বিএনপি গড়বে জাতীয় ঐক্যের সরকার

গাজীউল হাসান খান
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ৪৯
গাজীউল হাসান খান

বাংলাদেশে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে শেষ পর্যন্ত যদি ঘোষিত নির্বাচন না হতে পারে, তাহলে দেশে যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের মতো মৌলিক বিষয়গুলো রাতারাতি আরো শক্তিশালী হয়ে যাবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। সে জন্য দরকার ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি বৃহত্তর ঐক্য ও রাজনৈতিক সমঝোতা। যেখানে ৫ আগস্টের আগে দেশের তুলনামূলকভাবে বড় দল বিএনপি ও জামায়াত এবং অন্যদের সম্মিলিত দাবি ছিল মৌলিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ঘোষণা করা, সেখানে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাতেও আবার নতুন করে রাজনৈতিক মতবিরোধ সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, সংগ্রামী ছাত্রদের নবগঠিত সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং দু-একটি ইসলামী দল। এতে বহুল আকাঙ্ক্ষিত কিংবা প্রত্যাশিত নির্বাচনটির আবহ নষ্ট করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ আসছে।

বিজ্ঞাপন
জামায়াত, নাগরিক পার্টি ও তাদের সহমত পোষণকারীরা প্রচার করছেন, নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন কিংবা তার সাংবিধানিক বা আইনি বৈধতা নিশ্চিত করতে না পারলে গত এক বছরের সংস্কার প্রক্রিয়া নেহাত একটি পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে। তাছাড়া সংখ্যানুপাতিকহারে ছোট-বড় সব দলকে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া কিংবা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না দিলে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ হবে না।

নির্বাচনে কম আসন লাভ করা দলগুলোর সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা অসম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে যাচাই করলে দেখা যাবে, যেসব উন্নত দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেকড় গড়তে সক্ষম হয়েছে, সেখানেও বিভিন্ন সাংগঠনিক জটিলতা এবং স্থানীয় জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে চাপিয়ে দেওয়া নেতৃত্ব বা ‘পার্টি ব্যুরোক্রেসি’ নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় জনসাধারণ নেতৃত্বের প্রশ্নে তার প্রার্থী হেরে গেলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অনেক বেশি পছন্দ করে। সে কারণে পশ্চিমা জগতেও এ পদ্ধতি খুব একটা এগোয়নি। আর তা ছাড়া ফ্যাসিবাদী হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি আমাদের নির্বাচনি ব্যবস্থার কোনো পূর্বশর্ত হিসেবে এখনো উঠে আসেনি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল কিংবা জনগণ সে ব্যবস্থার সঙ্গে এখনো পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। তবে ভবিষ্যতে আমাদের দেশে যে এর চর্চা হবে না, এমন কখনোই নয়। এটি উপযুক্ত সময়, সুযোগ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, চব্বিশের জুলাই-আগস্ট সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আমাদের ঘুণে ধরা রাষ্ট্র যন্ত্রটি মেরামত কিংবা জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়টি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ৫০ বছর ধরে এই দেশের গণতন্ত্রমনা চিন্তাশীল মানুষ ভেবেছেÑএকটা স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা কিংবা সরকার এভাবে চলতে পারে না। অপশাসন, শোষণ, দুর্নীতি ও সার্বিক অনাচারে এ দেশের মানুষের শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের স্বপ্নই নয়, মানুষ তার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার কিংবা নেহাত স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিও ছিল না এই দেশে। সেখান থেকে ৫ আগস্ট পরবর্তী স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ কিংবা আধিপত্যবাদমুক্ত বাংলাদেশ আমাদের সামনে কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র মেরামত এবং সার্বিকভাবে সমাজ সংস্কারের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছিল। কিন্তু এ কাজের জন্য আমাদের যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন ছিল।

BNP-Logo

অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কমিশন গঠন করে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলেও নানা বাধা, বিপত্তি এবং প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। বলা হয়েছে, এটি কোনো নির্বাচিত সরকার নয়। এ সরকার অনির্দিষ্টকাল যেমন ক্ষমতায় থাকতে পারে না, তেমনি নির্বাচিত সংসদ ছাড়া কোনো সংস্কারও বাস্তবায়িত হতে পারবে না। সুতরাং অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি উঠল বিভিন্ন দল থেকে। তাতে শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য দলগুলোও পিছিয়ে থাকল না।

কিন্তু সীমাহীন আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত কিছুর পর শেষ পর্যন্ত যখন নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হলো, তখন বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা বিভিন্ন অজুহাতে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার হুমকি দিতে শুরু করল। তাদের মূল দাবিগুলোর কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে সংখ্যানুপাতিকহারে প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং প্রস্তাবিত জুলাই সনদের সাংবিধানিক কিংবা আইনানুগ ভিত্তি প্রদান। অথচ পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বিগত এক বছর সময়কালের মধ্যে উল্লিখিত দলগুলো বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে আন্তঃদলীয়ভাবে কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি। তারা এমনকি তাদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছেও কোনো পূর্বশর্ত দেয়নি যে সেগুলো গ্রহণ করা না হলে অনর্থক নির্বাচনে গিয়ে তাদের কোনো লাভ হবে না।

জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি বিভিন্ন কারণে বিএনপি বহু আগেই নাকচ করে দিয়েছে। দ্বিকক্ষের সংসদের কোথাও তারা এ সময় এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা দেখছে না। জাতীয় নাগরিক পার্টি উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মেনে নিলেও জামায়াত উভয় কক্ষেই তার বাস্তবায়ন চায়। তাছাড়া উল্লিখিত উভয় দলের রয়েছে নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের সাংবিধানিক কিংবা আইনি বৈধতা দেওয়ার শর্ত। নতুবা তারা নির্বাচনে না যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। জুলাই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এতৎসংক্রান্ত সনদের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য কাউন্সিল এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু সে ব্যাপারে অগ্রসর না হয়ে তারা নির্বাচন কমিশন কিংবা অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কর্মচারী কর্মকর্তাদের দেশের বড় দল বিএনপির পক্ষে চলে যাওয়া কিংবা কাজ করার অভিযোগ আনতে শুরু করেছে।

তাদের ধারণা, এ নির্বাচন প্রভাবমুক্ত কিংবা নিরপেক্ষ হবে না। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে তারা সরাসরি এখনো নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। তারা এখনো কোনো পরামর্শ দেয়নি, কীভাবে সামনে নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং অন্য অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের বিশ্বাস। কারণ তারেক রহমানের মতো অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে ড. ইউনূসের কথা বলা উচিত ছিল বলে তারা মনে করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের অধিকাংশের ধারণা, লন্ডন বৈঠকের পর ড. ইউনূস তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপির পক্ষে চলে গেছেন।

কারণ দেশব্যাপী অধিকাংশ মানুষের ধারণা, যখনই নির্বাচন হোক, বিএনপিই ক্ষমতায় যাবে। শুধু তাই নয়, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সমমনা দলগুলো নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করবে বলে অনেকের ধারণা। সে সরকার তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে কাঙ্ক্ষিতভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন ভবিষ্যৎ বিএনপি সরকার কোনো অবস্থাতেই আর আগের মতো হবে না। কারণ তিনি এর মধ্যেই বুঝে গেছেন যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ছাড়া কারো পক্ষেই এককভাবে দেশ পরিচালনা কিংবা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংশয়মুক্ত করা সম্ভব হবে না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতা এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ এখন আর নেই। সরকার ইতোমধ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সুতরাং দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, যাতে সামনের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনটি অর্থহীন হয়ে না পড়ে। প্রয়োজন হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, নির্বাচন কমিশন এবং আন্তঃদলীয় আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন-সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে হবে, জাতীয় স্বার্থ ও সর্বোপরি জাতীয় ঐক্যকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে। এই মুহূর্তে দেশের অনেক চিন্তাশীল মানুষ বলেছেন, সমাজ তার প্রয়োজনেই রাষ্ট্র ও সংবিধান তৈরি করে। একই কারণে সমাজ প্রতিনিয়ত তার সংবিধানের সংস্কার করতে থাকে।

কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি বা সাংবিধানিক পরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান রচনা করে। এ অবস্থায় আমরা কেন আমাদের জাতীয় স্বার্থে মৌলিক সংস্কারগুলো সম্পাদনা করতে পারব না? আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সমৃদ্ধির প্রশ্নে বিদেশি প্রভাব প্রতিপত্তি ও আধিপত্যকে আস্তকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে পারব না? তারেক রহমান বলেছেন, বিএনপির বিজয় ঠেকাতে অনেকে এখন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া বা শর্ত উত্থাপন করছে। তাতে বিএনপি ভীত নয়। কারণ বিএনপি তার জন্মলগ্ন থেকে বিগত ৪৭ বছর রাজপথে সংগ্রাম করেই টিকে রয়েছে। এ দলটি জনগণের বিপুল ভোটে অতীতে বহুবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একাই তার নেতৃত্বে তিনবার বিএনপিকে বিজয়ীর আসন উপহার দিয়েছেন। বিএনপি একটি মধ্যপন্থার গণতান্ত্রিক দল হলেও এটি তার ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার লালন পোষণ করে।

গভীর দেশপ্রেম এবং বিদেশি শক্তির প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীনচেতা মনোভাব এ দলের সমর্থকরা তাদের অন্তরে সবসময়ই ধারণ করে। সে কারণেই বিগত দেড় দশকের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী নির্যাতন-নিষ্পেষণও তাদের কখনো লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির হাতে এই দেশ ও তার জনগণ যতটা নিরাপদ, অন্যদের হাতে ততটা নয়। সে কারণে এই দেশের মানুষ সুযোগ পেলেই তাদের ভোটটা নীরবে গিয়ে বিএনপির বাক্সে ফেলে আসে, চাইতে হয় না।

লেখক : বাংলাদেশে সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

বিএনপি
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত