আর্থিক সুশাসনে অডিট ও অ্যাকাউন্টস এক রাখার প্রয়োজনীয়তা

ওয়াহিদুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৫৬

বাংলাদেশে যখনই কোনো খাতে জটিলতা দেখা দেয়, তখন সমাধান হিসেবে হয় একীভবন, নয় পৃথক্‌করণের প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু কাঠামো পরিবর্তনের আগে বাস্তবতা না বোঝা বিপজ্জনক—যেমন রোগ নির্ণয় না করে ওষুধ দিলে রোগী বিপদে পড়ে, তেমনি প্রশাসনিক পুনর্গঠনও জটিলতা বাড়াতে পারে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি দুর্নীতিগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংক একীভবনের প্রস্তাব এবং অডিট ও হিসাব সার্ভিস পৃথক করার চিন্তা—দুটি বিষয়ই বাংলাদেশের আর্থিক সুশাসনের পরীক্ষিত ভিত্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সুশাসনের তিন স্তম্ভ—স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহি রক্ষায় অডিট (নিরীক্ষা) ও অ্যাকাউন্টস (হিসাবরক্ষণ) সার্ভিসকে একই কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) অধীনে রাখা সাংবিধানিকভাবে অপরিহার্য।

সংবিধানের ১২৮ ও ১৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সি অ্যান্ড এজি তার দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং রাষ্ট্রীয় হিসাব কীভাবে রক্ষিত হবে, সেটি নির্ধারণের এখতিয়ার তারই। যদি হিসাবরক্ষণ নির্বাহী বিভাগের হাতে যায়, তবে এটি সংবিধানের লঙ্ঘন হবে, আর নিরীক্ষার স্বাধীনতা হারাবে ভিত্তি।

ভারত, পাকিস্তান ও কানাডার মতো কমনওয়েলথ দেশগুলোতেও অডিট ও হিসাব একই কাঠামোর অধীনে থাকে। এতে আর্থিক তথ্যপ্রবাহ স্বচ্ছ হয় এবং প্রাথমিক স্তরেই অনিয়ম ধরা যায়।

বাংলাদেশে অর্থ খরচের আগে বিলের বৈধতা যাচাই বা প্রি-অডিটই সবচেয়ে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এটি সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ, যা দুর্নীতি ঘটার আগেই ঠেকায়। কিন্তু ব্যয়ের পর পোস্ট-অডিট হয় সীমিত পরিসরে; তখন অর্থ ফেরত আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

যদি হিসাবরক্ষণ নির্বাহী বিভাগের অধীনে যায়, প্রি-অডিট বিলুপ্ত হবে। অর্থ অনুমোদনকারী কর্মকর্তারাই তখন বিল যাচাই করবেন—এটি হবে ক্লাসিক ‘স্বার্থের সংঘাত’। এতে আর্থিক অনিয়ম আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে।

অডিট ও হিসাব সার্ভিস আলাদা করলে কয়েকটি গুরুতর ঝুঁকি তৈরি হবে—

ক. স্বার্থের সংঘাত ও নির্বাহী প্রভাব : হিসাব বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গেলে বিল তৈরি ও অনুমোদন একই হাতে পড়বে, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নষ্ট হবে।

খ. প্রশাসনিক বৈষম্য : অতীতে ইকোনমিক ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়ার মতো ইতিহাস আবার পুনরাবৃত্তি হতে পারে, এতে অসন্তোষ বাড়বে।

গ. পূর্ব অভিজ্ঞতা : ২০১০-১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এমন উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, কারণ বাস্তবতা বিবেচনা করা হয়নি।

ঘ. সংসদীয় তদারকির দুর্বলতা : সি অ্যান্ড এজি দুর্বল হলে সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিও কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে।

‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, অডিট ও হিসাব পৃথক করলে নিরীক্ষকের স্বাধীনতা বাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উচ্চ দুর্নীতিপ্রবণ দেশে এর ফল হবে উল্টো।

  • সংবিধান লঙ্ঘন : হিসাবরক্ষণ সি অ্যান্ড এজি’র বাইরে গেলে ১২৮ ও ১৩১ অনুচ্ছেদ অকার্যকর হবে।
  • প্রি-অডিট বিলুপ্তি : দুর্নীতি ঠেকানোর প্রধান অস্ত্র হারাবে।
  • স্বার্থের সংঘাত : বিল তৈরির ক্ষমতা ও অনুমোদন একই হাতে পড়বে।
  • জ্ঞানের ক্ষয় : একীভূত কাঠামো ভেঙে গেলে কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিচ্ছিন্ন হবে।

অতএব, লক্ষ্য পূরণের পথ পৃথক্‌করণ নয়, বরং একীভূত কাঠামো সংস্কার ও আধুনিকীকরণ।

বাংলাদেশে আর্থিক সুশাসনের মূল চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি, বিলম্বিত ব্যয় ও দুর্বল প্রকল্প ব্যবস্থাপনা। তাই প্রয়োজন একীভূত কাঠামোকে শক্তিশালী করা।

সংস্কারের দিকনির্দেশনা হতে পারে—

১. ডিজিটাল প্রি-অডিট : প্রতিটি বিল তাৎক্ষণিকভাবে সি অ্যান্ড এজি অফিসে যাচাই হবে।

২. প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন : সি অ্যান্ড এজি অফিসকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা।

৩. প্রশিক্ষণ : কর্মকর্তাদের তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দক্ষ করা।

৪. PAC শক্তিশালীকরণ : নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বাস্তবায়নে সংসদীয় কমিটিকে বাড়তি ক্ষমতা দেওয়া।

এভাবেই ‘জুলাই সনদ’-এর লক্ষ্য স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন বাস্তবায়িত হবে।

সংবিধান কেবল সি অ্যান্ড এজি’র (সিএজি) স্বাধীনতাই নয়, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করে। এই ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব একীভূত কাঠামো বজায় রাখলে।

হিসাবরক্ষণ নির্বাহী বিভাগের হাতে গেলে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়বে, আর রাষ্ট্রের মৌলিক চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ভেঙে পড়বে। তাই অডিট ও অ্যাকাউন্টস সার্ভিসকে একই কাঠামোয় রাখা সাংবিধানিক, বাস্তব ও নৈতিকভাবে অপরিহার্য।

পৃথক্‌করণের পথে না গিয়ে একীভূত কাঠামোকেই যুগোপযোগী করে সংস্কার করা—এটাই বাংলাদেশের আর্থিক সুশাসনের নিরাপদ ও কার্যকর পথ।

জরুরি অবস্থা জারি করলেন পেরুর প্রেসিডেন্ট

এবার ১ টাকায় গরুর মাংস বিতরণের ঘোষণা সেই এমপি প্রার্থীর

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বহন করা সেই প্রিজন ভ্যানে কী আছে

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের নেয়া হয়েছে ক্যান্টনমেন্টের অস্থায়ী কারাগারে

গাজায় স্বাস্থ্য সংকট কয়েক প্রজন্ম থাকবে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত