দম বন্ধ হওয়ার মতো সেই ৭২ ঘণ্টা

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১১: ১৪

সেটা ছিল দমবন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি। সারা বাংলাদেশ যেন থেমে গিয়েছিল। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছিল সবার মধ্যে। যেন ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল সবার। তখন ঢাকায় যারা ছিলেন, তারা বুঝতে পারছিলেন সংকটের গভীরতা। এটা ছিল ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা দখল-পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার নাটকীয় ঘটনাবলি।

বিজ্ঞাপন

খালেদ মোশাররফ প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদকে উৎখাত করেন এবং গৃহবন্দি করেন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। ওইদিনেই খালেদ মোশাররফ মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। পক্ষান্তরে খন্দকার মোশতাক আহমেদের স্থলে প্রেসিডেন্ট করা হয় সাবেক প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মো. সায়েমকে। কিন্তু এই প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারছিল না। এটা মানুষের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। আমরা তখন গুলবাগে থাকতাম। একটি কারণে আমাদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছিল প্রচণ্ডভাবে। আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আর সেটার কারণ ছিল যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর মালিবাগ মোড়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগের একটি অফিসকে কে বা কারা মসজিদে রূপান্তর করে ফেলেছিল। আজও মসজিদটি সেখানে আছে।

৩ নভেম্বর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা পলাতক অবস্থা থেকে এলাকায় ফিরে এসে যারা মসজিদ বানিয়েছেন, তাদের খুঁজতে থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই যারা আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক করত, তাদেরই টার্গেট করেন। আমরা বেশ কিছু বন্ধু সে সময় বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ফলে আমরা গা-ঢাকা দিয়ে চলাফেরা করতে থাকলাম। চামেলীবাগের আমার এক বন্ধুর মামার বাড়ি ছিল আমাদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান।

জনগণের মধ্যে উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে একটি ছবিকে কেন্দ্র করে। ছবিটি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। সেটি ছিল খালেদ মোশাররফের মা এবং ভাই রাশেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি মিছিলের ছবি। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সমর্থনে এই মিছিলটি করা হয়েছিল। আর রাশেদ মোশাররফ ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। ফলে জনমনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, এটা ভারতপন্থি একটি অভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনার পাঁয়তারা। এই ধারণা সারা দেশে স্পার্ক করে তীব্রভাবে।

এদিকে তীব্র উত্তেজনা-উৎকণ্ঠের মধ্যে আমরা খবর পারছিলাম যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টগুলো থেকে সৈনিকরা ঢাকা অভিমুখে রওনা হয়েছে। তখন তো মোবাইল ছিল না, সুতরাং খবরগুলো কখনো সঠিক মনে হয়েছে আবার কখনো মনে হয়েছে এসব গুজব। কিন্তু ৫ নভেম্বর রাত থেকে স্পষ্ট খবর আসতে থাকে আমাদের কাছে। হ্যাঁ, দেশের অন্যান্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈনিকরা সত্যিই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।

এটি ছিল ৬ নভেম্বরের রাত। নিস্তব্ধ ঢাকা মহানগরী। নিদ্রাহীন ঢাকার মানুষ ঘরে বসে ছটফট করছিল। আমাদের কারো চোখে ঘুম নেই। তখন রাত ৩টা বাজে। হঠাৎ একটি স্লোগান রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সবার কানে এসে বাজল। সেই স্লোগানের ভাষা ছিল ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবার, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। আর এই স্লোগানেই সবাই বুঝে গেলেন যে, ঘটনা উল্টে গেছে। লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে আসা শুরু করল। ফজরের নামাজের পর দেখা গেল রাজধানীর সড়কগুলো লোকে লোকারণ্য।

যা হোক, একটি রিকশা নিয়ে আমরা দুই বন্ধু মিলে সারা শহর ঘুরে দেখেছিলাম। সব জায়গায় ছিল একই চিত্র। মিষ্টির দোকানগুলো একদম খালি হয়ে গিয়েছিল। ১৫ আগস্টের ঘটনার পরও এক ধরনের মিষ্টি বিতরণের দৃশ্য চোখে পড়েছিল। একইভাবে ২৪-এর গণবিপ্লবের পর মিষ্টির দোকানগুলো খালি হয়ে যায়। এদেশের মানুষ বড় কিছু ঘটলেই মিষ্টি বিলাতে পছন্দ করে। যাই হোক, সে সময় অনেক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছিলেন, ১৫ আগস্ট কারফিউ জারি থাকার কারণে মানুষ রাস্তায় নামতে পারেনি। তাই ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে সেটারই বিস্ফোরণ ঘটেছে।

প্রথমে খুব সকালেই মালিবাগ মোড়ে গিয়ে দেখতে পেলাম ট্যাংকের গলায় মালা আর উপরে বসে আছে সাধারণ মানুষজন। এটা ছিল সিপাহি ও জনতার মধ্যকার এমন এক মেলবন্ধনের দৃশ্য, যা আগে কখনো এদেশে দেখা যায়নি। সিপাহিরা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে বের করে আনলেন। সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের এই সর্বাত্মক আনুগত্য সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের আত্মবিশ্বাসকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই পরে বিচারপতি সায়েম স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট পথ থেকে পদত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণ করেন এবং গণভোটের মাধ্যমে আইনগত বৈধতা করিয়ে নেন।

সে সময় জিয়াউর রহমানের পেছনে ছিলেন মধ্যমসারির সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা। আর খালেক মোশাররফের পেছনে মদতদাতা হিসেবে ছিলেন বেশ কতক ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা। তারা সবাই ছিলেন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অনেকেই ৭ নভেম্বর নিহত হন। তাদের মধ্যে কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দারের নাম বেশ মনে পড়ছে। আমার যতটুকু মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার পতনের খবর টেলিভিশনে প্রথম যিনি প্রচার করেছিলেন, তিনি ছিলেন তৎকালীন মেজর হায়দার।

মূলত সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে একটি ভারতপন্থি অভ্যুত্থানের দ্রুত অবসান এবং বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানের মুক্তিলাভ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মেরূকরণের ইঙ্গিত ফুটে উঠেছি জাতির সামনে । আর এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। এই জনপ্রিয়তা তাকে এমন কিছু কাজ করতে উৎসাহিত করেছিল, যা সাধারণত কোনো সামরিক নেতা করেন না। তিনি একদলীয় শাসনের ধ্বংসস্তূপের ওপরে একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্রের অবরুদ্ধ স্বাধীনতাকে তিনি মুক্ত করেন। ওই সময় সব পত্রিকা নিষিদ্ধ করে সরকারের অধীনে মাত্র চারটি পত্রিকা অবশিষ্ট রাখা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান আবার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন।

অন্যদিকে ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল, যার ওপর ভিত্তি করে পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির) উত্থান ঘটে। তা ছাড়া স্বাধীনতার পরপর প্রচণ্ড চাপে থাকা দক্ষিণপন্থি দলগুলো মুক্ত পরিবেশ লাভ করে। সেই ধারায় বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো চলছে।

সেই সময়কার বেশ কিছু মজাদার ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বিশেষ করে, ৩ নভেম্বর থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত বঙ্গভবনে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা বিনিদ্র রজনি কাটাচ্ছিলেন। সিনিয়র সাংবাদিকরা উপস্থিত থাকতেন। যে বঙ্গভবন ক্ষমতার রদবদলের মঞ্চ, সেখানেই বসে কর্মকর্তারা বুঝতে পারছিলেন না দেশে কী ঘটতে যাচ্ছে। তাই একজন কর্মকর্তা অন্য একজনকে বললেন, বিবিসি ধরো, শোনো দেশের খবর কী বলছে? অর্থাৎ জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি এবং প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাককে হটাতে পারলেও সেনাবাহিনী এবং দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন। ফলে তার ক্ষমতা দ্রুত হাতছাড়া হয়ে যায় এবং ভাগ্যের এক করুণ পরিণতি তাকে ও তার সহযোদ্ধাদের বরণ করতে হয়।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত