
ব্রি জে (অব.) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন

বাংলাদেশ আজ এক কৌশলগত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ভৌগোলিকভাবে এটি এমন এক অবস্থানে অবস্থিত যেখানে উদীয়মান শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা, অস্থির সীমান্ত অঞ্চল ও বিভিন্ন বহিঃপ্রভাব একত্রে জটিল বাস্তবতা তৈরি করেছে। স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষা করতে হলে ঢাকার প্রয়োজন একটি স্পষ্ট, ভারসাম্যপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরক্ষা অবস্থান, যেখানে সামরিক সক্ষমতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতি ও বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি একসঙ্গে কাজ করবে। সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ ও কৌশলগত অংশীদারত্বের বৈচিত্র্য অপরিহার্য, তবে যেকোনো জোটে যোগদানের আগে এর সুফল–কুফল সতর্কভাবে যাচাই করতে হয়। বাংলাদেশ কীভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাধীন প্রতিরক্ষা কৌশল গড়ে তুলতে পারে, তা নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা চলছে। পাকিস্তান–সৌদি জোটের সম্ভাব্য প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর কতটা পড়তে পারে, সেটাও এখন বড় বিবেচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের উচিত পরিষ্কার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামরিক কাঠামো আধুনিক করা। প্রতিরক্ষার মূল উদ্দেশ্য চারটি হওয়া উচিত—ভূখণ্ড রক্ষা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও কৌশলগত প্রতিরোধ ক্ষমতা। ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ এ দিকনির্দেশনা দিয়েছে বটে, কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। শুধু বড় আকারের যুদ্ধাস্ত্র কেনা নয়, প্রাধান্য দিতে হবে নজরদারি ব্যবস্থা, রাডার, এয়ার ও সি রিকনাইসেন্স, সাইবার প্রতিরক্ষা, ড্রোন, ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনী গঠনে। এসব বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে সস্তা হলেও কার্যকর প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।
ত্রিবাহিনীর সমন্বয় ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা তৈরি করা জরুরি। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর মধ্যে যৌথ অপারেশন, তথ্য আদান–প্রদান এবং রিয়েল–টাইম গোয়েন্দা সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সীমান্ত সংঘাত বা জরুরি সংকটে দ্রুত মোতায়েনযোগ্য ব্রিগেড ও হেলিবোর্ন ইউনিট গঠন, পাশাপাশি স্থল ও উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি শক্তিশালী করতে হবে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে প্রযুক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি স্থানীয় মানব–নেটওয়ার্কও অপরিহার্য—বিশেষত পার্বত্য এলাকা ও সীমান্ত অঞ্চলে।
সাইবার, তথ্য ও প্রচারণা–যুদ্ধের যুগে গোয়েন্দা সক্ষমতা বাড়াতে হবে প্রযুক্তিনির্ভরভাবে। সিগন্যাল (SIGINT), ইমেজ (IMINT) ও মানব–গোয়েন্দা (HUMINT) সংগ্রহের পাশাপাশি একটি পেশাদার ও জবাবদিহিমূলক কৌশলগত তথ্য সেল গঠন জরুরি, যা ভুয়া খবর ও বিদেশি অপপ্রচারের দ্রুত মোকাবিলা করতে পারবে। অভ্যন্তরীণ বৈধতা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রক্ষায় এ ধরনের কাঠামো অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৌশলগত সম্পদ হলো তার সাগরভিত্তিক অবস্থান। বঙ্গোপসাগর ও এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন রক্ষায় স্বল্পব্যয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে; যেমন উপকূলীয় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাটারি, করভেট, ফাস্ট অ্যাটাক ক্রাফট, টহল জাহাজ, সামুদ্রিক নজরদারি ব্যবস্থা ও নৌবিমান স্কোয়াড্রন গঠন। ‘লিটোরাল ডিফেন্স’ ধারণা অনুযায়ী এমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ছোট কিন্তু গতিশীল নৌবাহিনী প্রতিপক্ষকে ব্যয়বহুল প্রতিরোধে বাধ্য করতে পারে।
এছাড়া বিদেশি অস্ত্রের ওপর অতিনির্ভরতা কমাতে স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্প বিকাশ জরুরি। প্রথম ধাপে রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত (MRO) ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব; পরবর্তী ধাপে লাইসেন্সপ্রাপ্ত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে; যেমন হালকা সাঁজোয়া যান, ছোট অস্ত্র বা যোগাযোগ সরঞ্জাম। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং বিদেশি সরবরাহকারীর ওপর রাজনৈতিক নির্ভরতা কমবে।
আধুনিক যুদ্ধের নতুন রূপ হলো সাইবার–আক্রমণ ও অবকাঠামো ধ্বংস। তাই বাংলাদেশের উচিত একটি সমন্বিত জাতীয় সাইবার প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন, সরকারি ও বেসরকারি নেটওয়ার্কের সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষিত ‘সাইবার রিজার্ভ’ বাহিনী গঠন করা। বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ ও আর্থিক খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় সাইবার–নিরাপত্তা মহড়া নিয়মিত করা উচিত।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সংবেদনশীল অঞ্চলগুলোয় সেনা–অভিযানের পাশাপাশি উন্নয়ন, ভূমি–অধিকার নিশ্চিতকরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসন চালু করতে হবে। উন্নয়ন ও ন্যায়ের পরিবেশ তৈরি হলে বিদ্রোহীদের সামাজিক ভিত্তি দুর্বল হয় এবং বিদেশি প্রভাবের সুযোগ কমে। জনগণের সঙ্গে আস্থানির্ভর সম্পর্কই এখানে টেকসই নিরাপত্তার চাবিকাঠি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কৌশলগত অংশীদারত্বের বৈচিত্র্য। একক শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বিপজ্জনক। বাংলাদেশকে একইসঙ্গে চীন, তুরস্ক, উপসাগরীয় দেশ, আসিয়ান ও পশ্চিমা অংশীদারদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এতে একপক্ষীয় চাপ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে এবং কূটনৈতিক বিকল্প বাড়বে।
এখন প্রশ্ন আসে—বাংলাদেশ কি পাকিস্তান–সৌদি প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দেবে? সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাকিস্তান ও সৌদি আরব পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। এর ফলে একটি নতুন নিরাপত্তা বলয় গড়ে উঠছে, যার লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তায় পারস্পরিক ভূমিকা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের জন্য এ জোটে যোগদানের কিছু সম্ভাব্য সুফল আছে—সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে জ্বালানি–নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাড়তে পারে; সামরিক সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ সুবিধা মেলাতে পারে; এমনকি সংকটে কিছু রাজনৈতিক সুরক্ষাও পাওয়া যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ সরাসরি পাকিস্তানের পারমাণবিক আমব্রেলার ভেতরে চলে আসবে।
তবে এ ধরনের জোটে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঝুঁকিও আছে। আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত এমন পদক্ষেপকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটি সীমান্তে বা কূটনৈতিক অঙ্গনে চাপ বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ‘স্মার্ট ব্যালেন্সিং’ নীতি গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা সহযোগিতা, লজিস্টিকস ও প্রযুক্তি স্থানান্তরভিত্তিক চুক্তি করা যেতে পারে। কিন্তু পারস্পরিক যুদ্ধ–অংশগ্রহণ বা বাধ্যতামূলক প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে পর্যালোচনার প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের ফোর্সেসে গোল অর্জনের ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ বছর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’–এর পূর্ণাঙ্গ পুনর্মূল্যায়ন অপরিহার্য। বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় গোয়েন্দা, নৌ ও আকাশ প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গোয়েন্দা কাঠামো সংস্কার করে ত্রিবাহিনীর মধ্যে সমন্বিত ‘C4ISR’ (Command, Control, Communication, Computer, Intelligence, Surveillance and Reconnaissance) কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত, যা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও উপকূলীয় অঞ্চলে আধুনিক রাডার, স্যাটেলাইট ডেটা ও ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে একটানা নজরদারি চালানো জরুরি, যাতে কোনো অনুপ্রবেশ বা চোরাচালান দ্রুত শনাক্ত করা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রযুক্তি স্থানান্তর, যৌথ প্রশিক্ষণ ও প্রতিরক্ষা উৎপাদন চুক্তি করতে হবে, যাতে বাহিনীর দক্ষতা ও আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
একটি শক্তিশালী ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন সেল’ গঠন করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করবে এবং বিদেশি প্রচারণা ও অপপ্রচারের তাৎক্ষণিক জবাব দেবে। সবশেষে, সামরিক ক্রয়–বিক্রয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বচ্ছতা এবং বেসামরিক তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সুশাসন ও জনআস্থা বজায় থাকে। এভাবেই বাংলাদেশ একটি দক্ষ, আধুনিক ও জবাবদিহিমূলক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে এগোতে পারবে।
বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, আধুনিক ও আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ছাড়া বর্তমান সময়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা কঠিন। প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নের দিকে আমাদের নজর দেওয়ার সময় এসেছে। যুদ্ধ এখন প্রথাগত সমরাস্ত্রের বদলে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক বিবেচনায় নিয়েও আমরা আধুনিক নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে পারি।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা টিকিয়ে রাখার শ্রেষ্ঠ কৌশল হলো আত্মনির্ভর সামরিক সক্ষমতা, সমাজভিত্তিক স্থিতিশীলতা, সাইবার ও তথ্য প্রতিরক্ষা এবং কূটনৈতিক বৈচিত্র্য। এভাবেই বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

বাংলাদেশ আজ এক কৌশলগত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ভৌগোলিকভাবে এটি এমন এক অবস্থানে অবস্থিত যেখানে উদীয়মান শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা, অস্থির সীমান্ত অঞ্চল ও বিভিন্ন বহিঃপ্রভাব একত্রে জটিল বাস্তবতা তৈরি করেছে। স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষা করতে হলে ঢাকার প্রয়োজন একটি স্পষ্ট, ভারসাম্যপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরক্ষা অবস্থান, যেখানে সামরিক সক্ষমতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতি ও বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি একসঙ্গে কাজ করবে। সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ ও কৌশলগত অংশীদারত্বের বৈচিত্র্য অপরিহার্য, তবে যেকোনো জোটে যোগদানের আগে এর সুফল–কুফল সতর্কভাবে যাচাই করতে হয়। বাংলাদেশ কীভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাধীন প্রতিরক্ষা কৌশল গড়ে তুলতে পারে, তা নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা চলছে। পাকিস্তান–সৌদি জোটের সম্ভাব্য প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর কতটা পড়তে পারে, সেটাও এখন বড় বিবেচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের উচিত পরিষ্কার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামরিক কাঠামো আধুনিক করা। প্রতিরক্ষার মূল উদ্দেশ্য চারটি হওয়া উচিত—ভূখণ্ড রক্ষা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও কৌশলগত প্রতিরোধ ক্ষমতা। ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ এ দিকনির্দেশনা দিয়েছে বটে, কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। শুধু বড় আকারের যুদ্ধাস্ত্র কেনা নয়, প্রাধান্য দিতে হবে নজরদারি ব্যবস্থা, রাডার, এয়ার ও সি রিকনাইসেন্স, সাইবার প্রতিরক্ষা, ড্রোন, ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনী গঠনে। এসব বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে সস্তা হলেও কার্যকর প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।
ত্রিবাহিনীর সমন্বয় ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা তৈরি করা জরুরি। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর মধ্যে যৌথ অপারেশন, তথ্য আদান–প্রদান এবং রিয়েল–টাইম গোয়েন্দা সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সীমান্ত সংঘাত বা জরুরি সংকটে দ্রুত মোতায়েনযোগ্য ব্রিগেড ও হেলিবোর্ন ইউনিট গঠন, পাশাপাশি স্থল ও উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি শক্তিশালী করতে হবে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে প্রযুক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি স্থানীয় মানব–নেটওয়ার্কও অপরিহার্য—বিশেষত পার্বত্য এলাকা ও সীমান্ত অঞ্চলে।
সাইবার, তথ্য ও প্রচারণা–যুদ্ধের যুগে গোয়েন্দা সক্ষমতা বাড়াতে হবে প্রযুক্তিনির্ভরভাবে। সিগন্যাল (SIGINT), ইমেজ (IMINT) ও মানব–গোয়েন্দা (HUMINT) সংগ্রহের পাশাপাশি একটি পেশাদার ও জবাবদিহিমূলক কৌশলগত তথ্য সেল গঠন জরুরি, যা ভুয়া খবর ও বিদেশি অপপ্রচারের দ্রুত মোকাবিলা করতে পারবে। অভ্যন্তরীণ বৈধতা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রক্ষায় এ ধরনের কাঠামো অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৌশলগত সম্পদ হলো তার সাগরভিত্তিক অবস্থান। বঙ্গোপসাগর ও এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন রক্ষায় স্বল্পব্যয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে; যেমন উপকূলীয় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাটারি, করভেট, ফাস্ট অ্যাটাক ক্রাফট, টহল জাহাজ, সামুদ্রিক নজরদারি ব্যবস্থা ও নৌবিমান স্কোয়াড্রন গঠন। ‘লিটোরাল ডিফেন্স’ ধারণা অনুযায়ী এমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ছোট কিন্তু গতিশীল নৌবাহিনী প্রতিপক্ষকে ব্যয়বহুল প্রতিরোধে বাধ্য করতে পারে।
এছাড়া বিদেশি অস্ত্রের ওপর অতিনির্ভরতা কমাতে স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্প বিকাশ জরুরি। প্রথম ধাপে রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত (MRO) ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব; পরবর্তী ধাপে লাইসেন্সপ্রাপ্ত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে; যেমন হালকা সাঁজোয়া যান, ছোট অস্ত্র বা যোগাযোগ সরঞ্জাম। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং বিদেশি সরবরাহকারীর ওপর রাজনৈতিক নির্ভরতা কমবে।
আধুনিক যুদ্ধের নতুন রূপ হলো সাইবার–আক্রমণ ও অবকাঠামো ধ্বংস। তাই বাংলাদেশের উচিত একটি সমন্বিত জাতীয় সাইবার প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন, সরকারি ও বেসরকারি নেটওয়ার্কের সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষিত ‘সাইবার রিজার্ভ’ বাহিনী গঠন করা। বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ ও আর্থিক খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় সাইবার–নিরাপত্তা মহড়া নিয়মিত করা উচিত।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সংবেদনশীল অঞ্চলগুলোয় সেনা–অভিযানের পাশাপাশি উন্নয়ন, ভূমি–অধিকার নিশ্চিতকরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসন চালু করতে হবে। উন্নয়ন ও ন্যায়ের পরিবেশ তৈরি হলে বিদ্রোহীদের সামাজিক ভিত্তি দুর্বল হয় এবং বিদেশি প্রভাবের সুযোগ কমে। জনগণের সঙ্গে আস্থানির্ভর সম্পর্কই এখানে টেকসই নিরাপত্তার চাবিকাঠি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কৌশলগত অংশীদারত্বের বৈচিত্র্য। একক শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বিপজ্জনক। বাংলাদেশকে একইসঙ্গে চীন, তুরস্ক, উপসাগরীয় দেশ, আসিয়ান ও পশ্চিমা অংশীদারদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এতে একপক্ষীয় চাপ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে এবং কূটনৈতিক বিকল্প বাড়বে।
এখন প্রশ্ন আসে—বাংলাদেশ কি পাকিস্তান–সৌদি প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দেবে? সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাকিস্তান ও সৌদি আরব পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। এর ফলে একটি নতুন নিরাপত্তা বলয় গড়ে উঠছে, যার লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তায় পারস্পরিক ভূমিকা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের জন্য এ জোটে যোগদানের কিছু সম্ভাব্য সুফল আছে—সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে জ্বালানি–নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাড়তে পারে; সামরিক সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ সুবিধা মেলাতে পারে; এমনকি সংকটে কিছু রাজনৈতিক সুরক্ষাও পাওয়া যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ সরাসরি পাকিস্তানের পারমাণবিক আমব্রেলার ভেতরে চলে আসবে।
তবে এ ধরনের জোটে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঝুঁকিও আছে। আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত এমন পদক্ষেপকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটি সীমান্তে বা কূটনৈতিক অঙ্গনে চাপ বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ‘স্মার্ট ব্যালেন্সিং’ নীতি গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা সহযোগিতা, লজিস্টিকস ও প্রযুক্তি স্থানান্তরভিত্তিক চুক্তি করা যেতে পারে। কিন্তু পারস্পরিক যুদ্ধ–অংশগ্রহণ বা বাধ্যতামূলক প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে পর্যালোচনার প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের ফোর্সেসে গোল অর্জনের ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ বছর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’–এর পূর্ণাঙ্গ পুনর্মূল্যায়ন অপরিহার্য। বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় গোয়েন্দা, নৌ ও আকাশ প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গোয়েন্দা কাঠামো সংস্কার করে ত্রিবাহিনীর মধ্যে সমন্বিত ‘C4ISR’ (Command, Control, Communication, Computer, Intelligence, Surveillance and Reconnaissance) কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত, যা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও উপকূলীয় অঞ্চলে আধুনিক রাডার, স্যাটেলাইট ডেটা ও ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে একটানা নজরদারি চালানো জরুরি, যাতে কোনো অনুপ্রবেশ বা চোরাচালান দ্রুত শনাক্ত করা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রযুক্তি স্থানান্তর, যৌথ প্রশিক্ষণ ও প্রতিরক্ষা উৎপাদন চুক্তি করতে হবে, যাতে বাহিনীর দক্ষতা ও আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
একটি শক্তিশালী ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন সেল’ গঠন করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করবে এবং বিদেশি প্রচারণা ও অপপ্রচারের তাৎক্ষণিক জবাব দেবে। সবশেষে, সামরিক ক্রয়–বিক্রয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বচ্ছতা এবং বেসামরিক তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সুশাসন ও জনআস্থা বজায় থাকে। এভাবেই বাংলাদেশ একটি দক্ষ, আধুনিক ও জবাবদিহিমূলক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে এগোতে পারবে।
বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, আধুনিক ও আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ছাড়া বর্তমান সময়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা কঠিন। প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নের দিকে আমাদের নজর দেওয়ার সময় এসেছে। যুদ্ধ এখন প্রথাগত সমরাস্ত্রের বদলে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক বিবেচনায় নিয়েও আমরা আধুনিক নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে পারি।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা টিকিয়ে রাখার শ্রেষ্ঠ কৌশল হলো আত্মনির্ভর সামরিক সক্ষমতা, সমাজভিত্তিক স্থিতিশীলতা, সাইবার ও তথ্য প্রতিরক্ষা এবং কূটনৈতিক বৈচিত্র্য। এভাবেই বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

ইসরাইল গত সেপ্টেম্বরে যখন কাতারের রাজধানী দোহায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনারত হামাস নেতাদের ওপর হামলা চালায়, তখন তা বিশ্বজুড়ে অনেককে অবাক করেছিল। কিন্তু একইসঙ্গে ওই হামলা এই বাস্তবতাকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, এই দেশগুলো ইসরাইল থেকে অনেক দূরে হওয়া সত্ত্বেও দেশটির আগ্রাসন থেকে মুক্ত নয়। অথচ গাজায় যুদ্ধবিরত
১০ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ আবারও জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবিকে ঘিরে যে রাজনৈতিক তৎপরতা, বিদেশি প্রভাব ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা শুরু হয়েছে, তা দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বিগ্ন করেছে।
১০ ঘণ্টা আগে
স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানোর জন্য ভালো ডাক্তার, ভালো মেডিকেল কলেজ, উন্নত যন্ত্রপাতি ও সঠিক ওষুধ যেমন জরুরি, তেমনি দেশের স্বাস্থ্য সমস্যার সঠিক চিত্রটা জনগণের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
১০ ঘণ্টা আগে
চারপাশের চিরচেনা রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিংবা আমাদের যাপিত জীবনের আলেখ্য অনেকটা সরলরৈখিক। এখানে অর্থলোভী আর ক্ষমতালিপ্সু মা-বাবার অবৈধ পথে প্রতিযোগিতায় জেতার মানসিকতা ছুঁয়ে যায় তার সন্তানদেরও। স্বজন হারানোর বেদনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের ফন্দিফিকিরে তারাও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয় নিত্যনতুন ধান্দায়।
১০ ঘণ্টা আগে