পুলিশ বিভাগে সংস্কারের প্রস্তাব

আবদুল লতিফ মাসুম
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ১৩
আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ১৪

ক্ষমতা যতই কেন্দ্রীভূত হয় ততই একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেজন্য সমাজতত্ত্বে ক্ষমতা বিভাজনের কথা বলা হয়। এতে করে শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। সমাজ ও রাষ্ট্রে একাধিপত্ব, একনায়কত্ব অথবা স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার পথে এই ব্যবস্থা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। মনীষী জন লক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণের কথা বলেন।

পরে মন্টেস্কু সর্বতোভাবে এই ত্রি-শক্তির ত্রিবিধ কার্যাবলির আলোকে সার্বিক বিভাজনের কথা বলেন। এর ক্রমধারায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রণীত সংবিধানে ক্ষমতার ভারসাম্যের (Balance of power) কথা বলা হয়। নীতিশাস্ত্রে আরেকটি কথা প্রচলিত, Absolute power corrupts Absolutely. -সার্বিক ক্ষমতা সার্বিকভাবেই দুর্নীতিতে নিপতিত হয়। আর বাংলাদেশে এর নমুনা গত দেড় দশকে আপনারা দেখেছেন।

বিজ্ঞাপন

অবশ্য আজকের আলোচ্য বিষয়ের নিরিখে উপরিউক্ত অবতরণিকা একটু ভারিক্কিই হয়ে গেল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধের মামলা তদন্তের জন্য আলাদা সংস্থা গঠন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন একটি প্রস্তাব পেশ করেছে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা যে পৃথক্‌করণের কথা বলি, এটা এরই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ।

বিশেষ করে পুলিশি দাপটে যখন দেশের মানুষজন বিক্ষুব্ধ, তখন এ ধরনের প্রস্তাব পুলিশের ক্ষমতাকে ক্ষাণিকটা সহনীয় করবে। আজকের বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রে সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হচ্ছে, তাতে পুলিশ ব্যবস্থায় কোনো সংস্কার সাধিত না হলে একটি অসম্ভব রকমের অপূর্ণতা থেকে যাবে।

গঠিত পুলিশ কমিশনকে ধন্যবাদ দিতে হয় যে, তারা এমন একটি ভিন্নধর্মী প্রস্তাব পেশ করেছে। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত সংস্থাটি হবে দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য, যাতে করে তারা পুলিশ ও প্রভাবশালীদের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে তারা বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছে। এই প্রস্তাবটিও মূল্যায়নের অপেক্ষা রাখে।

আমরা জানি, বর্তমানে ফৌজদারি অপরাধের যাবতীয় তদন্ত করে পুলিশ। পুলিশই মামলা নেয় আবার পুলিশই সত্য-অসত্য নির্ণয় করে। সুতরাং সংশয় থেকেই যায়। থানা পুলিশের পাশাপাশি অপরাধ তদন্তে পুলিশের আরও দুটো প্রতিষ্ঠান রয়েছে- ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সিআইডির ইতিহাস ব্রিটিশ আমল থেকে। আর পিবিআই গঠিত হয়েছে এই সেদিন ২০১২ সালে।

পুলিশের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান আস্থার সংকটের কারণে এই দুটো প্রতিষ্ঠানই অভিযুক্ত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠান দুটো পুলিশ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। দুটো সংস্থার লোকজনই পুলিশ বাহিনী থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত। সাধারণত পুলিশ পুলিশের বিরুদ্ধে যায় না। সে কারণে অনেক সময় আশাতীত ফল লাভ হয় না।

এবার বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন যেভাবে তদন্তের জন্য ভিন্ন সংস্থার কথা বলেছে, তার কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ক. সংস্থাটির জনবল পুলিশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। খ. তাদের নিয়োগ, চাকরির শর্ত ও বাজেট ভিন্নতর হবে। গ. অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি একটি স্বতন্ত্র সংগঠন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে। ঘ. সাধারণভাবে প্রস্তাবিত সংস্থা কাজ শুরু করবে মামলা দায়েরের পর এবং ঙ. এই সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি বা প্রসিকিউটরের তদারকিতে কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের তরফ থেকে এটি একটি প্রাথমিক প্রস্তাবনা। প্রাথমিক প্রস্তাবনায় সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম, ফৌজদারি ব্যবস্থার যথাযথ ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য এই স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা এবং স্বল্প ব্যয়ে ও স্বল্প সময়ে কার্যকর বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এই পৃথক সংস্থা ভূমিকা রাখবে।

কমিশন এসব প্রস্তাবনার পাশাপাশি বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, পর্যাপ্ত বাজেট নিশ্চিত করা-সহ বেশ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছে। এখনও কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি। উল্লেখ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ পেতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছিল।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তার একটি। অন্যান্য কমিশনের তুলনায় এই কমিশনের কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে জানা যায়। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে এই কমিশন গঠন করা হয়। সকল কমিশনের মতো ৯০ দিনের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা। তবে সময়সীমা এরই মধ্যে ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কমিশন এর আগে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক ধাপ। তদন্ত কর্মকর্তাকে সাধারণত ইনভেস্টিগেশন অফিসার বা আইও বলা হয়। যেকোনো মামলার প্রতিবেদন প্রদানে আইও’র ভূমিকাই মুখ্য। আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়মে পক্ষ ও বিপক্ষ এই আইও’র সঙ্গে যোগাযোগ করে।

মামলাটি যতই জটিল ও কুটিল হয়, ততই ঘুষের পরিমাণ বেড়ে যায়। আইও’র হাতে মার্ডার কেসও ডিসমিস হয়ে যায়। সত্য ঘটনাকেও তারা নানারকম কারসাজি ও অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে। এভাবেই টাকার জোরে বড়লোকেরা বড় বড় অপরাধ থেকে নিষ্কৃতি পায়। আর ছোট ছোট চুনোপুঁটিরা কঠিন সাজা পায়। এসব কর্মকর্তা যদি সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হয়, তাহলে তদন্ত প্রতিবেদন অন্যরকম হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে যথাযথ তথ্য উল্লেখ করা হয় না। দ্রুত ও মানসম্পন্ন তদন্তের জন্য প্রস্তাবিত পৃথক সংস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

তবে পৃথক সংস্থা প্রস্তাবের বিপরীতেও বক্তব্য আছে। সাধারণভাবেই বোঝা যায়, সিআইডি ও পিবিআই’র মতো সংস্থা থাকা সত্ত্বেও আরেকটি সংস্থা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। একটি অভিমত এ রকম- সংস্থাটি যদি জনশক্তি, নৈতিকতা ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাধীন থাকে, তাহলে পরে কিছু সুফল জুটতেও পারে।

অন্য আরেকটি মত এ রকম- যত দিন পর্যন্ত পুলিশ বা এ রকম সংস্থা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হবে, তত দিন পর্যন্ত সুফল প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। সংস্কার কমিশন মনে করে, স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব ও প্রভাবমুক্ত সংস্থা গঠিত হলে জনগণ ন্যায়বিচার পাবে।

আমাদের দেশটি সম্ভবত মামলাবাজিতে পৃথিবীতে ফার্স্ট হবে। আমরা যেমন দুর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, সেরূপ ইন্ডিকেটর থাকলে অবশ্যই বাংলাদেশ মামলায় চ্যাম্পিয়ন হবে বারবার। বিগত ১৭ বছরে মামলা কত প্রকার ও কী কী, তা এক/এগারোর সরকার এবং বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার প্রমাণ করে গেছে। যে দেশে শুধু ৫০ লাখ মানুষ মামলার আসামি ছিল, সেদেশে বিপ্লব-বিদ্রোহ হওয়াই সংগত ছিল। যাহোক এদেশে যে মামলা হয়, তার অধিকাংশই রাজনৈতিক। ব্যক্তিগতভাবে যে মামলাগুলো হয় তার অধিকাংশই বোগাস।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মামলায় অভিযুক্তদের দোষী প্রমাণিত হওয়ার হার কম-বেশি ২০ শতাংশ; ৮০ শতাংশই খালাস পেয়ে যায়। এর মূল কারণ তদন্তের ঘাটতি আর এই তদন্তঘাটতির বিষয়কে যদি যথাযথভাবে মোকাবিলা করা যায়, তাহলে বোগাস মামলা বা মিথ্যা মামলার সংখ্যা কমে আসবে।

থানা পুলিশের প্রতিটি ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলার বিধানে ব্যস্ত থাকে। তারা প্রতিটি মামলায় যথেষ্ট সময় ও মনোযোগ দিতে সক্ষম হয় না। আর চিরাচরিত ঘুষের অভ্যাস তো আছেই। কয়েক বছর ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) যেসব গবেষণা পরিচালনা করেছে, সেখানে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারীদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা তথা পুলিশ অন্যতম।

পৃথক সংস্থা গঠন প্রশ্নে যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে সংস্কার কমিশন বলেছে, বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মিথ্যা মামলা হলো একটি বড় সমস্যা। ভিলেজ পলিটিক্স বা ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে এদেশে অসংখ্য মিথ্যা মামলা হয়। এমনকি নিজের সন্তানকে হত্যা করে শত্রুর নামে মামলা দেওয়ার নৃশংস উদাহরণও এদেশে রয়েছে।

‘মারি ওরি পারি যে কৌশল’ নীতির কারণে মিথ্যা সত্য হয়ে যায়, আর সত্য মিথ্যা হয়ে যায়। সুতরাং একটি পৃথক সংস্থা যদি হয়, পুলিশের জন্য তা একটি চেকপোস্টের কাজ করবে। এ ধরনের সংস্থা বর্তমান পুলিশ বাহিনী পছন্দ করবে না। সেক্ষেত্রে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের বিষয়ও আছে। কমিশন যখন চূড়ান্ত সুপারিশ দাখিল করবে, তখন তাদের বিষয়টি মনে রাখতে হবে।

আবারও সেই কেতাবি ভারসাম্য বা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের কথায় আসি। ক্ষমতার যেকোনো বিকেন্দ্রীকরণ বা বিভাজন ব্যক্তি ও পদ্ধতিগত স্বেচ্ছাচারকে প্রতিহত করে। ব্যবস্থাটি যদি ন্যায়ানুগ, ভারসাম্যপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে ফৌজদারি মামলার পৃথক্‌করণের মতো সামান্য ব্যবস্থা সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থায় অসামান্য প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অতএব তদন্তের জন্য পুলিশের বাইরে পৃথক সংস্থা গঠনের বিষয়টি একটি উত্তম প্রস্তাব।

এমবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত