মেজর ডালিমের সাক্ষাৎকার
অলিউল্লাহ নোমান, লন্ডন থেকে
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রেডিওতে মেজর (অব.) ডালিমের কণ্ঠেই প্রথম ঘোষণা হয়েছিল এক সফল সেনা অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার খবর। বর্তমানে আত্মগোপনে থাকা সেই সেনাকর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম আমার দেশকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৫ আগস্টের ঘটনা কেন অনিবার্য ছিল-শেখ হাসিনা তা প্রমাণ করে গেছেন। তিনি বলেন, দেশকে আওয়ামী লুটপাট, বাকশাল ও ভারতীয় বলয় থেকে মুক্ত করতেই সেদিন সেনাপরিষদের উদ্যোগে ১৫ আগস্ট ঘটানো হয়েছিল। ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে মেজর মহিউদ্দিনের ইউনিট থেকে এর সূচনা হয়।
তিনি জানান, ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হয়। মুক্ত হওয়ার পর কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাকে তখন নিয়ে গেলে অন্য কিছু ঘটত। কিন্তু আমরা তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে দিইনি। বরং কর্নেল তাহেরকে ধমক দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়।
লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য স্বাধীনতা-উত্তর শেখ মুজিব সরকারের সময় বীরউত্তম খেতাব পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি পাকিস্তান আর্মির সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান আর্মিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের আর্মি ব্যারাক থেকে পালিয়ে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। গোপনে ব্যারাক থেকে বের হয়ে নানা চড়াই-উৎরাই ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করে পৌঁছান দিল্লি হয়ে কলকাতায়। প্রবাসী সরকারের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সম্মুখ যুদ্ধে কামানের গোলা আর বন্দুকের গুলির আঘাতও লেগেছিল কয়েকবার। শহীদ হতে পারতেন সেই দিনগুলোতে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে বেঁচে গিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের আর্মি ব্যারাক থেকে পালিয়ে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া অফিসারদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। তার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন নুর ও মতি। কর্নেল তাহের, বীরউত্তমেরও তাদের সঙ্গে আসার কথা ছিল। পালানোর প্রস্তুতি চলাকালে তার বদলি আদেশ হওয়ায় একসঙ্গে আসা হয়নি। তিনি পরে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠনেও রয়েছে তার ভূমিকা। স্বাধীনতা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমান সরকার দেশের সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৮ জানবাজ মুক্তিযোদ্ধাকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। সামরিক বাহিনী থেকে পিও-৯ প্রয়োগের মাধ্যমে এই বরখাস্তের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকা থেকে প্রথম কিস্তিতে ৭ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। প্রথম কিস্তিতে আর্মি থেকে অবসরে পাঠানো ৭ জনের মধ্যে যথাক্রমে ১নং ও ২নং অফিসার ছিলেন মেজর ডালিম, বীরউত্তম এবং মেজর নূর, বীরবিক্রম। তিনিই ঘোষণা করেছিলেন, খোন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। পরবর্তীতে ওই বছরের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পর তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়। সমঝোতার ভিত্তিতেই একটি বিশেষ বিমানে করে প্রথমে ব্যাংককে যান; সঙ্গে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল নাজমুল হুদার স্ত্রী। আমার দেশকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তখনকার অস্থির সময়ের অজানা কাহিনি।
বর্তমানে কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম আত্মগোপনে রয়েছেন। খোন্দকার মোশতাক আহমদ সরকারের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা তার বাবা হত্যার অভিযোগে বিচার শুরুর পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। আত্মগোপনে থাকা কর্নেল ডালিমের সাক্ষাৎকার নেন লন্ডনে আমার দেশ-এর আবাসিক সম্পাদক অলিউল্লাহ নোমান
আমার দেশ : আপনি সেনাবাহিনীতে কত সালে যোগ দিয়েছিলেন?
শরিফুল হক ডালিম : আমি প্রথমে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান করেছিলাম এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রবণশক্তি একজন পাইলটের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার নিচে চলে যাওয়ায় আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হয়।
আমার দেশ : আমরা জানি আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং বীরউত্তম খেতাব পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে যদি একটু বলতেন…
ডালিম : আমি তখন পাকিস্তান আর্মিতে ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে পাকিস্তানের কোয়েটায় ছিলাম। যুদ্ধ শুরুর খবর পেয়ে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। কী করা যায় ভাবছিলাম। কীভাবে পাকিস্তান আর্মিকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন হবে- এটাই ছিল ভাবনায়। আমার কমান্ডো ট্রেনিং ছিল। একদিন ভাবলাম পাকিস্তান আর্মির নিয়ন্ত্রিত একটি ডিপো উড়িয়ে দেব। এতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অস্ত্রভান্ডারের অপরিমেয় ক্ষতি হবে। এ পরিকল্পনা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে না পেরে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু থেমে যাইনি। ভাবলাম একটা পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়েছি তো কী হয়েছে! এমন অবস্থায় হঠাৎ করেই একদিন নুর এসে বললেন, ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে কর্নেল) তাহের আমাকে সালাম জানিয়েছেন। তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। জানিয়ে দিলাম রাতে ক্যাপ্টেন তাহেরের ওখানে আমরা একসঙ্গে ডিনার করব। ডিনারের রুমে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ শুরু করি।
আমার দেশ : কী আলাপ হয়েছিল সেদিন?
ডালিম : অনেক কথাবার্তাই হয়েছিল। এক পর্যায়ে তাহের জানালেন, নুর ও তাহের চমন বর্ডার দিয়ে আফগানিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশে পৌঁছে যুদ্ধে যোগ দেবেন। পালানোর জন্য স্থানীয় অফিসার হিসেবে আমার সহযোগিতা চাইলেন। কারণ, ওই এলাকাটি আমাদের ইউনিটের অধীনে ছিল। তখন তাকে বললাম, স্যার, আমিও পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং চেষ্টা করছি। এ কথা শুনে তাহের খুব খুশি হলেন এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আরও বললেন, দেরি না করে বর্ডারটা রেকি করে এসো। কথা সেরে দেরি না করে চলে আসি আমি। আসার আগে আমরা ৩ জন কোরআন ছুঁয়ে শপথ করি যে, এই পরিকল্পনার কথা কাউকে বলব না। এখানে বলে রাখতে চাই, সেনাবাহিনীতে তাহের আমার সিনিয়র ছিলেন।
আমার দেশ : আপনারা কখন কীভাবে পালিয়েছিলেন?
ডালিম : সুযোগমতো একদিন আনন্দচিত্তে বর্ডার রেকি করে এলাম। এরপরই গোয়েন্দা বিভাগের আমাদের একজন বাঙালি সৈনিক এসে খবর দিলেন চমন বর্ডার (যে বর্ডার দিয়ে আমরা পালাতে চেয়েছিলাম) দিয়ে পালাতে গিয়ে দুজন কমিশন্ড ও তিনজন ননকমিশন্ড অফিসার আটক হয়েছেন এবং তাদের আফগানিস্তান সরকার পাকিস্তান আর্মিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। দ্রুত তাহেরের কাছে ছুটে গেলাম। ঘটনা জানানোর পর আমরা পরিকল্পনা পরিবর্তন করি। সিদ্ধান্ত হল চমন বর্ডার নিয়ে নয়, অন্য কোনো বর্ডার দিয়ে আমাদের পালাতে হবে। অনেক পর্যালোচনা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম ভাওয়ালপুর-ভাওয়ালনগর বর্ডার দিয়ে আমরা পালাব। এতে সময়ও কম লাগবে।
আমার দেশ : আপনারা কি সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন?
ডালিম : এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই। আমরা পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ খুঁজছি। তখন এপ্রিল মাস। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে মাত্র মার্চ মাসে। সরকারি ছুটির দিনে লেফটেন্যান্ট নুরের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মতি নামে এক বাঙালি অফিসার (পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোর্সে আসা) আসেন আমার মেসে। মতি পালানোর ইচ্ছে প্রকাশ করে আমার পরামর্শ চাইলেন। আমরা যেহেতু কোরআন স্পর্শ করে শপথ করেছিলাম কাউকে বলব না, তাই মতিকে আমাদের বিষয়টি শেয়ার না করে উৎসাহ দিলাম। আমাদের পরিকল্পনা নিজেদের মধ্যে রেখে ছক আঁকতে লাগলাম কীভাবে পালানো যায়।
আমার দেশ : শেষ পর্যন্ত কীভাবে পালিয়েছিলেন?
ডালিম : কীভাবে পালিয়েছিলাম, সেটা বলার আগে আরেকটি বিষয় বলা প্রয়োজন। তা না হলে দুঃসাহসিক এই পালানোর ঘটনা বোঝা যাবে না। একদিন হঠাৎ করেই নুর আসেন। জানতে চাইলাম আমাদের সঙ্গে মতিকে নিলে কেমন হয়। নুর তখন বলেন, বিষয়টা তাহেরের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। নুর এবং আমি তাহেরের কাছে গিয়ে মতির বিষয়টি বললাম। তাহের তখন জানালেন বিশ্বস্ত হলে নিতে সমস্যা নেই।
আমার দেশ : মতিকে সঙ্গে নিয়েই কী পালিয়েছিলেন?
ডালিম : এ বিষয়ে পরে আসছি। পরদিন কোয়েটায় একমাত্র চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমি, নুর ও মতি মিলিত হলাম। এখানে আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতে আসতাম। মতিকে তখন বললাম, তোমার গতকালের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি আজ। আমরা তিনজন (তাহের, নুর এবং আমি) আগে থেকেই পালানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। চমন বর্ডার দিয়ে পালানোর চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু একটা ব্যাটালিয়নের কিছু বাঙালি সৈনিক ও অফিসার পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। তাই আমরা পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছি। এখন চিন্তা করছি ভাওয়ালপুর-ভাওয়ালনগর হয়ে রাজস্থান বর্ডার দিয়ে পালাব। তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে আসতে পার। এতে মতি আনন্দিত হয়েছিলেন। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল পালানোর অপারেশন বাস্তবায়নের জন্য পথের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা কোথায় কী অবস্থা রয়েছে। পাকিস্তানি আর্মিরা কোথায় কোথায় পাহারা বসিয়েছে- সব খবর নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে। আর্মির প্ল্যানিং পাওয়া গেলে পুরো রাস্তাঘাটের অবস্থা জানা যাবে। তাই আমাদের বাঙালি হাবিলদার শফিকের সাহায্য নিলাম। শফিক এই ম্যাপটি জোগাড় করে দিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমাদের সঙ্গে পরবর্তীতে সুমি নামে আরো একজন যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তার শারীরিক কন্ডিশনের কারণে আমাদের সঙ্গে আসতে পারেননি। মরুভূমির বালু তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর ছিল। তাই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ওয়াগা বর্ডার দিয়ে পালানোর জন্য। আমরা রওনা দেওয়ার মুহূর্তে আরেকটি বিপর্যয় নেমে আসে। তাহেরকে হঠাৎ করে বদলি করে দেওয়া হয় অ্যাবোটাবাদে। এতে তাকে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে দ্রুতই। এ খবর পেয়ে মতি, নুর এবং আমি দ্রুতই তাহেরের কাছে যাই। তার কাছে গিয়ে পরিস্থিতি জানলাম। তাহের তখন বললেন, সো হোয়াট! তোমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাও। আমি অ্যাবোটাবাদ থেকে পরবর্তীতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। এভাবেই নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে নুর, মতি এবং আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে দিল্লি হয়ে প্রথম তিনজন বাঙালি অফিসার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হতে সক্ষম হয়েছিলাম।
আমার দেশ : আপনারা যে পথে এসেছিলেন, সেটা তো ছিল মরুভূমির ওপর দিয়ে। হেঁটে ওই মরুভূমি পার হতে কত সময় লেগেছিল?
ডালিম : মরুভূমি তো পরে। আমাদের ভাওয়ালপুর পৌঁছাতেই অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে। আতঙ্ক ছিল পুরো পথজুড়ে। কখন পাকিস্তান আর্মি বা পুলিশের হাতে আটক হয়ে যাই। উড়োজাহাজ, বাস-ট্রেন এবং টেক্সিতে করে অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। বর্ডার ক্রস করে রাজস্থান মরুভূমি যখন পার হই, তখন অনেক ঝুঁকি ছিল। কখনো হেঁটে, ক্রলিং করে পথ অতিক্রম করেছি। ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে ফাঁকি দিতে হয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ডিফেন্স পজিশন ও টহলকে। এভাবেই দৌড়ে-হেঁটে ভারতের শ্রিকরনপুরে আমরা পৌঁছাই। মরুভূমি অতিক্রম করে শ্রিকরনপুরের কাছাকাছি গেলে রাতের আঁধারে বিদ্যুতের বাতি দেখে আমাদের মনে স্বস্তি ও আনন্দ আসে এই ভেবে- এই তো আমরা একটি লোকালয়ে পৌঁছে গেছি।
আমার দেশ : প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে পৌঁছালেন কীভাবে?
ডালিম : আমরা অনেক চিন্তা করলাম। কোথায় আত্মসমর্পণ করলে ভালো হয়। প্রচলিত নিয়মে ভারতে প্রবেশ করেই আত্মসমর্পণ করে আমাদের ইচ্ছার কথা জানানো দরকার ছিল। আবার মনে করলাম যেখানেই আত্মসর্পণ করি, আমাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত আসত কেন্দ্রীয় সরকার থেকে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম দিল্লি গিয়ে আগে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করব। তারপর আমরা আমাদের ইচ্ছার কথা জানাব।
আমার দেশ : আত্মসমর্পণ ও পরবর্তী গল্পটা যদি একটু বলতেন আমাদের পাঠকের জন্য…
ডালিম : আমরা দিল্লিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে আত্মসমর্পণ করবÑ এমন একটি বার্তা দিয়েছিলাম ভারতীয় সাংবাদিকদের। আমাদের আগেই তারা সেখানে পৌঁছে যায়। আমরা গিয়ে দেখি রিসিপশনে অনেক সাংবাদিক বসা। দেখেই বুঝলাম আমাদের বুদ্ধি কাজে লেগেছে। আমরা সেখানে পৌঁছে রিসিপশনে জানালাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। রিসিপশন থেকে জানানোর পর একজন ব্রিগেডিয়ারসহ কয়েকজন অফিসার এসে আমাদের রিসিভ করলেন। সাংবাদিকরা ততক্ষণে ক্যামেরায় ছবি তুলছেন। তবে ভারতীয় অফিসাররা আমাদের বলেছেন, আপনারা কোনো অবস্থায় মুখ খুলবেন না।
আমার দেশ : মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন কবে?
ডালিম : মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আরো কদিন সময় লেগেছিল। ভারতীয় সরকার আমাদের অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। আমরা কী আসলেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে এসেছি, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছেÑ সেটা যাচাই-বাছাই করতে আমাদের অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল, আমরা আসলেই দেশ স্বাধীনের উদ্দেশ্যে এসেছি; নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। কদিন তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের পর নিশ্চিত হয়ে প্রবাসী সরকারের কাছে আমাদের হস্তান্তর করেছিল। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যাত্রা শুরু। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পথ পাড়ি দিতে যেসব হাবিলদার ও সৈনিক আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছে কি না, সেটা জানি না।
আমার দেশ : আমরা আপনার লেখা বইয়ে পড়েছি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘সেনাপরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন গড়েছিলেন। এ বিষয়ে যদি একটু বলতেন…
ডালিম : প্রতিটি পদক্ষেপে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত কষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের কব্জায় চলে যাচ্ছি। এটা যখন উপলব্ধি করলাম, তখন আমাদের মাথায় নতুন ভাবনা আসে। আমরা সমমনা ঘনিষ্ঠ কমান্ডারদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পাকিস্তানিদের থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের অধীনে আমরা থাকব না। প্রয়োজনে আবারও একটি যুদ্ধ করব। একটি প্রকৃত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ তৈরি করব আমরা। যে বাংলাদেশে মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না। এই প্রতিজ্ঞা যাদের ছিল, তাদের নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোপন সংগঠন ‘সেনাপরিষদ’গঠন করা হয়েছিল।
আমার দেশ : স্বাধীন হওয়ার পরও কি সেনাপরিষদের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল?
ডালিম : দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেনাপরিষদের কার্যক্রম গোপনে চলছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে আওয়ামী লীগের লুটপাট ও বাকশাল থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল সেনাপরিষদের সদস্যরাই। ১৫ আগস্টের বিপ্লব এবং তারই ধারাবাহিকতায় ব্রিগেডিয়ার খালেদচক্রের প্রতিক্রিয়াশীল ৩ নভেম্বরের ক্যুদাতার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবেও মূল নেতৃত্ব দিয়েছিল সেনাপরিষদ। সেনাপরিষদ ও কর্নেল তাহেরের সংগঠন মিলেই সৈনিকদের প্রস্তুত করেছিল বিপ্লবের লক্ষ্যে। ১৫ আগস্ট সফল বিপ্লবের পর আরেকটি সেনা ক্যু হয় খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। খালেদের নেতৃত্বে ক্যুর তিন দিনের মাথায় ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ঘটানো হয়েছিল সেনাপরিষদের দেশ ছাড়া নেতৃত্বের পূর্বপরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। খালেদচক্রের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আরো একটি সিপাহি-জনতার বৈপ্লবিক সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ গংয়ের পতন ঘটানো হয়েছিল সেনাপরিষদের সাময়িকভাবে দেশত্যাগী শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দ্বিতীয় সারির নেতা মেজর মহিউদ্দিনের ইউনিট থেকেই বিপ্লবের সূচনা হয়। সঙ্গে ছিল কর্নেল তাহেরের বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার ঢাকায় কয়েকটি ইউনিটে তার অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলা সেলগুলো। এখানে দেশবাসীর জানার জন্য বলছি, কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিল ১৫ আগস্ট বিপ্লবের অনেক আগেই জাসদ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে এনেছিলেন এবং সেনাপরিষদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন।
আমার দেশ : আপনার দাবি অনুযায়ী ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের নেপথ্যে নেতৃত্ব ছিল সেনাপরিষদের নিয়ন্ত্রণে…
ডালিম : বিপ্লবের মূল নেতৃত্ব সেনাপরিষদের হাতেই ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাপরিষদের সদস্য মহিউদ্দিনের নির্দেশেই ৭ নভেম্বর রাত ১২টায় তার ইউনিট থেকে কামানের ট্রেসার গোলা আকাশে ছুড়ে বিপ্লবের সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল। এর পরপরই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ল্যান্সারসহ সব ইউনিটের সেনাসদস্যরা ‘নারায়ে তাকবির ধ্বনিতে স্লোগান দিয়ে বের হয়ে আসেন রাজপথে এবং মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী মহিউদ্দিনের ইউনিট ও ট্যাংক রেজিমেন্ট একই সঙ্গে ৪৬ ব্রিগেডের পদাতিক ইউনিটগুলোর সদস্যরা প্রথমেই রওনা করে তাদের নেতা এবং ১৫ আগস্ট বিপ্লবের পর নিযুক্ত সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে মহিউদ্দিনের ইউনিটেই নিয়ে আসা হয়েছিল। মহিউদ্দিন তখন সংকটের মোকাবিলা করছিলেন ব্যাংককে অবস্থিত শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা মোতাবেক। তাই কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে মহিউদ্দিনের ইউনিট থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেও পারেননি। উল্টো কর্নেল তাহেরকে ধমক দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
আমার দেশ : এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে জানতে চাই। আপনার স্ত্রীকে কেন্দ্র করে একটি ঘটনা মুখে মুখে শোনা যায়। শেখ মুজিবপুত্র শেখ কামাল দুর্ব্যবহার করেছিলেন বলে প্রচারিত রয়েছে। আসলে কী ঘটেছিল লেডিস ক্লাবের বিয়ের অনুষ্ঠানে?
ডালিম : এটি ছিল একটি বিয়ের অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে তৎকালীন রেডক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান ও শেখ মুজিবের অনুগত বিশিষ্ট আস্থাভাজন মাস্তান হিসেবে পরিচিত গাজীর ছেলের সঙ্গে আমার শ্যালকের কথাকাটাকাটি হয়েছিল একটি অশোভন বিষয় নিয়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিশোধ নিতে গাজী তার সশস্ত্র মাস্তান বাহিনী নিয়ে এসে অনুষ্ঠান থেকে আমাকে অপহরণের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আমাকে একটি গাড়িতে তুলে নিলে আমার স্ত্রী এবং খালাশাশুড়িও এই গাড়িতে ওঠেন। সেখানে ওঠানো হয়েছিল নিমন্ত্রিত ক্র্যাক প্লাটুনের আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় দুই মুক্তিযোদ্ধা আলম এবং চুল্লুকে। তখন রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার ছিল চরমে। গুম-খুন করা হতো ভিন্নমতের লোকদের দেশজুড়ে। স্ত্রীসহ আমাকে অপহরণের খবরটি দ্রুতই পৌঁছে যায় ক্যান্টনমেন্টে। এতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিভিন্ন ইউনিট বের হয়ে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি শুরু করে। আমাদের নিয়ে গাড়ি রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু অবস্থা বেগতিক হতে পারে বুঝে গাজী ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে যায় গাড়ির বহর।
আমার দেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যাওয়ার পর কি ঘটেছিল?
ডালিম : শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যাওয়ার পর আমার স্ত্রী কড়া ভাষায় অনেক কথা বলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ, উপ-প্রধান জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং রক্ষীবাহিনীপ্রধান কর্নেল নুরুজ্জামান। শেখ হাসিনা ও শেখ কামালসহ বাড়ির অন্য সদস্যরা আমাদের শান্ত করার চেষ্টায় ছিলেন তখন। শেখ মুজিবুর রহমান তার মোড়লি কায়দায় ঘটনা মিটমাট করে দেন এ ঘটনার সুবিচার করবেন বলে। তবে আমাদের অপহরণের বিচার না করে বরং উল্টো কদিনের মধ্যেই আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
আমার দেশ : কেন চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল?
ডালিম : আমি এবং নুরসহ ৬৫ জন বাছাই করা দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল মুজিব সরকার পিও-৯ প্রয়োগের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে। পাকিস্তান আর্মির ব্যারাক থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তাদের চাকরিচ্যুত সহজে মেনে নেননি কেউ। প্রথম কিস্তিতে যে ৯ জন অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, সেই তালিকায় ১নং ও ২নং-এ ছিলাম আমি এবং নূর। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি এবং নূর শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি তারই অনুরোধে। তিনি সাক্ষাৎকালে আমাদের উল্টো ধৈর্য ধরতে বললেন এবং তার ভাই শেখ নাসেরের সঙ্গে ব্যবসার প্রস্তাব দিলেন, বিদেশের পছন্দের দূতাবাসে কূটনীতিক হিসেবে পাঠানোর প্রস্তাব দিলেন। নিজেরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে চাইলে সহযোগিতা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু আমরা এসবে কোনো সায় দিইনি।
আমার দেশ : আপনার একটি বইয়ে পড়েছি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে শেখ মুজিবুর রহমান মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে রাখতে এবং উপপ্রধান বানানোর পটভূমিটা একটু বলবেন কি?
ডালিম : আপনি ঠিকই পড়েছেন। জিয়াউর রহমানকে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার মিয়ানমারে (সাবেক বার্মা) রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন। এতে আমরাই প্রতিবাদ করেছিলাম। আমাদের সম্মিলিত প্রতিবাদের ফলেই জিয়াউর রহমানের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আর ন্যস্ত করতে সক্ষম হয়নি শেখ মুজিবুর রহমান। তার জন্য উপপ্রধান পদ তৈরি করে সে পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল প্রতিবাদের ফলেই। এই প্রতিবাদে সেনাপরিষদের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল।
আমার দেশ : ১৫ আগস্ট সেনাঅভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কেন?
ডালিম : দেশকে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী ভারতের আধিপত্যবাদ ও একদলীয় বাকশালের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে জনগণের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য।
আমার দেশ : এই অভ্যুত্থানের বিষয়ে এটাও প্রচলিত রয়েছে সিআইএ ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর নেপথ্যে ছিল। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য…
ডালিম : অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর অভ্যুত্থানের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের সবাই ছিলেন সেনাপরিষদের সদস্য পরীক্ষিত বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ করেছিলেন, তারাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অভ্যুত্থানে শরিক হয়েছিলেন। এছাড়া অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র ছিল মানুষের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস। সুতরাং কোনো দেশের গোয়েন্দাদের প্ররোচনায় অভ্যুত্থান হলে দেশের জনগণ এভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন না। বরং বলতে পারেন সাধারণ মানুষের অনুপ্রেরণাই ছিল অভ্যুত্থানের মূল শক্তি।
আমার দেশ : বর্তমানে বাংলাদেশে একটি জনঅভ্যুত্থান হয়েছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডালিম : দৈব কারণে শেখ হাসিনা বেঁচে না থাকলে এ প্রজন্ম বুঝতে পারত না কেন ১৫ আগস্ট বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল। শেখ হাসিনাই প্রমাণ করেছেন ১৫ আগস্ট বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল দেশরক্ষার জন্যই। ১৫ আগস্ট বিপ্লব এবং বর্তমান প্রজন্মের গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা বারবারই বিপ্লবকে বেহাল করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।
আমার দেশ : বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি? এই আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত হওয়ার পথ কী বলে আপনি মনে করেন?
ডালিম : হবু বাংলাদেশকে পর্যায়ক্রমে একটি করদরাজ্য এবং অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা ভারতীয় আধিপত্যবাদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকাল থেকেই শুরু হয়েছিল, দাসত্বমূলক ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রিত মূল মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি প্যারালাল কয়েকটি বাহিনী গঠন করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বিএলএফ’; পরে মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী ইত্যাদি। এই মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনুরা। কাদেরিয়া বাহিনীর নেতা ছিলেন কাদের সিদ্দিকী (গামছা সিদ্দিকী)। এতে স্পষ্ট ছিল ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তাদের নিয়ন্ত্রিত কিছু লোকের মাধ্যমে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, এখনো আছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশের মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি মিলবে না। এর জন্য দরকার দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিকভাবে সচেতন তারুণ্য, ছাত্রছাত্রী এবং জনগণের একটি সুপরিকল্পিত বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের মতো একটি চতুর্থ রিপাবলিক গঠন করে নিজেদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করা এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে তার আলোকে প্রণীত একটি সুচিন্তিত কর্মসূচি প্রণয়ন করে ধাপে ধাপে নতুন এক সুসম, আত্মনির্ভরশীল ও প্রগতিশীল এক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠিত করে দেশকে একটি দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত করে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করা।
আমার দেশ : ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে রক্তপাতহীন আরেকটি অভ্যুত্থানের পর আপনারা ১৫ আগস্ট বিপ্লবীরা একযোগে দেশত্যাগ করেছিলেন। খালেদ মোশাররফকে মোকাবিলা না করে আপনারা দেশত্যাগ করেছিলেন কেন?
ডালিম : খালেদ মোশাররফ ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তার নেতৃত্বে আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল। আমরা তখন মোকাবিলা করতে গেলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতো। এতে ভারত পুরোপুরি বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজেদের দখলে নিতে সহজ হয়ে যেত। আমরা দেশকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই তখন সমঝোতা করে প্রথমে থাইল্যান্ডে যাই। থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে আমরা এয়ারপোর্ট ত্যাগ করি। তবে খালেদ মোশাররফ গংয়ের অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তাই আমরা যাওয়ার সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল নাজমুল হুদার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাই। তবে ওইদিন যাওয়ার আগে আমরা আরেকটি বিপ্লবের জন্য অনুগতদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাই। যার ধারাবাহিকতাই হচ্ছে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব। আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ্য, আমরা যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে শত শত সৈনিক ও অফিসার এসেছিলেন বিদায় জানাতে। বিমান আকাশে ওঠার আগ পর্যন্ত এই সৈনিক ও অফিসাররা আমাদের অভিবাদন জানান।
আমার দেশ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ডালিম : আমার দেশ ও পত্রিকাটির পাঠক এবং বিপ্লবী সম্পাদককে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রেডিওতে মেজর (অব.) ডালিমের কণ্ঠেই প্রথম ঘোষণা হয়েছিল এক সফল সেনা অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার খবর। বর্তমানে আত্মগোপনে থাকা সেই সেনাকর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম আমার দেশকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৫ আগস্টের ঘটনা কেন অনিবার্য ছিল-শেখ হাসিনা তা প্রমাণ করে গেছেন। তিনি বলেন, দেশকে আওয়ামী লুটপাট, বাকশাল ও ভারতীয় বলয় থেকে মুক্ত করতেই সেদিন সেনাপরিষদের উদ্যোগে ১৫ আগস্ট ঘটানো হয়েছিল। ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে মেজর মহিউদ্দিনের ইউনিট থেকে এর সূচনা হয়।
তিনি জানান, ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হয়। মুক্ত হওয়ার পর কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাকে তখন নিয়ে গেলে অন্য কিছু ঘটত। কিন্তু আমরা তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে দিইনি। বরং কর্নেল তাহেরকে ধমক দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়।
লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য স্বাধীনতা-উত্তর শেখ মুজিব সরকারের সময় বীরউত্তম খেতাব পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি পাকিস্তান আর্মির সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান আর্মিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের আর্মি ব্যারাক থেকে পালিয়ে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। গোপনে ব্যারাক থেকে বের হয়ে নানা চড়াই-উৎরাই ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করে পৌঁছান দিল্লি হয়ে কলকাতায়। প্রবাসী সরকারের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সম্মুখ যুদ্ধে কামানের গোলা আর বন্দুকের গুলির আঘাতও লেগেছিল কয়েকবার। শহীদ হতে পারতেন সেই দিনগুলোতে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে বেঁচে গিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের আর্মি ব্যারাক থেকে পালিয়ে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া অফিসারদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। তার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন নুর ও মতি। কর্নেল তাহের, বীরউত্তমেরও তাদের সঙ্গে আসার কথা ছিল। পালানোর প্রস্তুতি চলাকালে তার বদলি আদেশ হওয়ায় একসঙ্গে আসা হয়নি। তিনি পরে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠনেও রয়েছে তার ভূমিকা। স্বাধীনতা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমান সরকার দেশের সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৮ জানবাজ মুক্তিযোদ্ধাকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। সামরিক বাহিনী থেকে পিও-৯ প্রয়োগের মাধ্যমে এই বরখাস্তের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকা থেকে প্রথম কিস্তিতে ৭ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। প্রথম কিস্তিতে আর্মি থেকে অবসরে পাঠানো ৭ জনের মধ্যে যথাক্রমে ১নং ও ২নং অফিসার ছিলেন মেজর ডালিম, বীরউত্তম এবং মেজর নূর, বীরবিক্রম। তিনিই ঘোষণা করেছিলেন, খোন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। পরবর্তীতে ওই বছরের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পর তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়। সমঝোতার ভিত্তিতেই একটি বিশেষ বিমানে করে প্রথমে ব্যাংককে যান; সঙ্গে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল নাজমুল হুদার স্ত্রী। আমার দেশকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তখনকার অস্থির সময়ের অজানা কাহিনি।
বর্তমানে কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম আত্মগোপনে রয়েছেন। খোন্দকার মোশতাক আহমদ সরকারের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা তার বাবা হত্যার অভিযোগে বিচার শুরুর পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। আত্মগোপনে থাকা কর্নেল ডালিমের সাক্ষাৎকার নেন লন্ডনে আমার দেশ-এর আবাসিক সম্পাদক অলিউল্লাহ নোমান
আমার দেশ : আপনি সেনাবাহিনীতে কত সালে যোগ দিয়েছিলেন?
শরিফুল হক ডালিম : আমি প্রথমে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান করেছিলাম এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রবণশক্তি একজন পাইলটের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার নিচে চলে যাওয়ায় আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হয়।
আমার দেশ : আমরা জানি আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং বীরউত্তম খেতাব পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে যদি একটু বলতেন…
ডালিম : আমি তখন পাকিস্তান আর্মিতে ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে পাকিস্তানের কোয়েটায় ছিলাম। যুদ্ধ শুরুর খবর পেয়ে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। কী করা যায় ভাবছিলাম। কীভাবে পাকিস্তান আর্মিকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন হবে- এটাই ছিল ভাবনায়। আমার কমান্ডো ট্রেনিং ছিল। একদিন ভাবলাম পাকিস্তান আর্মির নিয়ন্ত্রিত একটি ডিপো উড়িয়ে দেব। এতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অস্ত্রভান্ডারের অপরিমেয় ক্ষতি হবে। এ পরিকল্পনা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে না পেরে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু থেমে যাইনি। ভাবলাম একটা পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়েছি তো কী হয়েছে! এমন অবস্থায় হঠাৎ করেই একদিন নুর এসে বললেন, ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে কর্নেল) তাহের আমাকে সালাম জানিয়েছেন। তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। জানিয়ে দিলাম রাতে ক্যাপ্টেন তাহেরের ওখানে আমরা একসঙ্গে ডিনার করব। ডিনারের রুমে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ শুরু করি।
আমার দেশ : কী আলাপ হয়েছিল সেদিন?
ডালিম : অনেক কথাবার্তাই হয়েছিল। এক পর্যায়ে তাহের জানালেন, নুর ও তাহের চমন বর্ডার দিয়ে আফগানিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেখান থেকে বাংলাদেশে পৌঁছে যুদ্ধে যোগ দেবেন। পালানোর জন্য স্থানীয় অফিসার হিসেবে আমার সহযোগিতা চাইলেন। কারণ, ওই এলাকাটি আমাদের ইউনিটের অধীনে ছিল। তখন তাকে বললাম, স্যার, আমিও পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং চেষ্টা করছি। এ কথা শুনে তাহের খুব খুশি হলেন এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আরও বললেন, দেরি না করে বর্ডারটা রেকি করে এসো। কথা সেরে দেরি না করে চলে আসি আমি। আসার আগে আমরা ৩ জন কোরআন ছুঁয়ে শপথ করি যে, এই পরিকল্পনার কথা কাউকে বলব না। এখানে বলে রাখতে চাই, সেনাবাহিনীতে তাহের আমার সিনিয়র ছিলেন।
আমার দেশ : আপনারা কখন কীভাবে পালিয়েছিলেন?
ডালিম : সুযোগমতো একদিন আনন্দচিত্তে বর্ডার রেকি করে এলাম। এরপরই গোয়েন্দা বিভাগের আমাদের একজন বাঙালি সৈনিক এসে খবর দিলেন চমন বর্ডার (যে বর্ডার দিয়ে আমরা পালাতে চেয়েছিলাম) দিয়ে পালাতে গিয়ে দুজন কমিশন্ড ও তিনজন ননকমিশন্ড অফিসার আটক হয়েছেন এবং তাদের আফগানিস্তান সরকার পাকিস্তান আর্মিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। দ্রুত তাহেরের কাছে ছুটে গেলাম। ঘটনা জানানোর পর আমরা পরিকল্পনা পরিবর্তন করি। সিদ্ধান্ত হল চমন বর্ডার নিয়ে নয়, অন্য কোনো বর্ডার দিয়ে আমাদের পালাতে হবে। অনেক পর্যালোচনা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম ভাওয়ালপুর-ভাওয়ালনগর বর্ডার দিয়ে আমরা পালাব। এতে সময়ও কম লাগবে।
আমার দেশ : আপনারা কি সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন?
ডালিম : এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই। আমরা পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ খুঁজছি। তখন এপ্রিল মাস। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে মাত্র মার্চ মাসে। সরকারি ছুটির দিনে লেফটেন্যান্ট নুরের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মতি নামে এক বাঙালি অফিসার (পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোর্সে আসা) আসেন আমার মেসে। মতি পালানোর ইচ্ছে প্রকাশ করে আমার পরামর্শ চাইলেন। আমরা যেহেতু কোরআন স্পর্শ করে শপথ করেছিলাম কাউকে বলব না, তাই মতিকে আমাদের বিষয়টি শেয়ার না করে উৎসাহ দিলাম। আমাদের পরিকল্পনা নিজেদের মধ্যে রেখে ছক আঁকতে লাগলাম কীভাবে পালানো যায়।
আমার দেশ : শেষ পর্যন্ত কীভাবে পালিয়েছিলেন?
ডালিম : কীভাবে পালিয়েছিলাম, সেটা বলার আগে আরেকটি বিষয় বলা প্রয়োজন। তা না হলে দুঃসাহসিক এই পালানোর ঘটনা বোঝা যাবে না। একদিন হঠাৎ করেই নুর আসেন। জানতে চাইলাম আমাদের সঙ্গে মতিকে নিলে কেমন হয়। নুর তখন বলেন, বিষয়টা তাহেরের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। নুর এবং আমি তাহেরের কাছে গিয়ে মতির বিষয়টি বললাম। তাহের তখন জানালেন বিশ্বস্ত হলে নিতে সমস্যা নেই।
আমার দেশ : মতিকে সঙ্গে নিয়েই কী পালিয়েছিলেন?
ডালিম : এ বিষয়ে পরে আসছি। পরদিন কোয়েটায় একমাত্র চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমি, নুর ও মতি মিলিত হলাম। এখানে আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতে আসতাম। মতিকে তখন বললাম, তোমার গতকালের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি আজ। আমরা তিনজন (তাহের, নুর এবং আমি) আগে থেকেই পালানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। চমন বর্ডার দিয়ে পালানোর চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু একটা ব্যাটালিয়নের কিছু বাঙালি সৈনিক ও অফিসার পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। তাই আমরা পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছি। এখন চিন্তা করছি ভাওয়ালপুর-ভাওয়ালনগর হয়ে রাজস্থান বর্ডার দিয়ে পালাব। তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে আসতে পার। এতে মতি আনন্দিত হয়েছিলেন। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল পালানোর অপারেশন বাস্তবায়নের জন্য পথের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা কোথায় কী অবস্থা রয়েছে। পাকিস্তানি আর্মিরা কোথায় কোথায় পাহারা বসিয়েছে- সব খবর নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে। আর্মির প্ল্যানিং পাওয়া গেলে পুরো রাস্তাঘাটের অবস্থা জানা যাবে। তাই আমাদের বাঙালি হাবিলদার শফিকের সাহায্য নিলাম। শফিক এই ম্যাপটি জোগাড় করে দিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমাদের সঙ্গে পরবর্তীতে সুমি নামে আরো একজন যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তার শারীরিক কন্ডিশনের কারণে আমাদের সঙ্গে আসতে পারেননি। মরুভূমির বালু তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর ছিল। তাই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ওয়াগা বর্ডার দিয়ে পালানোর জন্য। আমরা রওনা দেওয়ার মুহূর্তে আরেকটি বিপর্যয় নেমে আসে। তাহেরকে হঠাৎ করে বদলি করে দেওয়া হয় অ্যাবোটাবাদে। এতে তাকে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে দ্রুতই। এ খবর পেয়ে মতি, নুর এবং আমি দ্রুতই তাহেরের কাছে যাই। তার কাছে গিয়ে পরিস্থিতি জানলাম। তাহের তখন বললেন, সো হোয়াট! তোমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাও। আমি অ্যাবোটাবাদ থেকে পরবর্তীতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। এভাবেই নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে নুর, মতি এবং আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে দিল্লি হয়ে প্রথম তিনজন বাঙালি অফিসার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হতে সক্ষম হয়েছিলাম।
আমার দেশ : আপনারা যে পথে এসেছিলেন, সেটা তো ছিল মরুভূমির ওপর দিয়ে। হেঁটে ওই মরুভূমি পার হতে কত সময় লেগেছিল?
ডালিম : মরুভূমি তো পরে। আমাদের ভাওয়ালপুর পৌঁছাতেই অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে। আতঙ্ক ছিল পুরো পথজুড়ে। কখন পাকিস্তান আর্মি বা পুলিশের হাতে আটক হয়ে যাই। উড়োজাহাজ, বাস-ট্রেন এবং টেক্সিতে করে অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। বর্ডার ক্রস করে রাজস্থান মরুভূমি যখন পার হই, তখন অনেক ঝুঁকি ছিল। কখনো হেঁটে, ক্রলিং করে পথ অতিক্রম করেছি। ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে ফাঁকি দিতে হয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ডিফেন্স পজিশন ও টহলকে। এভাবেই দৌড়ে-হেঁটে ভারতের শ্রিকরনপুরে আমরা পৌঁছাই। মরুভূমি অতিক্রম করে শ্রিকরনপুরের কাছাকাছি গেলে রাতের আঁধারে বিদ্যুতের বাতি দেখে আমাদের মনে স্বস্তি ও আনন্দ আসে এই ভেবে- এই তো আমরা একটি লোকালয়ে পৌঁছে গেছি।
আমার দেশ : প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে পৌঁছালেন কীভাবে?
ডালিম : আমরা অনেক চিন্তা করলাম। কোথায় আত্মসমর্পণ করলে ভালো হয়। প্রচলিত নিয়মে ভারতে প্রবেশ করেই আত্মসমর্পণ করে আমাদের ইচ্ছার কথা জানানো দরকার ছিল। আবার মনে করলাম যেখানেই আত্মসর্পণ করি, আমাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত আসত কেন্দ্রীয় সরকার থেকে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম দিল্লি গিয়ে আগে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করব। তারপর আমরা আমাদের ইচ্ছার কথা জানাব।
আমার দেশ : আত্মসমর্পণ ও পরবর্তী গল্পটা যদি একটু বলতেন আমাদের পাঠকের জন্য…
ডালিম : আমরা দিল্লিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে আত্মসমর্পণ করবÑ এমন একটি বার্তা দিয়েছিলাম ভারতীয় সাংবাদিকদের। আমাদের আগেই তারা সেখানে পৌঁছে যায়। আমরা গিয়ে দেখি রিসিপশনে অনেক সাংবাদিক বসা। দেখেই বুঝলাম আমাদের বুদ্ধি কাজে লেগেছে। আমরা সেখানে পৌঁছে রিসিপশনে জানালাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। রিসিপশন থেকে জানানোর পর একজন ব্রিগেডিয়ারসহ কয়েকজন অফিসার এসে আমাদের রিসিভ করলেন। সাংবাদিকরা ততক্ষণে ক্যামেরায় ছবি তুলছেন। তবে ভারতীয় অফিসাররা আমাদের বলেছেন, আপনারা কোনো অবস্থায় মুখ খুলবেন না।
আমার দেশ : মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন কবে?
ডালিম : মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আরো কদিন সময় লেগেছিল। ভারতীয় সরকার আমাদের অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। আমরা কী আসলেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে এসেছি, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছেÑ সেটা যাচাই-বাছাই করতে আমাদের অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল, আমরা আসলেই দেশ স্বাধীনের উদ্দেশ্যে এসেছি; নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। কদিন তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের পর নিশ্চিত হয়ে প্রবাসী সরকারের কাছে আমাদের হস্তান্তর করেছিল। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যাত্রা শুরু। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পথ পাড়ি দিতে যেসব হাবিলদার ও সৈনিক আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছে কি না, সেটা জানি না।
আমার দেশ : আমরা আপনার লেখা বইয়ে পড়েছি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘সেনাপরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন গড়েছিলেন। এ বিষয়ে যদি একটু বলতেন…
ডালিম : প্রতিটি পদক্ষেপে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত কষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের কব্জায় চলে যাচ্ছি। এটা যখন উপলব্ধি করলাম, তখন আমাদের মাথায় নতুন ভাবনা আসে। আমরা সমমনা ঘনিষ্ঠ কমান্ডারদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পাকিস্তানিদের থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের অধীনে আমরা থাকব না। প্রয়োজনে আবারও একটি যুদ্ধ করব। একটি প্রকৃত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ তৈরি করব আমরা। যে বাংলাদেশে মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না। এই প্রতিজ্ঞা যাদের ছিল, তাদের নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোপন সংগঠন ‘সেনাপরিষদ’গঠন করা হয়েছিল।
আমার দেশ : স্বাধীন হওয়ার পরও কি সেনাপরিষদের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল?
ডালিম : দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেনাপরিষদের কার্যক্রম গোপনে চলছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে আওয়ামী লীগের লুটপাট ও বাকশাল থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল সেনাপরিষদের সদস্যরাই। ১৫ আগস্টের বিপ্লব এবং তারই ধারাবাহিকতায় ব্রিগেডিয়ার খালেদচক্রের প্রতিক্রিয়াশীল ৩ নভেম্বরের ক্যুদাতার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবেও মূল নেতৃত্ব দিয়েছিল সেনাপরিষদ। সেনাপরিষদ ও কর্নেল তাহেরের সংগঠন মিলেই সৈনিকদের প্রস্তুত করেছিল বিপ্লবের লক্ষ্যে। ১৫ আগস্ট সফল বিপ্লবের পর আরেকটি সেনা ক্যু হয় খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। খালেদের নেতৃত্বে ক্যুর তিন দিনের মাথায় ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ঘটানো হয়েছিল সেনাপরিষদের দেশ ছাড়া নেতৃত্বের পূর্বপরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। খালেদচক্রের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আরো একটি সিপাহি-জনতার বৈপ্লবিক সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ গংয়ের পতন ঘটানো হয়েছিল সেনাপরিষদের সাময়িকভাবে দেশত্যাগী শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দ্বিতীয় সারির নেতা মেজর মহিউদ্দিনের ইউনিট থেকেই বিপ্লবের সূচনা হয়। সঙ্গে ছিল কর্নেল তাহেরের বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার ঢাকায় কয়েকটি ইউনিটে তার অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলা সেলগুলো। এখানে দেশবাসীর জানার জন্য বলছি, কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিল ১৫ আগস্ট বিপ্লবের অনেক আগেই জাসদ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে এনেছিলেন এবং সেনাপরিষদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন।
আমার দেশ : আপনার দাবি অনুযায়ী ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের নেপথ্যে নেতৃত্ব ছিল সেনাপরিষদের নিয়ন্ত্রণে…
ডালিম : বিপ্লবের মূল নেতৃত্ব সেনাপরিষদের হাতেই ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাপরিষদের সদস্য মহিউদ্দিনের নির্দেশেই ৭ নভেম্বর রাত ১২টায় তার ইউনিট থেকে কামানের ট্রেসার গোলা আকাশে ছুড়ে বিপ্লবের সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল। এর পরপরই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ল্যান্সারসহ সব ইউনিটের সেনাসদস্যরা ‘নারায়ে তাকবির ধ্বনিতে স্লোগান দিয়ে বের হয়ে আসেন রাজপথে এবং মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী মহিউদ্দিনের ইউনিট ও ট্যাংক রেজিমেন্ট একই সঙ্গে ৪৬ ব্রিগেডের পদাতিক ইউনিটগুলোর সদস্যরা প্রথমেই রওনা করে তাদের নেতা এবং ১৫ আগস্ট বিপ্লবের পর নিযুক্ত সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে মহিউদ্দিনের ইউনিটেই নিয়ে আসা হয়েছিল। মহিউদ্দিন তখন সংকটের মোকাবিলা করছিলেন ব্যাংককে অবস্থিত শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা মোতাবেক। তাই কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে মহিউদ্দিনের ইউনিট থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেও পারেননি। উল্টো কর্নেল তাহেরকে ধমক দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
আমার দেশ : এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে জানতে চাই। আপনার স্ত্রীকে কেন্দ্র করে একটি ঘটনা মুখে মুখে শোনা যায়। শেখ মুজিবপুত্র শেখ কামাল দুর্ব্যবহার করেছিলেন বলে প্রচারিত রয়েছে। আসলে কী ঘটেছিল লেডিস ক্লাবের বিয়ের অনুষ্ঠানে?
ডালিম : এটি ছিল একটি বিয়ের অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে তৎকালীন রেডক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান ও শেখ মুজিবের অনুগত বিশিষ্ট আস্থাভাজন মাস্তান হিসেবে পরিচিত গাজীর ছেলের সঙ্গে আমার শ্যালকের কথাকাটাকাটি হয়েছিল একটি অশোভন বিষয় নিয়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিশোধ নিতে গাজী তার সশস্ত্র মাস্তান বাহিনী নিয়ে এসে অনুষ্ঠান থেকে আমাকে অপহরণের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আমাকে একটি গাড়িতে তুলে নিলে আমার স্ত্রী এবং খালাশাশুড়িও এই গাড়িতে ওঠেন। সেখানে ওঠানো হয়েছিল নিমন্ত্রিত ক্র্যাক প্লাটুনের আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় দুই মুক্তিযোদ্ধা আলম এবং চুল্লুকে। তখন রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার ছিল চরমে। গুম-খুন করা হতো ভিন্নমতের লোকদের দেশজুড়ে। স্ত্রীসহ আমাকে অপহরণের খবরটি দ্রুতই পৌঁছে যায় ক্যান্টনমেন্টে। এতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিভিন্ন ইউনিট বের হয়ে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি শুরু করে। আমাদের নিয়ে গাড়ি রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু অবস্থা বেগতিক হতে পারে বুঝে গাজী ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে যায় গাড়ির বহর।
আমার দেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যাওয়ার পর কি ঘটেছিল?
ডালিম : শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যাওয়ার পর আমার স্ত্রী কড়া ভাষায় অনেক কথা বলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ, উপ-প্রধান জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং রক্ষীবাহিনীপ্রধান কর্নেল নুরুজ্জামান। শেখ হাসিনা ও শেখ কামালসহ বাড়ির অন্য সদস্যরা আমাদের শান্ত করার চেষ্টায় ছিলেন তখন। শেখ মুজিবুর রহমান তার মোড়লি কায়দায় ঘটনা মিটমাট করে দেন এ ঘটনার সুবিচার করবেন বলে। তবে আমাদের অপহরণের বিচার না করে বরং উল্টো কদিনের মধ্যেই আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
আমার দেশ : কেন চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল?
ডালিম : আমি এবং নুরসহ ৬৫ জন বাছাই করা দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল মুজিব সরকার পিও-৯ প্রয়োগের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে। পাকিস্তান আর্মির ব্যারাক থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তাদের চাকরিচ্যুত সহজে মেনে নেননি কেউ। প্রথম কিস্তিতে যে ৯ জন অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, সেই তালিকায় ১নং ও ২নং-এ ছিলাম আমি এবং নূর। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি এবং নূর শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি তারই অনুরোধে। তিনি সাক্ষাৎকালে আমাদের উল্টো ধৈর্য ধরতে বললেন এবং তার ভাই শেখ নাসেরের সঙ্গে ব্যবসার প্রস্তাব দিলেন, বিদেশের পছন্দের দূতাবাসে কূটনীতিক হিসেবে পাঠানোর প্রস্তাব দিলেন। নিজেরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে চাইলে সহযোগিতা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু আমরা এসবে কোনো সায় দিইনি।
আমার দেশ : আপনার একটি বইয়ে পড়েছি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে শেখ মুজিবুর রহমান মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে রাখতে এবং উপপ্রধান বানানোর পটভূমিটা একটু বলবেন কি?
ডালিম : আপনি ঠিকই পড়েছেন। জিয়াউর রহমানকে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার মিয়ানমারে (সাবেক বার্মা) রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন। এতে আমরাই প্রতিবাদ করেছিলাম। আমাদের সম্মিলিত প্রতিবাদের ফলেই জিয়াউর রহমানের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আর ন্যস্ত করতে সক্ষম হয়নি শেখ মুজিবুর রহমান। তার জন্য উপপ্রধান পদ তৈরি করে সে পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল প্রতিবাদের ফলেই। এই প্রতিবাদে সেনাপরিষদের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল।
আমার দেশ : ১৫ আগস্ট সেনাঅভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কেন?
ডালিম : দেশকে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী ভারতের আধিপত্যবাদ ও একদলীয় বাকশালের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে জনগণের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য।
আমার দেশ : এই অভ্যুত্থানের বিষয়ে এটাও প্রচলিত রয়েছে সিআইএ ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর নেপথ্যে ছিল। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য…
ডালিম : অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর অভ্যুত্থানের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের সবাই ছিলেন সেনাপরিষদের সদস্য পরীক্ষিত বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ করেছিলেন, তারাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অভ্যুত্থানে শরিক হয়েছিলেন। এছাড়া অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র ছিল মানুষের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস। সুতরাং কোনো দেশের গোয়েন্দাদের প্ররোচনায় অভ্যুত্থান হলে দেশের জনগণ এভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন না। বরং বলতে পারেন সাধারণ মানুষের অনুপ্রেরণাই ছিল অভ্যুত্থানের মূল শক্তি।
আমার দেশ : বর্তমানে বাংলাদেশে একটি জনঅভ্যুত্থান হয়েছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডালিম : দৈব কারণে শেখ হাসিনা বেঁচে না থাকলে এ প্রজন্ম বুঝতে পারত না কেন ১৫ আগস্ট বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল। শেখ হাসিনাই প্রমাণ করেছেন ১৫ আগস্ট বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল দেশরক্ষার জন্যই। ১৫ আগস্ট বিপ্লব এবং বর্তমান প্রজন্মের গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা বারবারই বিপ্লবকে বেহাল করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।
আমার দেশ : বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি? এই আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত হওয়ার পথ কী বলে আপনি মনে করেন?
ডালিম : হবু বাংলাদেশকে পর্যায়ক্রমে একটি করদরাজ্য এবং অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা ভারতীয় আধিপত্যবাদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকাল থেকেই শুরু হয়েছিল, দাসত্বমূলক ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রিত মূল মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি প্যারালাল কয়েকটি বাহিনী গঠন করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বিএলএফ’; পরে মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী ইত্যাদি। এই মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, হাসানুল হক ইনুরা। কাদেরিয়া বাহিনীর নেতা ছিলেন কাদের সিদ্দিকী (গামছা সিদ্দিকী)। এতে স্পষ্ট ছিল ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তাদের নিয়ন্ত্রিত কিছু লোকের মাধ্যমে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, এখনো আছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশের মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি মিলবে না। এর জন্য দরকার দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিকভাবে সচেতন তারুণ্য, ছাত্রছাত্রী এবং জনগণের একটি সুপরিকল্পিত বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের মতো একটি চতুর্থ রিপাবলিক গঠন করে নিজেদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করা এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে তার আলোকে প্রণীত একটি সুচিন্তিত কর্মসূচি প্রণয়ন করে ধাপে ধাপে নতুন এক সুসম, আত্মনির্ভরশীল ও প্রগতিশীল এক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠিত করে দেশকে একটি দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত করে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করা।
আমার দেশ : ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে রক্তপাতহীন আরেকটি অভ্যুত্থানের পর আপনারা ১৫ আগস্ট বিপ্লবীরা একযোগে দেশত্যাগ করেছিলেন। খালেদ মোশাররফকে মোকাবিলা না করে আপনারা দেশত্যাগ করেছিলেন কেন?
ডালিম : খালেদ মোশাররফ ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তার নেতৃত্বে আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল। আমরা তখন মোকাবিলা করতে গেলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতো। এতে ভারত পুরোপুরি বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজেদের দখলে নিতে সহজ হয়ে যেত। আমরা দেশকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই তখন সমঝোতা করে প্রথমে থাইল্যান্ডে যাই। থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে আমরা এয়ারপোর্ট ত্যাগ করি। তবে খালেদ মোশাররফ গংয়ের অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তাই আমরা যাওয়ার সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল নাজমুল হুদার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাই। তবে ওইদিন যাওয়ার আগে আমরা আরেকটি বিপ্লবের জন্য অনুগতদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাই। যার ধারাবাহিকতাই হচ্ছে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব। আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ্য, আমরা যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে শত শত সৈনিক ও অফিসার এসেছিলেন বিদায় জানাতে। বিমান আকাশে ওঠার আগ পর্যন্ত এই সৈনিক ও অফিসাররা আমাদের অভিবাদন জানান।
আমার দেশ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ডালিম : আমার দেশ ও পত্রিকাটির পাঠক এবং বিপ্লবী সম্পাদককে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৩ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৩ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৪ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে