বিশ্বরাজনীতিতে মিথ

ইমরান রহমান
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৫, ১০: ৫৫

হিটলারের প্রচারমন্ত্রী যোসেফ গোয়েবলস আবিষ্কৃত বহুল আলোচিত একটি তত্ত্ব হলো-একটি মিথ্যাকে বারবার বললে তা একসময় সত্য হয়ে যায়। গোয়েবলসের এই তত্ত্ব অবশ্য হিটলারকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় এবং আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করতে পারেনি।

তবে যাদের কাছে হিটলার যুদ্ধে হেরেছিলেন, তারা পরে এই তত্ত্বের সফল প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে তত্ত্বটি সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, এটি বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই বিশেষ করে যুদ্ধরত দেশগুলোয় কীভাবে রাজনীতিকরা মিথ বা শোনা কথার সঠিক প্রয়োগে মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। মিথকে সত্য বলে প্রচারের এই প্রচেষ্টাকে এক কথায় বলা যেতে পারে হেত্বাভাস বা সত্যের অপলাপ।

যা হোক, সর্বনাশা মিথের সর্বশেষ নজিরটি ছিল সম্ভবত বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমি ইস্যুতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়। ২০১৯ সালে ভারতীয় সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের রায়ে বিশ্ববাসীর দেখার সুযোগ হয়েছিল আবেগের কাছে যুক্তি ও সত্যের পরাজয়; সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে শতকোটি মানুষের ন্যায়বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি বিচারব্যবস্থার জিম্মিদশা। নিঃসন্দেহে সেই রায় ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির ওপর এক বড় আঘাত। কেননা একজনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আরেকজনের অধিকার হরণ কখনোই ন্যায়বিচার হতে পারে না।

এই রায় বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়কে শুধু ক্ষুব্ধই করেনি, এটি ছিল তাদের ধর্মানুভূতিতে সরাসরি আঘাত। পৃথিবীর যেকোনো স্থানেই একটি মসজিদের উপস্থিতি মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের মজবুত ভিত্তি এবং সেই এলাকায় তাদের উপস্থিতির নিদর্শন। বাবরি মসজিদ কেসটি শুধু একটি জমি বা ভবনের বিষয় ছিল না। ভারতের মুসলমানদের মৌলিক অধিকার, মর্যাদা এবং আইনি সুরক্ষার প্রশ্নে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই মামলায় যে মুসলিমরা ন্যায়বিচার পাবে না, সে আশঙ্কা আমার আগে থেকেই ছিল। এর কারণ, এর অব্যবহিত আগে ভারতীয় আদালত ইসলাম নির্দেশিত তিন তালাককে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে।

যে আদালত নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের আচরণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয় কিংবা নিজস্ব মত চাপিয়ে দেয়, তার কাছে তো ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আস্থা রাখা যায় না। এদিক থেকে অযোধ্যা রায়টি ছিল Miscarriage of justice বা ন্যায়বিচারের বরখেলাপ। এর মাধ্যমে বস্তুত বিজেপির অতীতের সব অন্যায় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি ভারতে মুসলিম জাতীয়তাবাদকে পুরোপুরি উৎখাত করে দেশটিকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কয়েকধাপ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। তদুপরি রায়টি ভারতে পাকিস্তানবিদ্বেষী মনোভাব উসকে দিয়ে উপমহাদেশের আঞ্চলিক অস্থিরতা আরো তীব্রতর করার ইন্ধনপূর্ণও বটে।

আমি আইনবিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু অযোধ্যা রায়টি আমাকে সংশ্লিষ্ট বিচারকদের ইসলামি আইন সম্পর্কিত জ্ঞান সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছে। যদি ইসলামি যুদ্ধনীতি এবং অন্য ধর্মের প্রতি ইসলামের আচরণবিধি সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও থাকত, তবে তারা এমন রায় দিতে পারতেন না। কোনো ধর্মের উপাসনাস্থল ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ ইসলামে অনুমোদিত নয়। সম্রাট বাবর ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু মানুষ। তিনি ছিলেন একজন সুকবিও।

ইসলাম সম্পর্কে তার পড়াশোনা ছিল অগাধ। তাই, প্রধান সেনাপতি মীর বাকিকে মন্দির ধ্বংস করে তিনি মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন-কথাটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। মুসলিমরা ভারতীয় উপমহাদেশে তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেছেন-কথাটি ঠিক নয়। এটি একটি একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মনে হয়, আট শ বছরের দীর্ঘ মুসলিম শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারত ইসলামের আলোর সংস্পর্শে এসে নিজেকে সতীদাহ, নরবলি এবং নানা কুসংস্কারের শয়তানি প্রথা থেকে মুক্ত করেছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াইয়ে বিভিন্ন সময়ে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের নাম নরেন্দ্র মোদির বাসভবন থেকে মাত্র ঢিল-ছোড়া দূরত্বে, ঐতিহাসিক ইন্ডিয়া গেটে উৎকীর্ণ রয়েছে। মোদি কি জানেন, খোদাই করা ৯২,৩৯৩ জন শহীদের নামের মধ্যে ৬২,০০০-এরও বেশি মুসলিম?

মুসলিম উৎখাতের অংশ হিসেবে ভারতব্যাপী বর্তমান উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ঐতিহাসিক মূল্যসম্পন্ন বিভিন্ন ইসলামি স্থাপনা, সড়ক এবং পুরোনো স্থাপত্য পুনঃনামকরণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে বিশেষ পরিচিত। যতদূর জানি, শাহ শব্দটি ফারসি শব্দ। প্রশ্ন হলো, অমিত শাহ কেন তার নাম পরিবর্তন করছেন না? ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি অর্জনকারী খেলোয়াড় আজহারউদ্দিন। আজহারউদ্দিনের নামও কি পরিবর্তন করা হবে?

লেখক : কবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত