রাজনৈতিক সংস্কৃতি রূপান্তরে জেন-জি

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৫৬

চারপাশের চিরচেনা রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিংবা আমাদের যাপিত জীবনের আলেখ্য অনেকটা সরলরৈখিক। এখানে অর্থলোভী আর ক্ষমতালিপ্সু মা-বাবার অবৈধ পথে প্রতিযোগিতায় জেতার মানসিকতা ছুঁয়ে যায় তার সন্তানদেরও। স্বজন হারানোর বেদনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের ফন্দিফিকিরে তারাও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয় নিত্যনতুন ধান্দায়। বাপ-চাচা কিংবা মায়ের অর্জনকে ছাড়িয়ে গিয়ে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হতে আগ্রহী হয় তারাও। বিগত দশকগুলোতে বিশ্বজুড়ে স্বৈরতান্ত্রিক বিকাশ আর দুর্নীতির প্রসারে এই প্রবণতা বড় ভূমিকা রেখেছিল। কারণ বাসায় ফেরার পর বাবা-মায়ের আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে এমন সন্তান ছিল না। তাদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্য ছিল যেভাবে হোক প্রচুর আরাম-আয়েশে ঘি-মাংস খেয়ে এসির নিচে বাস করা। এর বাইরে বিশ্বের বাকি মানুষ মরে গেল, নাকি বেঁচে থাকল—এগুলো তাদের চিন্তায় জায়গা করতে পারেনি। তাই বিশ্বের রাজনীতি, সংস্কৃতি আর জীবনবোধে দেখা দিয়েছিল বিশ্রী রকমের স্থবিরতা।

জেঁকে বসা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের নানা দেশে উত্তাল বিপ্লব হচ্ছে। রাজনীতির হালচাল বদলে যেতে দেখে সবাই নড়েচড়ে বসছে। অনেকে বোঝার চেষ্টা করছেন—কেন ও কীভাবে এগুলো হচ্ছে? এগুলো কি এক দিনের ঘটনা, নাকি দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলাফল? আর তেমনি একটি গবেষণামূলক ডকুমেন্টারি করেছে আল জাজিরা ইংলিশ। ‘Why is Gen Z rejecting hustle culture and redefining the meaning of work?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তারা খুঁজে দেখেছে কীভাবে বদলে যাচ্ছে। তাদের হিসেবে আজকের পৃথিবীজুড়ে কর্মসংস্কৃতির ধারণা একে একে পরিবর্তিত হচ্ছে। তারা মনে করেছে, এই পরিবর্তনের ধারক হিসেবে সামনে এসেছে জেন-জির সদস্যরা। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভূমিকম্প তুলে দেওয়া এই জেন-জিরা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের আন্দোলন ও সংস্কৃতির পুনঃসংজ্ঞায়ন শুধু কর্মসংস্কৃতির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গভীর সংস্কৃতি রূপান্তরের প্রতিফলন। প্রচুর অর্থ উপার্জন আর বড়লোক হতে গিয়ে যেখানে বুমারদের কাছে ‘হাসল কালচার’ বা অতিরিক্ত পরিশ্রমের সংস্কৃতি জনপ্রিয় ছিল। আর তাদের সেই পুরোনো সমাজের আদর্শ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বমানবতা আর মানবসভ্যতার জন্য, কিন্তু সেদিকে তাদের দৃষ্টি ছিল না।

বিজ্ঞাপন

বদলে যাওয়া বিশ্বে জেন-জি তাদের কাজের ধারণা নতুনভাবে রূপায়িত করছে। তাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য কেবল অর্থ উপার্জন নয়। তারা জীবনের মানোন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্যও যথেষ্ট মানবিক ও বাস্তবমুখী। এজন্যই গ্রেটা থুনবার্গের মতো মেয়েরা ইজরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নিয়ে রওনা দেয়। হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায় আবু সাঈদ কিংবা ওয়াসিমরা। দেশের মানুষ মুক্ত হবে এই আশায় তুমুল সাহস নিয়ে পুলিশের এপিসিতে উঠতে গিয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় শাইখ আহসাবুল ইয়ামিন।

শুধু অর্থ উপার্জন আর আরামের জীবন নয়, এই প্রজন্ম তাদের সাফল্যের সংজ্ঞায়ন নতুনভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখানে কাজের পাশাপাশি মানসিক শান্তি, সুস্থ জীবনযাপন এবং সামাজিক পরিবর্তনও প্রাধান্য পেয়েছে। তাই তারা সেই ‘হাসল কালচার’ ও বুমারদের ন্যাতানো-পুতানো পুরোনো আদর্শের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে তুলেছে ভিন্ন একটা ধারা।

বাস্তবে এই ‘হাসল কালচার’ হলো এমন একটি বিশ্বাস বা ধারণা, যা অর্থ উপার্জন আর প্রচুর কাজকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তাদের কাছে ‘অতিরিক্ত পরিশ্রম’কে সাফল্যের মূল উপাদান হিসেবে দেখা হয়। তাদের এই সংস্কৃতি দীর্ঘ সময় ধরে আধিপত্য বিস্তার করেছিল অর্থ উপার্জনের পরিমাণকে মানদণ্ড ধরে। তারা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন এবং শখকে অগ্রাহ্য করে এককেন্দ্রিকভাবে কাজের প্রতি নিবেদিত থাকতে উৎসাহিত করেছিল।

জেন-জি এই পুরোনো আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, কাজের প্রতি জীবন-যৌবন সবকিছুকে নিবেদন করে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলার সুযোগ নেই। আর এর মাধ্যমে যে সাফল্যের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, তা সবার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। তারা বরং সাফল্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাচ্ছে। তারা কাজের পাশাপাশি মানসিক শান্তি এবং সুস্থ জীবনযাপনও গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে। তারা তাদের বাবাদের গুম-খুন আর আয়নাঘরের উপার্জনের চেয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়ে মুক্তমতের প্রকাশ ঘটার সুযোগ ‍সৃষ্টিকেই অভীষ্ট হিসেবে ঠিক করেছে। আর তাদের চিন্তার এই পরিবর্তনের ফলেই কর্মসংস্কৃতির ধারণায় গভীর রূপান্তর ঘটেছে। তাদের চিন্তার এই রদবদল শুধু জেন-জির মাঝে নয়, পুরো সমাজে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভূত করেছে।

জেন-জির দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক রূপান্তর কীভাবে পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে পাল্টে দিচ্ছে, সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি কি? পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অবকাঠামো বহু আগেই ভেঙে গেছে। আমি এর আগেও একটা লেখায় বলেছিলাম, রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকতে গেলে কেন রাজনীতিবিদদের জেন-জির ভাষা বুঝতে হবে, কেন রাজনীতিবিদদের তাদের মতো করে চিন্তা করতে হবে, কেন রাজনীতিবিদরা আগের মতো ‘১০টা হোন্ডা ২০টা গুন্ডা ৪০টা ডান্ডা’ নিয়ে নির্বাচন ঠান্ডা করে দিতে পারবে না? আর এই বিষয়গুলো প্রতিটি দেশের জন্য সমান গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে।

জেন-জি আজকের সমাজে শুধু ‘হাসল কালচার’কেই প্রত্যাখ্যান করছে, তা নয়; তারা এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক নতুন রূপের পথপ্রদর্শন করছে। এই প্রজন্মের সদস্যরা জানে, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং মানসিক অস্থিরতা তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে কলুষিত করে। পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টাই মূলত সামগ্রিকভাবে সমাজের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই তারা চায় এমন একটি কাজের পরিবেশ, যেখানে শুধু অর্থ উপার্জন নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার, মানসিক স্বাস্থ্য এবং জীবনের সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়। বহু পরে এসে হলেও জেন-জি বুঝতে পেরেছে, সমাজের উন্নতি এবং দেশের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করতে হলে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা একান্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

জেন-জিদের কাজ ও সাফল্যকে বোঝার জন্য ‘লেজি গার্ল জব’ ও ‘কোয়াইট কুইটিং’ সংস্কৃতির পুনর্গঠন কীভাবে হয়েছে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তারা তাদের কাজের পরিবেশে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছে। এটা একদিকে যেমন নিজেদের কাজের মধ্যে সঠিক ব্যালান্স বজায় রাখতে সহায়ক, তেমনি অন্যদিকে এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনও ঘটাচ্ছে। আর এজন্যই ‘লেজি গার্ল জব’ এবং ‘কোয়াইট কুইটিং’—এই দুটি ধারণা জেন-জির মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

‘লেজি গার্ল জব’ আসলে একটি ইন্টারনেট ট্রেন্ড, যেখানে কাজের সঙ্গে জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এখানে অলসতা বা কর্মহীনতা নয়, বরং কাজের মধ্যে একটি সুষম দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নের কথা বলা হচ্ছে। একইভাবে ‘কোয়াইট কুইটিং’ হলো কাজের প্রতি এক ধরনের নীরব বিরতি নেওয়া, যেখানে কাজের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিয়ে নিজস্ব সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও জীবনের পূর্ণতা অনুভব করা হয়। এই ধারণাগুলো জেন-জির সদস্যদের কাছে এক ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করছে।

তবে হ্যাঁ, জেন-জির দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক একাধিক কারণ কাজ করছে, যার মধ্যে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা এবং পরবর্তী কোভিড-১৯ মহামারি অন্যতম। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা তাদের অভিভাবকদের কঠিন সময় পার করতে দেখেছিল এবং পরবর্তী সময়ে কোভিড-১৯ মহামারি অনেকের কাছে জীবনের মান এবং কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ তৈরি করেছে। এই সময়ে জেন-জি দেখেছে, শুধু কাজের প্রতি নিবেদিত থেকে তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়। তারা বুঝেছে, কাজের বাইরে জীবন আছে এবং একমাত্র কাজের মাধ্যমেই সাফল্য বা মানসিক শান্তি অর্জন করা সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি তাদের জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক জাগরণ ঘটিয়েছে, যেখানে তারা সমাজের আরো বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য নিজেদের স্থান তৈরি করছে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তর খেয়াল করতে গেলে জেন-জি শুধু কাজের পরিবেশের মধ্যেই সংস্কৃতির পরিবর্তন আনছে না, বরং এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তরের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই প্রজন্ম বিশ্বাস করে, কাজের সঙ্গে জীবনের সঠিক সমন্বয় তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবদানকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে। তারা জানে, সামাজিক ন্যায় ও মানবাধিকারের মতো বৃহত্তর প্রশ্নগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হলে কেবল কর্মসংস্কৃতি নয়, পুরো সমাজের কাঠামোই পরিবর্তিত হবে। এ কারণে তারা শ্রমিক অধিকার, মানসিক স্বাস্থ্য এবং বৈষম্য দূরীকরণে প্রভাবিত হয়ে নতুন ধরনের আন্দোলন সৃষ্টি করছে, যা কেবল একটি কাজের ধারণা নয়, একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনকে ধারণ করছে।

এজন্যই জেন-জি শুধু কর্মসংস্কৃতি নয়, শ্রমিক অধিকার এবং লেবার ইউনিয়নের প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আলোচনা বাড়ছে এবং তারা বুঝতে পেরেছে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, উন্নত মজুরি এবং শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে লেবার ইউনিয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা একত্রিত হয়ে তাদের অধিকার রক্ষা করতে চায় এবং এই সংগ্রাম কেবল নিজেদের জন্য নয়, সমগ্র সমাজের জন্যও একটি রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত হয়েছে।

বাস্তবে জেন-জি শুধু ‘হাসল কালচার’ কিংবা তার ওপর গড়ে ওঠা রাজনৈতিক কাঠামোকেই প্রত্যাখ্যান করছে না, এর বাইরেও রয়েছে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক প্রভাব। তারা কর্মসংস্কৃতির সীমানা পেরিয়ে একটি বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানোরও চেষ্টা করছে। তারা নতুন করে কাজের অর্থ ও উদ্দেশ্য সংজ্ঞায়িত করছে, যেখানে আদর্শ ও নৈতিকতার চর্চা ট্রাইবাল রাজনৈতিক চেতনা কিংবা উগ্র জাতিবাদী ঘৃণার প্রবণতাকে থমকে দিয়েছে। তারা ইতিহাস পড়ছে, জানছে, বুঝছে; কিন্তু এই ইতিহাস সামনে রেখে কেউ নিজের অপকর্মকে হালাল করতে গেলে তাদের ছুড়ে ফেলছে। তাই তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি আগামী দিনের কর্মসংস্কৃতি, রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং সমাজকাঠামোর জন্য একটি নতুন সীমারেখার উন্মোচন করেছে।

লেখক : গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত