলো পলিসি প্রণয়নে অধিকতর প্রভাব বিস্তার করার দরুন ন্যায্যনীতি বা গণবান্ধব পলিসি প্রণয়নে বাধার সৃষ্টি হয়।

থমাস পিকেটি তার গ্রন্থে ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে দেখিয়েছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আয়বৈষম্যের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, যখন অর্থনীতিতে পুঁজি থেকে আয়ের হার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয়, তখন সম্পদ ক্রমাগত উচ্চশ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। এই প্রক্রিয়া শুধু আয়বৈষম্যই নয়, সম্পদবৈষম্যেরও জন্ম দেয়।

পিকেটির তত্ত্ব অনুযায়ী, এক ধরনের প্যারাডক্স সৃষ্টি করে যেখানে ধনীগোষ্ঠীর পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও বৃহত্তর অর্থনীতির ওপর তার ইতিবাচক প্রভাব থাকে সীমিত, বরং সমাজে একটি কাঠামোগত বৈষম্য তৈরি করে। উদাহরণত, একজন পুঁজিপতি তার বিনিয়োগ থেকে প্রতিবছর যে ১০ শতাংশ মুনাফা অর্জন করেন, তা তার পুঁজির ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে। ফলে, সম্পদের ওপর তার নির্ভরশীলতা বাড়ে এবং নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য সম্পদে প্রবেশাধিকার প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।

এই বৈষম্যের গভীর প্রভাব আছে সামাজিক ক্ষেত্রেও। সম্পদ একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে সমাজের বৃহত্তর অংশের ওপর রাজনৈতিক এবং সামাজিক শোষণ তৈরি হয়। পিকেটি বলেছেন, ‘সম্পদ ধনীশ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকার ফলে ন্যায্যতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।’

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পিকেটির তত্ত্ব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে ট্রিকল-ডাউন অ্যাপ্রোচের ফলাফল হলো, সম্পদ একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। উচ্চস্তরে করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক এলিটরা এই সম্পদ ভোগ করে অথচ নিম্ন আয়ের মানুষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

আইএমএফের অর্থনৈতিক সংস্কারের শর্তাবলির কারণে ভর্তুকি কমানো এবং ভ্যাটবৃদ্ধির মতো পদক্ষেপগুলো দরিদ্র মানুষের জীবনে আরও চাপ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে। পিকেটির তত্ত্বের আলোকে, সম্পদের কেন্দ্রীভবন প্রতিরোধে ন্যায়সংগত করব্যবস্থা এবং সামাজিক-সুরক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে স্থানীয় উৎপাদনব্যবস্থা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাকে উৎসাহিত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব। সম্পদকে শুধু একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সঠিক নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।

তা ছাড়া, এ রকম অর্থনৈতিক পলিসি শুধু অর্থনীতিকেই জরাগ্রস্ত করে না, রাজনীতিকেও অস্থির করে তোলে; রাষ্ট্রের নেতৃত্বপর্যায় এবং তার আশপাশে থাকা আমলাদের দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।

পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় আমরা দেখেছি, একদিকে বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা ঋণ করে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং সেবার দাম বাড়ানো হয়েছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তার এমপি-মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতির পরিমাণ, বেড়েছে বিদেশে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাচার এবং বিলাসবহুল বাড়ি কেনার প্রবণতা। আর সাধারণ মানুষ ফেঁসেছে দুদিক থেকেই; ঋণ পরিশোধে পণ্যের বাড়তি মূল্যও পরিশোধ করতে হয়েছে তাকে, আবার প্রয়োজনীয় খরচ সংকোচন করে জীবনমানের সঙ্গেও আপস করতে হয়েছে তাকে।

ফ্যাসিবাদী আমলে আমরা এ-ও দেখেছি, কীভাবে রাজনৈতিক এলিট আর প্রজা-সাধারণের মধ্যে একটা বৈষম্য তৈরি হয়ে সেটা মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত করেছিল, যা কোটা আন্দোলন হয়ে ফ্যাসিবাদ এবং গণস্বার্থবিরোধী সরকার উৎখাতের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।

বর্তমান সরকার অভ্যুত্থানের সরকার না হলেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ের জন্য মানুষ তাকে মেনে নিয়েছে। মানুষ এ সরকার থেকে সেগুলোই চায়, যা পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী সরকার তাকে তার জীবনযাত্রার সহজীকরণের জন্য সরবরাহ করেনি। একইভাবে মানুষ এ সরকার থেকে তার কিছুই চায় না, যা দ্বারা ফ্যাসিবাদ তাদের শোষণ করেছিল। পরিবর্তিত এ সরকারের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে আমরা জানি। সে কারণেই আমরা চাই এ সরকার জনবান্ধব পলিসি প্রণয়নের পথে হাঁটুক, যাতে মানুষই তার দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি, স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি। নিও-লিবারাল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব পুরোপুরি কাটানো সম্ভব নয়, কিন্তু সেগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। এগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে; যেখানে স্থানীয় শিল্প, কৃষি এবং এসএমই খাতকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিয়ে নিজস্ব উৎপাদনব্যবস্থা এবং ব্যবসাকে উৎসাহিত করা হবে। পাশাপাশি ন্যায়সংগত করব্যবস্থা এবং সামাজিক-সুরক্ষা কার্যক্রম জোরদার করলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমানোও সম্ভব। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও হ্রাস পাবে।

লেখক: গবেষক, অনুবাদক

Email- abdullahalmadani.bup@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত