সহিংস ছাত্রসমাজ এবং মানসিক অস্থিরতা

ফাতিমা তামান্না
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ৪৮

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত দুটি ঘটনা আমাদের তরুণ সমাজের মনস্তত্ত্ব, নৈতিক অবক্ষয় ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের গভীর বাস্তবতা তুলে ধরেছে। একটি হলো—পারভেজ হত্যাকাণ্ড, যেখানে একজন ছাত্রকে অন্য একজন ছাত্র শুধু ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে নির্মমভাবে হত্যা করে। আর অন্যটি—ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ; যার মূলে রয়েছে ঠুনকো ইস্যু ঘিরে সহিংস আচরণ। এই দুটি পৃথক ঘটনা হলেও, উভয়ের ভেতর একটি সাধারণ যোগসূত্র রয়েছে, তা হচ্ছে; সহিংসতা এবং মানসিক অস্থিরতা।

বিজ্ঞাপন

পারভেজ হত্যার পেছনের কারণ জানা গেল-‘একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসা’। শুধু হাসার অপরাধে জীবন দিতে হয়েছে তাকে। এই তুচ্ছ ইস্যুকে কেন্দ্র করে হত্যাকারী সহপাঠী হিংস্র প্রতিশোধের পথ বেছে নেয়। বিষয়টি শুধু একটি অপরাধ নয়, বরং একটি ভয়ানক সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ। এ ঘটনা সমাজকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে—তরুণদের মধ্যে সহনশীলতা, নৈতিকতা ও রাগ নিয়ন্ত্রণ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? এবং কেন এমন প্রতিক্রিয়া?

অন্যদিকে ২১ এপ্রিলের একটি মারধরের ঘটনায় প্রতিশোধ নিতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সিটি কলেজে দলবেঁধে হামলা চালায়। এই সহিংসতা নতুন নয়। প্রতিবছরই কোনো না কোনো ঘটনায় ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে একই ধরনের সংঘর্ষ হচ্ছে। যার পেছনে থাকে তুচ্ছ ঘটনাÑ ‘কাকে কে দেখে ফেলল’, ‘কে কার গার্লফ্রেন্ডের পাশে বসল’, ‘কে কী বলল’। এ ধরনের আরো অনেক ইস্যু।

কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক এলাকায় হওয়াও সমস্যাকে বেগবান করেছে। ঢাকা সিটি কলেজে ১২ হাজার শিক্ষার্থী। ঢাকা কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। আইডিয়াল কলেজে পাঁচ-সাত হাজার শিক্ষার্থী। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীদের পদচারণে খুব কাছাকাছি জায়গায়। তাদের গল্প-গুজবের স্পষ্টও একই এলাকায়। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফেসবুক গ্রুপ আছে, সেখানে তারা একে অন্যকে কটাক্ষ করে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাঝেমধ্যে মারামারিতে রূপ নেয়। প্রায়ই সাধারণ ঘটনা বড় আকার ধারণ করে। এটা একেবারে অনিয়ন্ত্রিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সহিংস ছাত্রসমাজের এ অবস্থা নৈতিক ও মানসিক পতনের দিকে দিন দিন অগ্রসর হচ্ছে। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে প্রশ্ন তোলে, তা হচ্ছে, পারভেজ হত্যার মতো নির্মম ঘটনার পরও কেন ছাত্রদের টনক নড়ছে না? সমাজ কি একদমই অচল হয়ে গেছে, নাকি তরুণ প্রজন্ম মানসিক ও নৈতিকভাবে বিপর্যস্ত? রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন শহরে অনেক দিন ধরে আতঙ্ক হিসেবে বিরাজ করছে কিশোর গ্যাং সমস্যা। প্রায়ই বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় কিশোর-তরুণদের একে অন্যের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, মারামারি, ছোটাছুটির ঘটনা দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বছরের পর বছর ধরেই এই সংঘর্ষগুলো ঠেকাতে ব্যর্থ। এটি শুধু ব্যর্থতা নয়, বরং নাগরিক নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা।

অন্যদিকে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারণে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও মানসিক চাপের শিকার। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক NIMH (2019)-এর গবেষণায় পাওয়া যায়, ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ স্কুল-কলেজশিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভোগে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এক জরিপ বলছে, ৩৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও মানসিক চাপের শিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশে নেই কাউন্সেলিং সেবা বা সচেতনতামূলক কার্যক্রম। এ সমস্যা সমাধানে কিছু সুচিন্তিত সমাধান থাকা দরকার। পাশাপাশি অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। অন্যের প্রতি সহনশীল হওয়া, সোশ্যাল ইমোশনাল লার্নি, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার উদ্যোগ নিতে হবে সব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন থেকে। সচেতন হতে হবে আমাদের অভিভাবকদের। সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের উন্নত নৈতিক চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সবার আগে প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।

পারভেজ হত্যাকাণ্ড এবং ঢাকা কলেজের সংঘর্ষ—দুটি ঘটনাই আলাদা, কিন্তু উভয়ই সমাজে একই ধরনের গভীর সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। মানসিক চাপ, রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, নৈতিকতার অভাব ও বিচারহীনতা এই সহিংসতাকে পুষ্টি দিচ্ছে। এখনই সময়, রাষ্ট্র, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একযোগে এই সংকটের গভীরে গিয়ে সমাধান খুঁজে বের করা এবং সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া। তা না হলে পুরো সমাজই সহিংসতার ভারে একদিন ভেঙে পড়বে।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত