বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী—বিশেষত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের ইতিহাস, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রগঠনে যে অবদান রেখে এসেছে, তা অনন্য এবং তুলনাহীন। এই বাহিনী কেবল একটি আধুনিক সামরিক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি জন্মলগ্ন থেকেই জনগণের সেনাবাহিনী। কারণ এই বাহিনীর শেকড় কোনো অভিজাত সামরিক প্রতিষ্ঠানে নয়, বরং একটি জনগণের যুদ্ধের ভিত থেকে তৈরি। ১৯৭১ সালে জনগণের প্রতিরোধ, মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগঠন, স্থানীয় প্রতিরোধ বাহিনী এবং পাকিস্তানি দমননীতির বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ানো যুবকদের হাত ধরে যে সংগঠন রূপ নিতে শুরু করেছিল, সেটিই আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সুতরাং এই বাহিনীকে দেশের ইতিহাস, জাতির আবেগ এবং জনগণের বিশ্বাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা কখনোই সম্ভব নয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের ভূমিকা ছিল বিজয়ের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে কর্মরত প্রায় ১১ হাজার বাঙালি সামরিক সদস্য বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এর মধ্যে প্রায় চার হাজার ছিলেন কমিশন্ড অফিসার, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং সেনারা, যারা সরাসরি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পুরো মুক্তিবাহিনীর প্রায় ৩০ শতাংশের ভিত্তি ছিল এই পেশাদার সৈনিকদের ওপর। তাই বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কাঠামোর প্রাণ ছিলেন সেনাবাহিনী থেকেই আসা মুক্তিযোদ্ধারা। এ কারণেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম পরিচয়—একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। ১৯৭৫ সালেও সেনাবাহিনী দেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধান থেকে ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করেন, বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করেন এবং রক্ষীবাহিনী নামে দলীয় বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো শুরু করে। দেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করার পাঁয়তারা যখন চলছিল, তখন মুষ্টিমেয় দেশপ্রেমিক সেনাসদস্য দেশকে উদ্ধার করেন। মুজিবকে তার পরিবারের সদস্যসহ হত্যা করা হয়। সরকারের পরিবর্তন হয়, কিন্তু সেই ঘটনার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাষ্ট্র পুনর্গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যদিও ১৯৭৫ ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়, তবুও এর পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী দেশের স্থিতিশীলতা, সরকার পরিচালনা এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের সময় সেনাবাহিনী আবারও জনগণের পাশে দাঁড়ায়। সামরিক আইন প্রশাসন নিজেই যখন গণবিক্ষোভের সামনে নতি স্বীকার করে, তখন সেনাবাহিনী রাজনৈতিক রক্তপাত না ঘটিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখায়। সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্ত ‘সেনাবাহিনী থাকবে ব্যারাকে’—বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় একটি মোড় পরিবর্তনের ঘটনা। এই সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও দেশপ্রেমের প্রমাণ হিসেবে আজও আলোচিত। ২০২৪ সালে আবারও একই দৃশ্য দেখা যায়। ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পুরো দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সরকারি বাহিনীর দমন–পীড়নে শত শত মানুষ নিহত হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর নীরব কিন্তু নির্ণায়ক ভূমিকা ছিল দেশে আসন্ন গৃহযুদ্ধ ঠেকানো। সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি, বরং মানবিক অবস্থান বজায় রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বহু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকই বলেছেন, ২০২৪ সালের সংকটময় মুহূর্তে সেনাবাহিনী যদি ভুল সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হতো।
এতকিছুর পরও দুঃখজনকভাবে দেখা গেছে, দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা কিছু উচ্চাভিলাষী, লোভী ও অনৈতিক কর্মকর্তাকে বিভিন্ন উপায়ে সামরিক বাহিনীতে প্রভাববিস্তারের সুযোগ দেন। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য ও ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে পদোন্নতি, বিদেশ মিশন, নিয়োগ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। কতিপয় অফিসারের মধ্যে অর্থলোভ, ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কে জড়ানো, ক্ষমতার অপব্যবহার, এমনকি প্রতিপক্ষকে দমানোর জন্য সামরিক গোয়েন্দা ব্যবস্থার অপপ্রয়োগ—এসবই সেনাবাহিনীর সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অবশ্যই এসব দুর্নীতিগ্রস্ত বা নৈতিকতাহীন কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। এটি কেবল সুশাসনের জন্যই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি শিক্ষা; কিন্তু এও সত্য—কতিপয় ব্যক্তির ভুলের দায় পুরো বাহিনীর নয়। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে বিদেশে ও দেশে কিছু ব্যক্তি, বিশেষ করে কিছু ইউটিউবার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সেনাবাহিনীর ভুলভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। তারা সেনাবাহিনীকে ‘সফট টার্গেট’ ভেবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। দেশের শত্রুশক্তির বর্ণনার সঙ্গে এসব বক্তব্যের বিস্ময়কর মিল লক্ষ করা যায়। এ ধরনের প্রচারণা শুধু বাহিনীকে নয়, রাষ্ট্রকেই দুর্বল করে। কারণ দেশের সর্বশেষ ভরসা, জাতীয় নিরাপত্তার স্তম্ভ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের রক্ষক—এমন প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে রাষ্ট্রই অরক্ষিত হয়ে পড়ে। পৃথিবীর কোনো দেশেই নিজস্ব সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন প্রকাশ্য অপপ্রচার সহ্য করা হয় না। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন, ভারতের কৌশলগত নীতিনির্ধারক মহলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে একটি ‘কৌশলগত বাধা’ হিসেবে বিবেচনা করে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় একটি শক্তিশালী, পেশাদার ও দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তারা প্রাকৃতিক প্রতিরোধশক্তি হিসেবে দেখে। কারণ একটি আত্মবিশ্বাসী ও ঐক্যবদ্ধ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা করে এবং বাইরের কোনো শক্তিকে অযথা প্রভাববিস্তারের সুযোগ দেয় না। এ কারণে ভারতের নীতি-অভিধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দুর্বল হলে কিংবা বিভক্ত হলে আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানো তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে উঠবে—এ ধারণা বহুদিন ধরেই আলোচনায় আছে।
ভারতের নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, বাংলাদেশে কোনো অস্থিতিশীলতা বা রাজনৈতিক দুর্বলতা থাকলে দুই দেশের সম্পর্ককে দিল্লি আরো সুবিধাজনকভাবে পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু একটি সুসংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং জনমুখী সেনাবাহিনী থাকা মানে বাংলাদেশ সহজে বাহ্যিক চাপের কাছে নত হতে চায় না। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলছে, ২০০৯ সালের পর থেকে ভারত বিভিন্ন সময়ে সামরিক মহলে প্রভাববিস্তারের চেষ্টা করেছে—কখনো দ্বিপক্ষীয় সামরিক সহযোগিতার নামে, কখনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করে। একই সময়ে সমাজমাধ্যমে বা বিদেশি ইউটিউব চ্যানেলগুলোয় সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করা, দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে প্রচার করা, কিংবা আর্মিকে জনগণের আস্থার বাইরে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে। এসব প্রচারণা সাধারণত এমন শক্তিগুলোর স্বার্থেই হয়, যারা চায় বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় দৃঢ়তা দুর্বল হোক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব প্রচেষ্টা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এগুলো একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, যার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কাঠামোকে সন্দেহ, সমালোচনা ও অভ্যন্তরীণ বিভাজনের মধ্যে ফেলে দেওয়া। সেনাবাহিনী দুর্বল হলে সীমান্তনীতি, বাণিজ্যিক চাপ, পানিবণ্টন, নিরাপত্তা চুক্তি—সবই ভারতের পক্ষে আরো সুবিধাজনক হয়ে যাবে। তাই জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশকে এ ধরনের গোপন কৌশল, প্রচারণা ও বিভাজনমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। সেনাবাহিনীর মর্যাদা ও ঐক্য রক্ষা করা শুধু সামরিক প্রয়োজন নয়, এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এ মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়ন করা। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীসহ পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করা জরুরি। উন্নত রাডার, উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, সাইবার প্রতিরক্ষা ইউনিট—এসব শক্তি বাড়ানো জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। কারণ বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের ভূকৌশল, ভারতের আক্রমণাত্মক লুক ইস্ট নীতি, চীনের প্রভাব, রোহিঙ্গা সমস্যা, মিয়ানমারের সংঘাত—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
একই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। রাজনৈতিক সরকারগুলোর ব্যক্তিগত স্বার্থে সেনাবাহিনী ব্যবহার করা, পদোন্নতিতে হস্তক্ষেপ, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার—এসব বন্ধ করতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষত ডিজিএফআই এবং অন্যান্য সংস্থাকে আরো পেশাদার, আধুনিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা জরুরি। প্রকৃত সামরিক গোয়েন্দাগিরি, কাউন্টার–ইন্টেলিজেন্স, সাইবার নজরদারি এবং সীমান্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী একটি অপরিহার্য স্তম্ভ। তাদের শক্তি, মর্যাদা, ঐতিহ্য ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা জাতির দায়িত্ব। যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তারা জানুক—বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনোই জনগণের বিরুদ্ধে যায়নি; বরং ইতিহাসের প্রতিটি টার্নিং পয়েন্টে দেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাই এই বাহিনীকে দুর্বল করা মানে দেশকে বিপন্ন করা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো ব্যক্তির নয়, এটি জাতির—এটি আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সম্মানের প্রতীক। দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা এবং জনগণের আস্থা রক্ষায় এখনই প্রয়োজন সঠিক সংস্কার, আধুনিকীকরণ ও বাহিনীর মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া।
hrmrokan@hotmail.com

