দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন ‘সামাজিক আবাসন’

ওয়াহিদ সাদিক শুভ
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১১: ০১
ছবি: সংগৃহীত

দ্রুত বর্ধনশীল নগরায়ণ এবং অত্যধিক জনঘনত্বের কারণে বাংলাদেশে আবাসন সংকট তীব্র হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর, আয়বৈষম্য প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে আবাসন সংকট বাড়ছে দিন দিন। ফলে জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গৃহহীন অথবা অস্বাস্থ্যকর ও বসবাস-অযোগ্য পরিবেশে থাকছে। প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ লোক গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। তাদের অধিকাংশই ঢাকায় এবং ক্ষুদ্র অংশ চট্টগ্রাম শহরে যায়। ২০৫০ সাল নাগাদ শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। ফলে এখন থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হলে শহরাঞ্চলে আবাসন সংকট আরো তীব্র হবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে বছরে আবাসন বৃদ্ধির গড় হার তিন থেকে পাঁচ শতাংশ। আবাসন কোম্পানিগুলো উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট নির্মাণ করলেও নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই। জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা অনুযায়ী দেশে প্রায় ৪৫ লাখ বাড়ির সংকট আছে। নগরাঞ্চলে সংকট এতটাই তীব্র যে, ৬৫ লাখ মানুষ বস্তি অথবা বস্তিসদৃশ ঘরে বসবাস করে। নগরের অধিবাসীদের শতকরা ৭০ ভাগেরই থাকার নিজস্ব বা স্থায়ী জায়গা নেই। জমির উচ্চমূল্য ও নির্মাণব্যয় বৃদ্ধির কারণে এবং প্রয়োজনীয় অর্থায়নের অভাবে এ খাতে চাহিদা এবং জোগানের ফারাক দিন দিন বাড়ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ। তাদের মধ্যে ছয় লাখ থাকে ঢাকায়। গৃহহীনরা সাধারণত বড় রাস্তা, নদীর বাঁধ ও রেললাইনসংলগ্ন সরকারি জমিতে অস্থায়ী ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গৃহহীনদের মধ্যে ১৫ লাখ পথশিশু, যারা নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর দেশে গড়ে সাত লাখ লোক বাস্তুহারা হন এবং তাদের অধিকাংশই শহরে এসে কোনো বস্তিতে আশ্রয় নেন।

কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নাগরিকদের মানসম্মত আবাসনের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এছাড়া জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ২৫ দশমিক ১ অনুযায়ী, উপযুক্ত আবাসন মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত অন্য কয়েকটি চুক্তিতেও নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের অধিকারকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না। যদিও আশ্রয়ণ প্রকল্প, উদ্বাস্তুদের মাঝে খাস জমি বরাদ্দ, বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পসহ সরকারের কিছু কর্মসূচি আছে। বেসরকারি খাতে কিছু এনজিও সীমিত আকারে স্বল্প ব্যয়ের বাসস্থান, স্বল্প সুদে গৃহহীনদের সহায়তা প্রদান প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু মূল সমস্যা সমাধানে এসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে ইউরোপের সোশ্যাল হাউজিং অথবা উত্তর আমেরিকার পাবলিক হাউজিংয়ের আদলে উদ্যোগ নিয়ে এ সমস্যার কার্যকর সমাধান করা সম্ভব।

সোশ্যাল হাউজিং বা সামাজিক আবাসন হচ্ছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গড় আয়ের একটি অংশ, যেমন ২৫-৩০ শতাংশ ভাড়া নির্ধারণ করে। হতদরিদ্র যাদের ন্যূনতম ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের ক্ষেত্রে এনজিওর মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য থাকে জনকল্যাণ।

মূলত শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী যুগে ইউরোপে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামাজিক আবাসনের বিস্তার ঘটে। কারখানা শ্রমিকদের আবাসনের উদ্যোগ থেকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে সামাজিক আবাসনের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময়ে সোশ্যাল হাউজিংয়ের আদলে যুক্তরাষ্ট্রেও পাবলিক হাউজিং শুরু হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক আবাসন কর্মসূচির মাধ্যমে বাসস্থানের সংকট সমাধান করা হয়েছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সিঙ্গাপুর। সেদেশে হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ১৯৬০ সাল থেকে সব শ্রেণির নাগরিকের জন্য উচ্চমানসম্পন্ন কিন্তু সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিত করেছে। সিঙ্গাপুরের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ এই বোর্ড প্রদত্ত ফ্ল্যাটে বসবাস করে।

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার মিউনিসিপ্যাল হাউজিং সামাজিক আবাসনের আরেকটি সফলতার উদাহরণ। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভিয়েনায় সামাজিক আবাসনের সূচনা হয়। শহরাঞ্চলের প্রায় ৬০ শতাংশ লোক এ-জাতীয় বাসস্থানে বসবাস করে। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী ছাড়াও বিভিন্ন আয় ও পেশার মানুষ এখানে বসবাস করে। বাসাভাড়া সাশ্রয়ী রাখার জন্য সরকার কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে।

নেদারল্যান্ডসের সোশ্যাল হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সামাজিক আবাসনের কর্মসূচি চালু করে। নেদারল্যান্ডসের ৩০ শতাংশ আবাসন এ সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। শুধু নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির জনগণ এ আবাসন সুবিধা ভোগ করে। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার নগরাঞ্চলে আবাসন সংকট সমাধানে ১৯৮৯ সাল থেকে পার্মানেন্ট রেন্টাল হাউজিং প্রোগ্রাম চালু করে। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী, বয়স্ক ও সিঙ্গেল-প্যারেন্ট পরিবারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নিম্ন হারের ভাড়ার মাধ্যমে আবাসন নিশ্চিত করা হয়। ভর্তুকি ও অর্থায়নের মাধ্যমে ভাড়াগ্রহীতাদের পরে মালিকানার সুযোগ প্রদান করা হয়।

চীন সরকার ১৯৯০ সাল থেকে পাবলিক হাউজিং প্রজেক্টের মাধ্যমে আবাসন সমস্যা লাঘব করার চেষ্টা করছে। চীনে দরিদ্র আয়ের পরিবারের জন্য সাশ্রয়ী ভাড়া নির্ধারণ এবং মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। ভর্তুকির মাধ্যমে ভাড়া নিয়ন্ত্রণ এবং অংশীদারত্বের ভিত্তিতে মালিকানা পদ্ধতিতে আবাসনকে সাশ্রয়ী করা হয়। ফিনল্যান্ড হাউজিং ফার্স্ট কর্মসূচির মাধ্যমে ২০০৮ সাল থেকে গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থা করছে।

দ্রুত নগরায়ণ, তীব্র জনঘনত্ব ও আয়বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশে আবাসন সংকট তীব্র হয়েছে। এ সমস্যা নিরসনে সামাজিক আবাসন হতে পারে একটি সম্ভাব্য সমাধান। বিশেষত নিম্ন আয়ের ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর গৃহসংস্থানের একটি টেকসই সমাধান, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক আবাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সুপরিকল্পিত আবাসন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে নগরের বস্তিগুলোর পরিবর্তে টেকসই ও উন্নতমানের আবাসন সরবরাহের মাধ্যমে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগণের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করা সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, পরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল ও নগরগুলোর উপকণ্ঠে অবস্থিত কৃষিজমি ও বনাঞ্চল এবং নিম্নভূমি ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ বন্ধ করা যাবে। এতে ফসলি জমি রক্ষা পাবে, জলাভূমি ভরাট বন্ধ হবে এবং বনভূমি রক্ষা পাবে।

তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর আবাসনের ব্যবস্থা হলে নগরগুলোয় জনসংখ্যার চাপ হ্রাস পাবে।

চতুর্থত, বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকায় সামাজিক আবাসন খাতে বিনিয়োগের এখনই প্রকৃষ্ট সময়। বেসরকারি উন্নয়ন অংশীদারদের সহযোগিতায় সরকার এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে নিম্নবিত্তদের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারে। এর মাধ্যমে নির্মাণ ও রিয়েল এস্টেট খাতে উদ্দীপনা তৈরি হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।

পঞ্চমত, জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা সরকারের একটি গুরুদায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হবে। ষষ্ঠত, আবাসন খাতে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবাহও বৃদ্ধি পাবে। এ খাতে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক খাতে সৃজনশীল নতুন নতুন সেবা সংযোজিত হবে। সপ্তমত, টেকসই, দুর্যোগ-সহনশীল ও জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে স্থাপত্য ও প্রকৌশল খাতের নতুন ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটবে।

বাংলাদেশে সামাজিক আবাসনের অপার সম্ভাবনা থাকলেও এক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। প্রথমত, বাংলাদেশে ভূমির অপ্রতুলতা ও উচ্চমূল্য। অব্যবহৃত সরকারি জমি, খাসজমি ও পতিত জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় এ খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগপ্রাপ্তি সহজ নাও হতে পারে। সেজন্য বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি অংশীদারদের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে।

তৃতীয়ত, গৃহায়ন নীতি করা হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও সমন্বয়ের অভাবের কারণে তা কার্যকর নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে নিবিড় তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গৃহায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। চতুর্থত, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ দেশ হওয়ায় এ-জাতীয় প্রকল্পের নকশা ও নির্মাণে সতর্ক হতে হবে। স্থানীয় জলবায়ু ও দুর্যোগের প্রকৃতি অনুযায়ী নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। পঞ্চমত, সঠিকভাবে স্থান নির্বাচন না করা হলে বা শুধু বড় শহরগুলোয় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শহরাঞ্চলে অভিবাসন বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে এ-জাতীয় প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

সামাজিক আবাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সুনির্দিষ্ট কৌশল নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের ওপর আর্থিক চাপ কমানো যেতে পারে। প্রয়োজনে বেসরকারি অংশীদারকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গৃহহীন, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে স্বল্প জায়গায় অধিক লোকের পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল আবাসন নির্মাণের লক্ষ্যে নকশা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি স্বচ্ছ ও বাস্তবায়নযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : নির্বাহী প্রকৌশলী, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত