নাজিব ওয়াদুদ
ঔপনিবেশিক এবং বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে আজকাল বাংলা দিন, মাস বা বছর তেমন একটা অনুসৃত হয় না। অথচ বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। নববর্ষ পালনের বিষয়-আশয় ও পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কও প্রচুর। তাছাড়া বাংলা নববর্ষকে যারা বাঙালিত্বের অপরিহার্য ও আবশ্যিক উৎসব বলে প্রচার করেন তারাও বছরের বাকি দিনগুলোতে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা দূরের কথা, এর কোনো খোঁজও রাখেন না। পরদিনই প্রত্যাবর্তন করেন পাশ্চাত্য জীবনযাপনে এবং সেটাকেই তারা প্রগতিশীলতা বলে মনে করেন। আমরা দেখি এই একটি দিনে যা-কিছু করা হয়Ñ পান্তা-ইলিশ খাওয়া, তাঁতের গেরুয়া শাড়ি-ফতুয়া-পাঞ্জাবি পরা, রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া, ইত্যাদিÑ বছরের বাকি তিনশ চৌষট্টিটি দিন তার কোনো খোঁজ থাকে না। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের বাংলা নববর্ষের সৃষ্টি, বিকাশ এবং উদযাপনের ইতিহাস জানতে হবে। সেই সঙ্গে ঔপনিবেশিকতা এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যকেও বুঝতে হবে।
বাংলা নববর্ষ বা বৈশাখী সংস্কৃতি মানে বাংলা বর্ষকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, যা এদেশের ঋতুবৈচিত্র্য, চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চারু ও কারুশিল্প, মেলা, নানা রকম খেলা এবং উৎসব-আমোদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দিনটির সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক যে একচেটিয়া বিষয়টি তা-ও নয়, কারণ এসব কর্মকাণ্ড কম-বেশি সারা বছর ধরেই চলে। তবে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি অর্থাৎ নববর্ষের শুরুটা উদযাপিত হয় ঢাকঢোল পিটিয়ে, বিপুল আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসাহের সঙ্গে।
বাংলা বর্ষের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে নানা মত রয়েছে, তবে এই মতটাই প্রধান এবং সর্বজনগ্রাহ্য যে তার উদ্ভব ঘটে মোগল বাদশাহ আকবরের শাসনামলে, তারই উদ্যোগে। ভারতবর্ষে সে সময় চান্দ্র বর্ষ অর্থাৎ হিজরি পঞ্জিকা অনুসৃত হতো। চান্দ্র বর্ষ সৌর বর্ষের চেয়ে ১১ দিন কম হওয়ার কারণে চান্দ্র বর্ষে ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। ফলে ঋতুনির্ভর চাষাবাদ এবং খাজনা আদায়ের মতো অনেক কাজ করতে অসুবিধা হতো। খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর চান্দ্র ও সৌর বর্ষের মধ্যে সমন্বয়ের উদ্যোগ নেন। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রচলিত সৌর ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম নির্ধারণ করেন।
বাংলা নববর্ষের নাগরিক উদযাপনে ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠান (মূলত রবীন্দ্রসংগীতানুষ্ঠান) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রধান এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ছায়ানটের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘স্বদেশে রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে’ ১৯৬১ সালে তার যাত্রা শুরু। রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৬৩ সালে ছায়ানট সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরের বছর রমনার বটমূলে সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানাদির বাইরে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে এটাই এ ধরনের প্রথম নাগরিক অনুষ্ঠান। তারপর থেকে এটা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। ছায়ানট রবীন্দ্র জন্মবার্ষিক (২৫ বৈশাখ) ও মৃত্যুবার্ষিকী (২২ শ্রাবণ), শারদোৎসব ও বসন্তোৎসবও খুব গুরুত্ব সহকারে পালন করে। রবীন্দ্রচর্চার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে অবদান রাখার জন্য ভারত সরকার ২০১৫ সালে ছায়ানটকে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ প্রদান করে। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালকরা ভারতপন্থি বামপন্থি রাজনৈতিক ঘরানার মানুষ, মূলত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এরা জীবনদর্শনের দিক থেকে নাস্তিকতাবাদী এবং ধর্ম-কর্মের বিরোধী। অথচ একজন পুরোদস্তুর আস্তিক, এমনকি একটি নতুন ধর্মের (ব্রাহ্ম) প্রবর্তকদের অন্যতম রবীন্দ্রনাথের চর্চা এবং তার জীবনদর্শন প্রচারকে এরা কেবল লক্ষ্য হিসেবেই গ্রহণ করেনি, রবীন্দ্রচর্চাকে ধর্মচর্চার পর্যায়ে উন্নীত করেছে। কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক এবং ছায়ানটের মূল কর্ণধার সন্জীদা খাতুনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান এরা রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনাসংগীত দিয়ে সম্পন্ন করেছে। অর্থাৎ ধর্ম না মানলেও এরা একজন ধার্মিক মানুষের কবিতা ও গানচর্চাকে ধর্মচর্চার মতো পবিত্র ও অবশ্যপালনীয় জ্ঞান করছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলা নববর্ষ উদযাপনে সর্বশেষ সংযোজন। ১৯৮৫ সালে যশোরে কয়েকজন চারুশিল্পী পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে একটি পদযাত্রার আয়োজন করেন। বলা হয় এটি ছিল ‘তৎকালীন স্বৈরশাসন ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের প্রতীক।’ অর্থাৎ নববর্ষ উদযাপনের এই আয়োজনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল ছিল। যশোরের এই আয়োজকরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের কিছু ছাত্র-শিক্ষককে উদ্বুদ্ধ করে ১৯৮৯ সালে একই ধরনের পদযাত্রার আয়োজন করে। তার নাম দেওয়া হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এর মূল পৃষ্ঠপোষকরাও মূলত বামপন্থি। সাংগঠনিকভাবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট- উদীচী এক্ষেত্রে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করে থাকে। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকদের অন্যতম ওয়াহিদুল হক এবং ইমদাদ হোসেন ১৯৯৬ সালে এর নামকরণ করেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এই পদযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে রমনার বটমূলে ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠানে গিয়ে মিলিত হয়।
ছায়ানটের বর্ষবরণ সংগীতানুষ্ঠান এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজক, পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থকরা সবাই ভারতপন্থি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারকবাহক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও নাস্তিকতাবাদী মানুষ, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নামে বিশেষ ভারতপন্থি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের পৃষ্ঠপোষকতা করা। বিষয়টি বোঝার জন্যে উপনিবেশবাদ এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।
একটি দেশ বা জাতি যখন আরেকটি দেশ বা জাতিকে প্রত্যক্ষভাবে দখলে নিয়ে তার ওপর শোষণ-শাসন চালায় তখন সেটাকে আমরা উপনিবেশ এবং এই তত্ত্বকে উপনিবেশবাদ বলি। উপনিবেশবাদের প্রধান লক্ষ্য ‘বশংবদ’ তৈরি করা। ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশিতের ওপর কেবল বস্তুগত শোষণই চালায় না, তার মনের ওপরেও এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, সে নিজেকে অধমর্ণ বলে মনে করে। সে মনে করে সে ছোট, তার যা-কিছু রয়েছে তার সবকিছুই সেকেলে, উৎকর্ষে ঔপনিবেশিকের চেয়ে গৌণ, সে কারণে তার উচিত কেবল ঔপনিবেশককে অনুকরণ ও অনুসরণ করে যাওয়া।
এডওয়ার্ড সাঈদ দেখিয়েছেন, উপনিবেশবাদ হচ্ছে এমন একটা বিশিষ্ট চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি যার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক উপনিবেশিতের ওপর তার প্রাধান্য বিস্তার করে, তাকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী বিনির্মাণ করে এবং তার ওপর কর্তৃত্ব করে। এভাবে মানব প্রজাতিকে সে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেÑ একদিকে থাকে ‘আমরা’, অর্থাৎ ঔপনিবেশিকরা; অন্যদিকে থাকে ‘অন্যরা’ অর্থাৎ উপনিবেশিতরা। ঔপনিবেশিক কখনো কখনো উপনিবেশিতকে চিন্তা-চেতনা এবং বাস্তব আচার-ব্যবহারে এতটাই অধমর্ণ করে তোলে যে সে এমনকি শোষণকে চেনার ও বোঝার জ্ঞান ও সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে এবং তার প্রতিবাদ করার কৌশল ও ভাষা খুঁজে পায় না।
সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে উপনিবেশবাদের একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক আধিপত্য বলতে বোঝায় একটি দেশ বা জাতি কর্তৃক আদর্শিকভাবে অন্য একটি দেশ বা জাতির ওপর প্রাধান্য বিস্তার ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইতালির চিন্তাবিদ-দার্শনিক আন্তোনিয়ো গ্রামসি এই তত্ত্বের উদ্গাতা। এক্ষেত্রে দেশ বা ভূখণ্ডকে রাজনৈতিক বা সামরিকভাবে দখল করা হয় না। এটাকে পরোক্ষ উপনিবেশ বলা যায়। এটা করা হয় সামাজিক সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে, যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে এমন একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবিচারপদ্ধতি এবং বয়ান তৈরি করা হয় যা ওই দেশ বা জাতির মূল্যবোধ, রসম-রেওয়াজ, চিন্তাধারা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনদর্শন ও আচরণকে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রণ করে। আক্রান্ত জাতি নিজেকে বিস্মৃত হয় এবং আগ্রাসী জাতিকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে। তখন সে আগ্রাসী জাতির জীবনদর্শন ও সংস্কৃতিকে নিজের জীবনদর্শন ও সংস্কৃতি বলে মেনে নেয়। তারা বুঝতেই পারে না যে তাদের ওপর এটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। বরং তারা ভাবতে থাকে যে এটাই স্বাভাবিক, অবধারিত, এবং বৈধ। এভাবে আগ্রাসী শক্তি এসব সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কোনো রকম বলপ্রয়োগ ছাড়াই আক্রান্ত জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আক্রান্ত জাতির শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী শ্রেণি, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, এবং সাংবাদিক গোষ্ঠী আগ্রাসী শক্তির অঘোষিত অথচ নিবেদিতপ্রাণ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে।
সংস্কৃতি একটি মানবগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় নির্মাণ এবং সেই মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা তৈরি ও চালু রাখার জন্যে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। নিজস্ব সংস্কৃতির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি আমাদের বলে দেয় কোনটা আমাদের জন্যে গ্রহণযোগ্য, স্বাভাবিক এবং কাঙ্ক্ষিত। আমরা তখন সেভাবে সক্রিয় হই এবং ভূমিকা পালন করি।
গ্রামসির উপলব্ধি হচ্ছেÑ একটি নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা ও সচল করার জন্যে ওই সমাজে একটি নতুন বন্দোবস্তের পক্ষে সম্মতি ও চেতনা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক আধিপত্য সেই কাজটা করে দেয়। কোনো সমাজে অন্য কারো সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে সেই সমাজের অধিকাংশ মানুষ বা একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বা একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী এই আধিপত্যকে স্বাভাবিক, প্রত্যাশিত এবং অবধারিত বলে মেনে নিতে সম্মত হয়েছে, তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ‘সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান’ জন্ম নিয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। তবে প্রত্যেক সংস্কৃতিরই অন্তর্নিহিত কিছু শক্তি থাকে। ফলে কোনো সাংস্কৃতিক আধিপত্যই নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হতে পারে না, তাকে কিছু-না-কিছু আপস করতেই হয়। কোনো সংস্কৃতি অন্য একটি সংস্কৃতির আধিপত্যের শিকার হলে সে একদিকে যেমন নিজের অনন্য শক্তির উৎসগুলো খুঁজে বের করে, তেমনই আগ্রাসী সংস্কৃতির দুর্বল ফাঁকগুলোকেও শনাক্ত করে। এই দুই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে তার নিজস্বতাকে পুনরুদ্ধার করে, বা কোনো কোনো সময় একটি প্রতি-সংস্কৃতি নির্মাণ করে যা পুরোনো সংস্কৃতির সঙ্গে হুবহু নাও মিলতে পারে। এভাবে সে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তার নিজস্ব আধিপত্য পুনরাবিষ্কার, পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে। এক সংস্কৃতির সঙ্গে আরেক সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিনিময় বা লেনদেন এটা নয়, বরং এটা এমন একটা যুদ্ধ যেখানে অস্ত্র ব্যবহৃত হয় না, মানুষ মরে না, ধন-সম্পদ ধ্বংস হয় না, কিন্তু জয়-পরাজয় সংঘটিত হয়, যদিও অনেক সময় সবাই তা উপলব্ধি করতে পারে না।
বাংলা নববর্ষ উদযাপন, বিশেষত ছায়ানট এবং চারুকলার একদল শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সেটাকে যেভাবে উদযাপন করছেন তার মধ্যে গ্রামসি-কথিত এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই ব্যাপারটা আর গোপন থাকছে না। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কায়দায় অপর একটি সংস্কৃতিকে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তাদের মধ্যে ‘সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান’ এবং সম্মতি সৃষ্টির মাধ্যমে। এই আধিপত্যবাদী প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
বাংলাদেশ নামের এই সুনির্দিষ্ট সীমানার ভূখণ্ডটির সৃষ্টি হয়েছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি প্রদেশরূপে। ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয় এবং বাংলাদেশ নাম ধারণ করে। বাংলাদেশের ওপর ভারতের পূর্ণাঙ্গ আধিপত্য অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন শেখ মুজিব সরকারের উৎখাত এবং তারপর ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটে। নানা রকম উত্থান-পতন ঘটলেও এই ধারা ২০০৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরপর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে আবার ভারতের সর্বাত্মক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের পর ভারতের অনুধাবন হয় যে, পাকিস্তান আমলের স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী কালের আধিপত্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা আশানুরূপভাবে তৈরি হয়নি। তখন তারা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করে। বাঙালি সংস্কৃতির নামে হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিক আচার-অনুষ্ঠান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ভারতপন্থি রাজনৈতিক চেতনা চালুর নানান প্রকল্প নেওয়া হয়। বাংলা নববর্ষ উদযাপন এরকমই একটি সাংস্কৃতিক প্রকল্প। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতের হিন্দু ধর্মীয় পৌত্তলিকতাবাদী বিশ্বাস, চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ এবং অভ্যাস তৈরি ও চালু করা এই প্রকল্পের লক্ষ্য। একইসঙ্গে চলা ভারতীয় রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণে এই প্রকল্প এতটাই ব্যাপক ও গভীর হয় যে ২০১৭ সালে বশংবদ সরকার সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের নির্দেশ দেয়।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একথা প্রমাণ করেছে যে, অনেক চেষ্টা-সাধনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষকে বশংবদ বানানো যায়নি। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এমন কিছু অন্তর্নিহিত শক্তি ও চেতনা রয়েছে যে একইসঙ্গে রাজনৈতিক স্বৈরাচার এবং সাংস্কৃতিক আক্রমণ চালিয়েও তাকে দমন করা যায়নি। বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদের এই অন্তর্নিহিত শক্তি ও চেতনাকে আবিষ্কার এবং লালন করতে হবে, তার ভিত্তিতে নিজস্ব সংস্কৃতির নিজস্ব বয়ান তৈরি ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভারতের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মোকাবিলায় বাংলা নববর্ষকে উদযাপন করতে হবে নিজস্বতায় আকৃত ও মহিমান্বিত করে।
ঔপনিবেশিক এবং বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে আজকাল বাংলা দিন, মাস বা বছর তেমন একটা অনুসৃত হয় না। অথচ বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। নববর্ষ পালনের বিষয়-আশয় ও পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কও প্রচুর। তাছাড়া বাংলা নববর্ষকে যারা বাঙালিত্বের অপরিহার্য ও আবশ্যিক উৎসব বলে প্রচার করেন তারাও বছরের বাকি দিনগুলোতে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা দূরের কথা, এর কোনো খোঁজও রাখেন না। পরদিনই প্রত্যাবর্তন করেন পাশ্চাত্য জীবনযাপনে এবং সেটাকেই তারা প্রগতিশীলতা বলে মনে করেন। আমরা দেখি এই একটি দিনে যা-কিছু করা হয়Ñ পান্তা-ইলিশ খাওয়া, তাঁতের গেরুয়া শাড়ি-ফতুয়া-পাঞ্জাবি পরা, রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া, ইত্যাদিÑ বছরের বাকি তিনশ চৌষট্টিটি দিন তার কোনো খোঁজ থাকে না। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের বাংলা নববর্ষের সৃষ্টি, বিকাশ এবং উদযাপনের ইতিহাস জানতে হবে। সেই সঙ্গে ঔপনিবেশিকতা এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যকেও বুঝতে হবে।
বাংলা নববর্ষ বা বৈশাখী সংস্কৃতি মানে বাংলা বর্ষকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, যা এদেশের ঋতুবৈচিত্র্য, চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চারু ও কারুশিল্প, মেলা, নানা রকম খেলা এবং উৎসব-আমোদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দিনটির সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক যে একচেটিয়া বিষয়টি তা-ও নয়, কারণ এসব কর্মকাণ্ড কম-বেশি সারা বছর ধরেই চলে। তবে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি অর্থাৎ নববর্ষের শুরুটা উদযাপিত হয় ঢাকঢোল পিটিয়ে, বিপুল আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসাহের সঙ্গে।
বাংলা বর্ষের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে নানা মত রয়েছে, তবে এই মতটাই প্রধান এবং সর্বজনগ্রাহ্য যে তার উদ্ভব ঘটে মোগল বাদশাহ আকবরের শাসনামলে, তারই উদ্যোগে। ভারতবর্ষে সে সময় চান্দ্র বর্ষ অর্থাৎ হিজরি পঞ্জিকা অনুসৃত হতো। চান্দ্র বর্ষ সৌর বর্ষের চেয়ে ১১ দিন কম হওয়ার কারণে চান্দ্র বর্ষে ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। ফলে ঋতুনির্ভর চাষাবাদ এবং খাজনা আদায়ের মতো অনেক কাজ করতে অসুবিধা হতো। খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর চান্দ্র ও সৌর বর্ষের মধ্যে সমন্বয়ের উদ্যোগ নেন। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রচলিত সৌর ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম নির্ধারণ করেন।
বাংলা নববর্ষের নাগরিক উদযাপনে ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠান (মূলত রবীন্দ্রসংগীতানুষ্ঠান) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রধান এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ছায়ানটের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘স্বদেশে রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে’ ১৯৬১ সালে তার যাত্রা শুরু। রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৬৩ সালে ছায়ানট সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরের বছর রমনার বটমূলে সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানাদির বাইরে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে এটাই এ ধরনের প্রথম নাগরিক অনুষ্ঠান। তারপর থেকে এটা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। ছায়ানট রবীন্দ্র জন্মবার্ষিক (২৫ বৈশাখ) ও মৃত্যুবার্ষিকী (২২ শ্রাবণ), শারদোৎসব ও বসন্তোৎসবও খুব গুরুত্ব সহকারে পালন করে। রবীন্দ্রচর্চার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে অবদান রাখার জন্য ভারত সরকার ২০১৫ সালে ছায়ানটকে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ প্রদান করে। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালকরা ভারতপন্থি বামপন্থি রাজনৈতিক ঘরানার মানুষ, মূলত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এরা জীবনদর্শনের দিক থেকে নাস্তিকতাবাদী এবং ধর্ম-কর্মের বিরোধী। অথচ একজন পুরোদস্তুর আস্তিক, এমনকি একটি নতুন ধর্মের (ব্রাহ্ম) প্রবর্তকদের অন্যতম রবীন্দ্রনাথের চর্চা এবং তার জীবনদর্শন প্রচারকে এরা কেবল লক্ষ্য হিসেবেই গ্রহণ করেনি, রবীন্দ্রচর্চাকে ধর্মচর্চার পর্যায়ে উন্নীত করেছে। কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক এবং ছায়ানটের মূল কর্ণধার সন্জীদা খাতুনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান এরা রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনাসংগীত দিয়ে সম্পন্ন করেছে। অর্থাৎ ধর্ম না মানলেও এরা একজন ধার্মিক মানুষের কবিতা ও গানচর্চাকে ধর্মচর্চার মতো পবিত্র ও অবশ্যপালনীয় জ্ঞান করছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলা নববর্ষ উদযাপনে সর্বশেষ সংযোজন। ১৯৮৫ সালে যশোরে কয়েকজন চারুশিল্পী পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে একটি পদযাত্রার আয়োজন করেন। বলা হয় এটি ছিল ‘তৎকালীন স্বৈরশাসন ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের প্রতীক।’ অর্থাৎ নববর্ষ উদযাপনের এই আয়োজনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল ছিল। যশোরের এই আয়োজকরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের কিছু ছাত্র-শিক্ষককে উদ্বুদ্ধ করে ১৯৮৯ সালে একই ধরনের পদযাত্রার আয়োজন করে। তার নাম দেওয়া হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এর মূল পৃষ্ঠপোষকরাও মূলত বামপন্থি। সাংগঠনিকভাবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট- উদীচী এক্ষেত্রে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করে থাকে। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকদের অন্যতম ওয়াহিদুল হক এবং ইমদাদ হোসেন ১৯৯৬ সালে এর নামকরণ করেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এই পদযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে রমনার বটমূলে ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠানে গিয়ে মিলিত হয়।
ছায়ানটের বর্ষবরণ সংগীতানুষ্ঠান এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজক, পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থকরা সবাই ভারতপন্থি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারকবাহক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও নাস্তিকতাবাদী মানুষ, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নামে বিশেষ ভারতপন্থি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের পৃষ্ঠপোষকতা করা। বিষয়টি বোঝার জন্যে উপনিবেশবাদ এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।
একটি দেশ বা জাতি যখন আরেকটি দেশ বা জাতিকে প্রত্যক্ষভাবে দখলে নিয়ে তার ওপর শোষণ-শাসন চালায় তখন সেটাকে আমরা উপনিবেশ এবং এই তত্ত্বকে উপনিবেশবাদ বলি। উপনিবেশবাদের প্রধান লক্ষ্য ‘বশংবদ’ তৈরি করা। ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশিতের ওপর কেবল বস্তুগত শোষণই চালায় না, তার মনের ওপরেও এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, সে নিজেকে অধমর্ণ বলে মনে করে। সে মনে করে সে ছোট, তার যা-কিছু রয়েছে তার সবকিছুই সেকেলে, উৎকর্ষে ঔপনিবেশিকের চেয়ে গৌণ, সে কারণে তার উচিত কেবল ঔপনিবেশককে অনুকরণ ও অনুসরণ করে যাওয়া।
এডওয়ার্ড সাঈদ দেখিয়েছেন, উপনিবেশবাদ হচ্ছে এমন একটা বিশিষ্ট চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি যার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক উপনিবেশিতের ওপর তার প্রাধান্য বিস্তার করে, তাকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী বিনির্মাণ করে এবং তার ওপর কর্তৃত্ব করে। এভাবে মানব প্রজাতিকে সে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেÑ একদিকে থাকে ‘আমরা’, অর্থাৎ ঔপনিবেশিকরা; অন্যদিকে থাকে ‘অন্যরা’ অর্থাৎ উপনিবেশিতরা। ঔপনিবেশিক কখনো কখনো উপনিবেশিতকে চিন্তা-চেতনা এবং বাস্তব আচার-ব্যবহারে এতটাই অধমর্ণ করে তোলে যে সে এমনকি শোষণকে চেনার ও বোঝার জ্ঞান ও সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে এবং তার প্রতিবাদ করার কৌশল ও ভাষা খুঁজে পায় না।
সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে উপনিবেশবাদের একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক আধিপত্য বলতে বোঝায় একটি দেশ বা জাতি কর্তৃক আদর্শিকভাবে অন্য একটি দেশ বা জাতির ওপর প্রাধান্য বিস্তার ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইতালির চিন্তাবিদ-দার্শনিক আন্তোনিয়ো গ্রামসি এই তত্ত্বের উদ্গাতা। এক্ষেত্রে দেশ বা ভূখণ্ডকে রাজনৈতিক বা সামরিকভাবে দখল করা হয় না। এটাকে পরোক্ষ উপনিবেশ বলা যায়। এটা করা হয় সামাজিক সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে, যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে এমন একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবিচারপদ্ধতি এবং বয়ান তৈরি করা হয় যা ওই দেশ বা জাতির মূল্যবোধ, রসম-রেওয়াজ, চিন্তাধারা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনদর্শন ও আচরণকে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রণ করে। আক্রান্ত জাতি নিজেকে বিস্মৃত হয় এবং আগ্রাসী জাতিকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে। তখন সে আগ্রাসী জাতির জীবনদর্শন ও সংস্কৃতিকে নিজের জীবনদর্শন ও সংস্কৃতি বলে মেনে নেয়। তারা বুঝতেই পারে না যে তাদের ওপর এটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। বরং তারা ভাবতে থাকে যে এটাই স্বাভাবিক, অবধারিত, এবং বৈধ। এভাবে আগ্রাসী শক্তি এসব সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কোনো রকম বলপ্রয়োগ ছাড়াই আক্রান্ত জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আক্রান্ত জাতির শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী শ্রেণি, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, এবং সাংবাদিক গোষ্ঠী আগ্রাসী শক্তির অঘোষিত অথচ নিবেদিতপ্রাণ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে।
সংস্কৃতি একটি মানবগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় নির্মাণ এবং সেই মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা তৈরি ও চালু রাখার জন্যে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। নিজস্ব সংস্কৃতির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি আমাদের বলে দেয় কোনটা আমাদের জন্যে গ্রহণযোগ্য, স্বাভাবিক এবং কাঙ্ক্ষিত। আমরা তখন সেভাবে সক্রিয় হই এবং ভূমিকা পালন করি।
গ্রামসির উপলব্ধি হচ্ছেÑ একটি নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা ও সচল করার জন্যে ওই সমাজে একটি নতুন বন্দোবস্তের পক্ষে সম্মতি ও চেতনা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক আধিপত্য সেই কাজটা করে দেয়। কোনো সমাজে অন্য কারো সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে সেই সমাজের অধিকাংশ মানুষ বা একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বা একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী এই আধিপত্যকে স্বাভাবিক, প্রত্যাশিত এবং অবধারিত বলে মেনে নিতে সম্মত হয়েছে, তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ‘সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান’ জন্ম নিয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। তবে প্রত্যেক সংস্কৃতিরই অন্তর্নিহিত কিছু শক্তি থাকে। ফলে কোনো সাংস্কৃতিক আধিপত্যই নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হতে পারে না, তাকে কিছু-না-কিছু আপস করতেই হয়। কোনো সংস্কৃতি অন্য একটি সংস্কৃতির আধিপত্যের শিকার হলে সে একদিকে যেমন নিজের অনন্য শক্তির উৎসগুলো খুঁজে বের করে, তেমনই আগ্রাসী সংস্কৃতির দুর্বল ফাঁকগুলোকেও শনাক্ত করে। এই দুই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে তার নিজস্বতাকে পুনরুদ্ধার করে, বা কোনো কোনো সময় একটি প্রতি-সংস্কৃতি নির্মাণ করে যা পুরোনো সংস্কৃতির সঙ্গে হুবহু নাও মিলতে পারে। এভাবে সে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তার নিজস্ব আধিপত্য পুনরাবিষ্কার, পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে। এক সংস্কৃতির সঙ্গে আরেক সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিনিময় বা লেনদেন এটা নয়, বরং এটা এমন একটা যুদ্ধ যেখানে অস্ত্র ব্যবহৃত হয় না, মানুষ মরে না, ধন-সম্পদ ধ্বংস হয় না, কিন্তু জয়-পরাজয় সংঘটিত হয়, যদিও অনেক সময় সবাই তা উপলব্ধি করতে পারে না।
বাংলা নববর্ষ উদযাপন, বিশেষত ছায়ানট এবং চারুকলার একদল শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সেটাকে যেভাবে উদযাপন করছেন তার মধ্যে গ্রামসি-কথিত এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই ব্যাপারটা আর গোপন থাকছে না। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কায়দায় অপর একটি সংস্কৃতিকে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তাদের মধ্যে ‘সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান’ এবং সম্মতি সৃষ্টির মাধ্যমে। এই আধিপত্যবাদী প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
বাংলাদেশ নামের এই সুনির্দিষ্ট সীমানার ভূখণ্ডটির সৃষ্টি হয়েছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি প্রদেশরূপে। ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয় এবং বাংলাদেশ নাম ধারণ করে। বাংলাদেশের ওপর ভারতের পূর্ণাঙ্গ আধিপত্য অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন শেখ মুজিব সরকারের উৎখাত এবং তারপর ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটে। নানা রকম উত্থান-পতন ঘটলেও এই ধারা ২০০৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরপর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে আবার ভারতের সর্বাত্মক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের পর ভারতের অনুধাবন হয় যে, পাকিস্তান আমলের স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী কালের আধিপত্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা আশানুরূপভাবে তৈরি হয়নি। তখন তারা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করে। বাঙালি সংস্কৃতির নামে হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিক আচার-অনুষ্ঠান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ভারতপন্থি রাজনৈতিক চেতনা চালুর নানান প্রকল্প নেওয়া হয়। বাংলা নববর্ষ উদযাপন এরকমই একটি সাংস্কৃতিক প্রকল্প। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতের হিন্দু ধর্মীয় পৌত্তলিকতাবাদী বিশ্বাস, চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ এবং অভ্যাস তৈরি ও চালু করা এই প্রকল্পের লক্ষ্য। একইসঙ্গে চলা ভারতীয় রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণে এই প্রকল্প এতটাই ব্যাপক ও গভীর হয় যে ২০১৭ সালে বশংবদ সরকার সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের নির্দেশ দেয়।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একথা প্রমাণ করেছে যে, অনেক চেষ্টা-সাধনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষকে বশংবদ বানানো যায়নি। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এমন কিছু অন্তর্নিহিত শক্তি ও চেতনা রয়েছে যে একইসঙ্গে রাজনৈতিক স্বৈরাচার এবং সাংস্কৃতিক আক্রমণ চালিয়েও তাকে দমন করা যায়নি। বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদের এই অন্তর্নিহিত শক্তি ও চেতনাকে আবিষ্কার এবং লালন করতে হবে, তার ভিত্তিতে নিজস্ব সংস্কৃতির নিজস্ব বয়ান তৈরি ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভারতের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মোকাবিলায় বাংলা নববর্ষকে উদযাপন করতে হবে নিজস্বতায় আকৃত ও মহিমান্বিত করে।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১২ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে