এলাহী নেওয়াজ খান
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস ও নিষ্ঠুরতম যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে থাকে ইসরাইল, যা তথাকথিত পশ্চিমা সভ্যতা দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই যুদ্ধনীতির নাম হচ্ছে ‘দাহিয়া ডকট্রিন’। অর্থাৎ একজন শত্রুকে হত্যা করতে যদি শত শত নিরীহ বেসামরিক লোক নিহত হয়; কিংবা বেসামরিক সব স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়, তাতে কিছু আসে যায় না।
এর লক্ষ্য হচ্ছে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার মাধ্যমে জনগণকে রেজিমবিরোধী করে তোলা। এ ধরনের যুদ্ধনীতি জেনেভা কনভেনশনের চরম লঙ্ঘন হলেও পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই সমর্থন করে থাকে। কারণ দেশটি ইসরাইল, তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোনো আইন, নিয়মকানুন প্রযোজ্য নয়। তাকে পশ্চিমারা বলে থাকে, দেশটির (ইসরাইলের) আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে।
সাধারণত পৃথিবীর যেকোনো দেশের প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনী জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধকালীন সময়ে শুধু সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করে থাকে। কিন্তু ইসরাইল আন্তর্জাতিক কোনো আইনেরই তোয়াক্কা করে না। দেশটি অনেক বছর ধরে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়াসহ আশপাশের দেশগুলোয় অহরহ যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আক্রমণ চালিয়ে থাকে, তাতে বেসামরিক মানুষ ও স্থাপনার ক্ষতি হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। অথচ এই একই কাজ যদি অন্য কোনো দেশ করে, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো সে দেশটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে মানবতাবিরোধী তকমা লাগিয়ে।
গাজায় ইসরাইলের বাহিনীর বেপরোয়া ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ আক্রমণের চিত্র বিশ্ববাসী এমন দেখছে। কীভাবে বেসামরিক এলাকায় হাজার হাজার টন বোমা ফেলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশু। মাসের পর মাস এভাবে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলের রক্তপিপাসু সেনাবাহিনী। এই যে ধরুন ইরানের ভবনটিতে তারা যে বিজ্ঞানী সপরিবার বাস করত, সেই ভবনে ইসরাইল মিসাইল আক্রমণ চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এতে সপরিবারে ওই বিজ্ঞানীই শুধু শহীদ হননি, তার সঙ্গে ওই ভবনে বসবাসকারী সবাই শহীদ হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১ জন ছিল শিশু।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার ‘পোড়ামাটি নীতির’ সঙ্গে ইসরাইলের ‘দাহিয়া ডকট্রিনের’ যথেষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে। আমেরিকান বাহিনী ভিয়েতনামে যে ‘অপারেশন রোলিং থান্ডার’ শুরু করেছিল, তার লক্ষ্য ছিল ভিয়েতনামকে প্রস্তর যুগে নিয়ে যাওয়া, যা এখন গাজায় ইসরাইল করছে। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা হয়তো এখনো অনেকের মনে আছে। মার্কিন সেনা অফিসার লে. উইলিয়াম কেলির নেতৃত্বে পরিচালিত সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে পাঁচ শতাধিক গ্রামবাসী নিহত হয়েছিল, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু।
সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই স্থির ছবিটির কথা বিশ্ববাসীর নিশ্চয়ই মনে আছে, যা বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে গিয়েছিল নিদারুণভাবে। ছবিটি এ রকম ছিলÑপেছনে নাপাম বোমা বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের কুণ্ডলী আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে আর সামনে একটি নগ্ন শিশু প্রাণ ভয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বের বিবেকবান মানুষ যেন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনিরা ৫০ থেকে ৮০ লাখ টনের মতো বোমা ফেলেছিল, যার অধিকাংশ ছিল নাপাম বোমা। এই বোমার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া। এর আগে মার্কিনিরা এই নাপাম বোমা ব্যবহার করেছিল ১৯৫০ সালে কোরিয়া যুদ্ধের সময়।
১৯৫৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ২০ বছর পর ১৯৭৫ সালে মার্কিন বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে, যার পুনরাবৃত্তি আমরা আবার দেখেছি আফগানিস্তানে। এই যুদ্ধও শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে। আর ২০ বছর পর ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছিল একই ধরনের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে।
আমেরিকার ওই ধরনের যুদ্ধনীতির অনুকরণেই ইসরাইল ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ নামে যুদ্ধনীতি সূচনা করে, যার লক্ষ্য হচ্ছে নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ হত্যা ও বেসামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা। আর দাহিয়া হচ্ছে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে উপকণ্ঠের সেই এলাকাটির নাম, যেখানে ইসরাইলি বাহিনী ১৯০৬ সালে ভয়াবহ একটি গণহত্যা চালিয়েছিল। আর এটা ছিল হিজবুল্লাহ মিলিশিয়ার আবাসিক এলাকা যে স্থানে বেসামরিক লোকজন বসবাস করত। তা ছাড়া এখানেই অবস্থিত ছিল হিজবুল্লার সদর দপ্তর। ২০০৬ সালের যুদ্ধের সময় ইসরাইল দাহিয়া এলাকায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। এতে ১০০০-এর মতো বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশু।
ইসরাইলের এই সামরিক ডকট্রিনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বেসামরিক লোকজন হত্যা করা এবং বিদ্যুৎ, পানির লাইন, রাস্তাঘাট অর্থাৎ সব ধরনের বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলা। ইসরাইল মনে করে, এর ফলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হয়ে হিজবুল্লা ও হামাসের মতো সংগঠনের বিরুদ্ধে চলে যাবে। এরই ফল হচ্ছে গাজার ধ্বংসযজ্ঞ। একই লক্ষ্যে সর্বশেষ ইসরাইল ইরানের বেসামরিক এলাকায় ব্যাপকভাবে মিসাইল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ জনগণকে বর্তমান ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। অবশেষে যা রেজিম চেঞ্জের সহায়ক হবে বলে তারা মনে করে। তবে ইসরাইলের এবারের কৌশলটা ভুল জায়গায় প্রয়োগ হয়েছে। কারণ ইরানের প্রত্যাঘাতটা এত ভয়াবহ হয়েছে, যা ইসরাইলি যুদ্ধবাজরা কখনো কল্পনাও করেনি।
বহু বছর ধরে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির কারণে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, পৃথিবীর কোনো শক্তি দেশটির সীমানা অতিক্রম করে হামলা চালাতে পারবে না। কিন্তু ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর হামাসের প্রতিরোধ-যোদ্ধারা ইসরাইলের সব ধরনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ উপেক্ষা করে দেশটির অভ্যন্তরে ঢুকে যে অভিযান পরিচালনা করেছিল, তা ইসরাইলি বাহিনীর পৌরাণিক শক্তিকেই শুধু ধুলায় লুটিয়ে দেয়নি; বরং বিশাল আরব ভূখণ্ড দখল করে বৃহৎ ইসরাইলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অলীক স্বপ্নকেও ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। এখন ইরান ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক মিসাইল হামলা চালিয়ে সেই গৌরব আরো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। বরং ইসরাইলি কৌশল এখন তার নিজ জনগণের মধ্যে উল্টো ফল বয়ে এনেছে। কারণ একদা ইসরাইলের যে জনগণ দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ভাবত; কিংবা যে দেশটিতে তারা ইউরোপীয় ধাঁচের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, সেই দেশটিতে তারা এখন প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে।
অর্থাৎ ইরানের প্রতিশোধমূলক পাল্টা আক্রমণ এখন ইসরাইলের জন্য বুমেরাং হয়েছে। অর্থাৎ ইসরাইল যে কৌশল তার শত্রুদের জন্য প্রয়োগ করেছিল, তা ফিরে এসেছে নিজ জনগণের মধ্যে। এই জনগণ এখন ইসরাইলি রেজিম চেঞ্জের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এদিকে ইসরাইল বর্তমানে কতটা নাজুক অবস্থায় পড়েছে, সেটি বুঝতে হলে দেশটির অতীত শক্তিমত্তা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেওয়া দরকার। কারণ বহু বছর ধরে ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) বিশ্ববাসীর কাছে অপরাজীয় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই বাহিনী সম্পর্কে এ রকম একটা অলীক ধারণা বিরাজ করে আসছে, যা অনেকের কল্পনাকেও ছাপিয়ে গেছে। তারা মনে করে আসছে, পৃথিবীর যেকোনো দেশের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে তছনছ করে দিতে পারে এই বাহিনী। যেন একটা পৌরাণিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে তারা।
তবে এ ধারণা অমূলকও ছিল না। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের আরব যুদ্ধে মাত্র ছয় দিনে মিসর সিরিয়া ও জর্দানের বিশাল এলাকা দখল নেওয়ার সাফল্য ইসরাইলে সেনাবাহিনীকে দুনিয়ার মানুষের কাছে সত্যিই একটা অলীক শক্তিতে পরিণত করেছিল। সেই সঙ্গে এটাও সত্য, ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনী অপ্রতিরোধ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মিসরের কাছে পরাজয় ইসরাইলের কল্পনাতীত ধারণা অনেকটা ম্লান হয়ে যায়।
তবে ১৯৭৬ সালে ইসরাইলি কমান্ডোরা রাতের আঁধারে উগান্ডার এন্টবি বিমানবন্দরে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে ১০৬ জন জিম্মি উদ্ধারের পর এই বাহিনী আবার আলোচনায় চলে আসে। সে সময় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ-যোদ্ধারা একটা যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাইয়ের পর এন্টবি বিমানবন্দরে অবতরণ করে ১০৬ জন যাত্রীকে জিম্মি করেছিল। ইসরাইল কমান্ডোদের খুব সফল অভিযানটি বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপর সিরিয়া ও ইরাকে আরো কিছু সফল বিমান হামলা ইসরাইলি বিমানবাহিনীকে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে তুলে দিয়েছিল।
কিন্তু ২০০৬ সালে হিজবুল্লার বিরুদ্ধে ৩৪ দিনের যুদ্ধে কোনো সাফল্য অর্জন না করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়া এবং ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের ইসরাইল অভ্যন্তরের সফল অভিযান এবং বর্তমানে ইরানের ভয়াবহ হামলা ইসরাইলের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিরই প্রমাণ বহন করছে।
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস ও নিষ্ঠুরতম যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে থাকে ইসরাইল, যা তথাকথিত পশ্চিমা সভ্যতা দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই যুদ্ধনীতির নাম হচ্ছে ‘দাহিয়া ডকট্রিন’। অর্থাৎ একজন শত্রুকে হত্যা করতে যদি শত শত নিরীহ বেসামরিক লোক নিহত হয়; কিংবা বেসামরিক সব স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়, তাতে কিছু আসে যায় না।
এর লক্ষ্য হচ্ছে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার মাধ্যমে জনগণকে রেজিমবিরোধী করে তোলা। এ ধরনের যুদ্ধনীতি জেনেভা কনভেনশনের চরম লঙ্ঘন হলেও পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই সমর্থন করে থাকে। কারণ দেশটি ইসরাইল, তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোনো আইন, নিয়মকানুন প্রযোজ্য নয়। তাকে পশ্চিমারা বলে থাকে, দেশটির (ইসরাইলের) আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে।
সাধারণত পৃথিবীর যেকোনো দেশের প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনী জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধকালীন সময়ে শুধু সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করে থাকে। কিন্তু ইসরাইল আন্তর্জাতিক কোনো আইনেরই তোয়াক্কা করে না। দেশটি অনেক বছর ধরে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়াসহ আশপাশের দেশগুলোয় অহরহ যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আক্রমণ চালিয়ে থাকে, তাতে বেসামরিক মানুষ ও স্থাপনার ক্ষতি হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। অথচ এই একই কাজ যদি অন্য কোনো দেশ করে, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো সে দেশটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে মানবতাবিরোধী তকমা লাগিয়ে।
গাজায় ইসরাইলের বাহিনীর বেপরোয়া ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ আক্রমণের চিত্র বিশ্ববাসী এমন দেখছে। কীভাবে বেসামরিক এলাকায় হাজার হাজার টন বোমা ফেলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশু। মাসের পর মাস এভাবে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলের রক্তপিপাসু সেনাবাহিনী। এই যে ধরুন ইরানের ভবনটিতে তারা যে বিজ্ঞানী সপরিবার বাস করত, সেই ভবনে ইসরাইল মিসাইল আক্রমণ চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এতে সপরিবারে ওই বিজ্ঞানীই শুধু শহীদ হননি, তার সঙ্গে ওই ভবনে বসবাসকারী সবাই শহীদ হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১ জন ছিল শিশু।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার ‘পোড়ামাটি নীতির’ সঙ্গে ইসরাইলের ‘দাহিয়া ডকট্রিনের’ যথেষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে। আমেরিকান বাহিনী ভিয়েতনামে যে ‘অপারেশন রোলিং থান্ডার’ শুরু করেছিল, তার লক্ষ্য ছিল ভিয়েতনামকে প্রস্তর যুগে নিয়ে যাওয়া, যা এখন গাজায় ইসরাইল করছে। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা হয়তো এখনো অনেকের মনে আছে। মার্কিন সেনা অফিসার লে. উইলিয়াম কেলির নেতৃত্বে পরিচালিত সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে পাঁচ শতাধিক গ্রামবাসী নিহত হয়েছিল, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু।
সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই স্থির ছবিটির কথা বিশ্ববাসীর নিশ্চয়ই মনে আছে, যা বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে গিয়েছিল নিদারুণভাবে। ছবিটি এ রকম ছিলÑপেছনে নাপাম বোমা বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের কুণ্ডলী আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে আর সামনে একটি নগ্ন শিশু প্রাণ ভয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বের বিবেকবান মানুষ যেন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনিরা ৫০ থেকে ৮০ লাখ টনের মতো বোমা ফেলেছিল, যার অধিকাংশ ছিল নাপাম বোমা। এই বোমার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া। এর আগে মার্কিনিরা এই নাপাম বোমা ব্যবহার করেছিল ১৯৫০ সালে কোরিয়া যুদ্ধের সময়।
১৯৫৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ২০ বছর পর ১৯৭৫ সালে মার্কিন বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে, যার পুনরাবৃত্তি আমরা আবার দেখেছি আফগানিস্তানে। এই যুদ্ধও শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে। আর ২০ বছর পর ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছিল একই ধরনের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে।
আমেরিকার ওই ধরনের যুদ্ধনীতির অনুকরণেই ইসরাইল ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ নামে যুদ্ধনীতি সূচনা করে, যার লক্ষ্য হচ্ছে নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ হত্যা ও বেসামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা। আর দাহিয়া হচ্ছে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে উপকণ্ঠের সেই এলাকাটির নাম, যেখানে ইসরাইলি বাহিনী ১৯০৬ সালে ভয়াবহ একটি গণহত্যা চালিয়েছিল। আর এটা ছিল হিজবুল্লাহ মিলিশিয়ার আবাসিক এলাকা যে স্থানে বেসামরিক লোকজন বসবাস করত। তা ছাড়া এখানেই অবস্থিত ছিল হিজবুল্লার সদর দপ্তর। ২০০৬ সালের যুদ্ধের সময় ইসরাইল দাহিয়া এলাকায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। এতে ১০০০-এর মতো বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশু।
ইসরাইলের এই সামরিক ডকট্রিনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বেসামরিক লোকজন হত্যা করা এবং বিদ্যুৎ, পানির লাইন, রাস্তাঘাট অর্থাৎ সব ধরনের বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলা। ইসরাইল মনে করে, এর ফলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হয়ে হিজবুল্লা ও হামাসের মতো সংগঠনের বিরুদ্ধে চলে যাবে। এরই ফল হচ্ছে গাজার ধ্বংসযজ্ঞ। একই লক্ষ্যে সর্বশেষ ইসরাইল ইরানের বেসামরিক এলাকায় ব্যাপকভাবে মিসাইল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ জনগণকে বর্তমান ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। অবশেষে যা রেজিম চেঞ্জের সহায়ক হবে বলে তারা মনে করে। তবে ইসরাইলের এবারের কৌশলটা ভুল জায়গায় প্রয়োগ হয়েছে। কারণ ইরানের প্রত্যাঘাতটা এত ভয়াবহ হয়েছে, যা ইসরাইলি যুদ্ধবাজরা কখনো কল্পনাও করেনি।
বহু বছর ধরে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির কারণে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, পৃথিবীর কোনো শক্তি দেশটির সীমানা অতিক্রম করে হামলা চালাতে পারবে না। কিন্তু ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর হামাসের প্রতিরোধ-যোদ্ধারা ইসরাইলের সব ধরনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ উপেক্ষা করে দেশটির অভ্যন্তরে ঢুকে যে অভিযান পরিচালনা করেছিল, তা ইসরাইলি বাহিনীর পৌরাণিক শক্তিকেই শুধু ধুলায় লুটিয়ে দেয়নি; বরং বিশাল আরব ভূখণ্ড দখল করে বৃহৎ ইসরাইলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অলীক স্বপ্নকেও ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। এখন ইরান ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক মিসাইল হামলা চালিয়ে সেই গৌরব আরো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। বরং ইসরাইলি কৌশল এখন তার নিজ জনগণের মধ্যে উল্টো ফল বয়ে এনেছে। কারণ একদা ইসরাইলের যে জনগণ দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ভাবত; কিংবা যে দেশটিতে তারা ইউরোপীয় ধাঁচের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, সেই দেশটিতে তারা এখন প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে।
অর্থাৎ ইরানের প্রতিশোধমূলক পাল্টা আক্রমণ এখন ইসরাইলের জন্য বুমেরাং হয়েছে। অর্থাৎ ইসরাইল যে কৌশল তার শত্রুদের জন্য প্রয়োগ করেছিল, তা ফিরে এসেছে নিজ জনগণের মধ্যে। এই জনগণ এখন ইসরাইলি রেজিম চেঞ্জের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এদিকে ইসরাইল বর্তমানে কতটা নাজুক অবস্থায় পড়েছে, সেটি বুঝতে হলে দেশটির অতীত শক্তিমত্তা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেওয়া দরকার। কারণ বহু বছর ধরে ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) বিশ্ববাসীর কাছে অপরাজীয় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই বাহিনী সম্পর্কে এ রকম একটা অলীক ধারণা বিরাজ করে আসছে, যা অনেকের কল্পনাকেও ছাপিয়ে গেছে। তারা মনে করে আসছে, পৃথিবীর যেকোনো দেশের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে তছনছ করে দিতে পারে এই বাহিনী। যেন একটা পৌরাণিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে তারা।
তবে এ ধারণা অমূলকও ছিল না। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের আরব যুদ্ধে মাত্র ছয় দিনে মিসর সিরিয়া ও জর্দানের বিশাল এলাকা দখল নেওয়ার সাফল্য ইসরাইলে সেনাবাহিনীকে দুনিয়ার মানুষের কাছে সত্যিই একটা অলীক শক্তিতে পরিণত করেছিল। সেই সঙ্গে এটাও সত্য, ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনী অপ্রতিরোধ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মিসরের কাছে পরাজয় ইসরাইলের কল্পনাতীত ধারণা অনেকটা ম্লান হয়ে যায়।
তবে ১৯৭৬ সালে ইসরাইলি কমান্ডোরা রাতের আঁধারে উগান্ডার এন্টবি বিমানবন্দরে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে ১০৬ জন জিম্মি উদ্ধারের পর এই বাহিনী আবার আলোচনায় চলে আসে। সে সময় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ-যোদ্ধারা একটা যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাইয়ের পর এন্টবি বিমানবন্দরে অবতরণ করে ১০৬ জন যাত্রীকে জিম্মি করেছিল। ইসরাইল কমান্ডোদের খুব সফল অভিযানটি বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তারপর সিরিয়া ও ইরাকে আরো কিছু সফল বিমান হামলা ইসরাইলি বিমানবাহিনীকে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে তুলে দিয়েছিল।
কিন্তু ২০০৬ সালে হিজবুল্লার বিরুদ্ধে ৩৪ দিনের যুদ্ধে কোনো সাফল্য অর্জন না করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়া এবং ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের ইসরাইল অভ্যন্তরের সফল অভিযান এবং বর্তমানে ইরানের ভয়াবহ হামলা ইসরাইলের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিরই প্রমাণ বহন করছে।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১২ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে