আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

সরকারের সাফল্য ও ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা

এলাহী নেওয়াজ খান
সরকারের সাফল্য ও ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা

জটিল এক সন্ধিক্ষণে আমরা অবস্থান করছি। জুলাই বিপ্লবোত্তর-সৃষ্ট এই সন্ধিক্ষণ এখন নানা ব্যাপারে আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেষ করে বিপ্লবের পর এই দেশের মানুষ ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা কতটা বাস্তবে রূপ নেবে, সেটি নিয়ে এখনই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন, নাকি আদর্শহীনতা, অনৈক্য এবং পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে ধ্বংসের অতল গহ্বরে পতিত হবে?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৫৪ বছরে এ দেশের মানুষ একদলীয় শাসন, স্বৈরশাসন, ফ্যাসিবাদী শাসন দেখেছে এবং পর্যায়ক্রমিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে গত বছর জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত বিপ্লবের পর গত ১৫ মাসের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে একদিকে যেমন আশাবাদী হয়ে ওঠার অনেক কারণ রয়েছে; অন্যদিকে চরম হতাশার বার্তাও রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কিছু সাফল্য আমাদের যেমন আশার আলো প্রদান করছে, ঠিক অন্যদিকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে। বরং বলা যায়, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্রমান্বয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়েই চলেছে। এর ফলে জনগণের মধ্যে এক ধরনের হতাশা লক্ষ করা যাচ্ছে।

বিশেষ করে নানা বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা সত্ত্বেও স্বল্পসময়ের মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কিছু বড় সাফল্য আগামী দিনের সরকারের জন্য তুলনামূলক আলোচনা করার অবকাশ তৈরি করেছে। সামনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বর্তমান সরকারের সাফল্যগুলো ধরে রাখার পাশাপাশি আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন খুব চ্যালেঞ্জিং হবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।

একটি বিষয় সবার মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে অবাধ লুটপাট, লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, অনুৎপাদক খাতে বিপুল বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় নেমে এনেছিল, তা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের কৃতিত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন : ব্যাংক খাত, বাজারব্যবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার সাফল্য সরকারের রয়েছে।

এ ব্যাপারে সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যেমনটা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে অর্থনীতি এ সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল, সেটি তো খুব জটিল অবস্থায় ছিল। অর্থনীতিতে সামষ্টিক স্থিতিশীলতার একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ছিল সরকারের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, টাকার পতন আটকানো, সুদের একটা অবস্থায় রাখা, বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদী। এসব কাজের ব্যাপারে সাফল্য এসেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে তিনি এই সাফল্যকে বাইরের খাত থেকে হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, রেমিট্যান্স বেড়েছে, রপ্তানি চালু আছে, আমদানি কম হওয়ার ফলে একটা ভারসাম্য এসেছে এবং সরকার অনেক পুরোনো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে, এ সময়কালে সেই অর্থে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেনি।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল জুলাই হত্যার বিচার, প্রশাসন, নির্বাচন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার করা। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে। একটি অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এ ধরনের বিচার সম্পূর্ণ করা সত্যিই কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু সেটি হয়েছে এবং বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েনি। কিংবা বিচলিত হয়নি।

অন্যদিকে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে ‘জুলাই সনদ’ গৃহীত হয়েছে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে, যা আগামীতে গণভোটের মাধ্যমে আইনের রূপ নেবে।

এ সরকারের আরেকটি সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা। বিচারকদের দীর্ঘদিনের এই দাবি পূরণ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করে রাখার স্বার্থে অতীতের কোনো সরকার এই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। গত ৩০ নভেম্বর প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক আদেশ জারির মাধ্যমে এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলো। এর ফলে বিচার বিভাগ আইন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেল।

এটি বিচার বিভাগ সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেক বড় একটি অগ্রগতি। এছাড়া বিচার বিভাগের অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এ সম্পর্কে যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এর আগে যেমনটা বিবিসিকে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন এই তিনটি ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রগতি হয়েছে। আর বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধÑএ নিয়ে বিতর্কের আর সুযোগ নেই।

অন্তর্বর্তী সরকারের ওইসব সাফল্যের পটভূমিতে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যারা সরকার গঠন করবে, তারা ওই সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দোদুল্যমান দেখা দিয়েছে। কারণ ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বর্তমানে যে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে, তা নির্বাচনের পরও অব্যাহত থাকলে, মানুষের মধ্যে এ ধরনের দোদুল্যমান দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। যদিও ইতোমধ্যে জনগণ নির্বাচনি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি একটু আনন্দমুখর মনে হচ্ছে। কিন্তু আবার হঠাৎ করে স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং নির্বাচন কমিশনবিষয়ক কমিটির প্রধান নজরুল ইসলাম খানের একটা মন্তব্য কারো কারো মধ্যে নির্বাচন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। তিনি বলেছেন, অনিবার্য কারণ ছাড়া নির্বাচন বিলম্বিত হোক, তা বিএনপি চায় না। হঠাৎ করে নজরুল ইসলাম খানের এই মন্তব্য অনেকের কাছে একটু অন্যরকম মনে হয়েছে।

যাহোক, যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান আগাগোড়ায় একই রকম আছে। এর থেকে সরকার কখনোই ভিন্ন কোনো কথা বলে নি, এমনকি অনিবার্য কারণ বিষয়টিও কখনো উল্লেখ করেনি। ফলে নজরুল ইসলাম খানের ওই মন্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের একদম অমূলক নয়। কারণ বিএনপি প্রথম থেকেই নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে ছিল। হঠাৎ করে নজরুল ইসলাম খান অনিবার্য কারণের কথাটা উল্লেখ করার ফলে ভিন্ন গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করছে কেউ কেউ।

পরিশেষে এটা বলা যায়, যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন হবে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের আশঙ্কা সৃষ্টি করা হয়নি। বরং নির্বাচন কমিশন খুব দৃঢ়তার সঙ্গে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। তবে অনিবার্য কারণ সবসময়ই ভবিষ্যতের গর্ভে বিরাজ করে, যা মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা, অনিবার্য কারণ কিংবা ক্রান্তিকাল ইত্যাদি সব কথাবার্তা নতুন কোনো বিষয় নয়। কারণ গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না নেওয়ার ফলে এই অনিশ্চয়তার বিষয়টি আমাদের রাজনীতিতে সবসময়ই আছে।

এ দেশের মানুষের মধ্যে এই অনিশ্চয়তার বিষয়টি এতটা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে কোনো কিছু বললেও জনগণ তা সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। এই যে ধরুন অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে আসছে এবং সপ্তাহখানেক আগে নির্বাচন কমিশনও নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচনের কথা বললেও সন্দেহ রয়েই গেছে। এখনো মানুষের মুখে মুখে সেই একই প্রশ্ন নির্বাচন হবে তো?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন