বৈষম্যহীন জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠার উপায়

আমানুল্লাহ আল মাহমুদ
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ০২
আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ৫৮

জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে এবং জনগণের সামগ্রিক কল্যাণের কথা বিবেচনা করে এখন সময় এসেছে জনপ্রশাসনকে প্রশাসন ক্যাডারের সিন্ডিকেটমুক্ত করা। একই সঙ্গে অবহেলিত বাকি সব ক্যাডারের সম-অংশীদারত্বকে আমলে নিয়ে স্বাধীন দেশের উপযোগী উন্নয়নকেন্দ্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের এখনই উপযুক্ত সময়।

প্রশাসনিক সংস্কার শুধু রাষ্ট্র ও জনকল্যাণ সামনে রেখেই করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল বা জনপ্রশাসনের কোনো সার্ভিস ক্যাডারের সুবিধার কথাও ভাবা যাবে না। একই সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া যাবে না বিদেশের স্বার্থ রক্ষা, কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠীর এজেন্ড বাস্তবায়ন।

বিজ্ঞাপন

প্রতিটি সার্ভিস ক্যাডারের সদস্যদের জন্য ক্যাডারসংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে সব প্রশিক্ষণ অভিন্ন পাঠক্রম অনুসরণ করে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি সার্ভিস ক্যাডারের প্রারম্ভিক পদ থেকে শুরু করে ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত সমানসংখ্যক স্তর এবং সমান বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। জনকল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি সার্ভিস ক্যাডারকে সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে বৈষম্যহীনভাবে জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।

প্রতিটি সার্ভিস ক্যাডারের সর্বোচ্চ মেধাসম্পন্ন সদস্য সহযোগে ‘উন্নয়ন সমন্বয় সার্ভিস পুল’ গঠন ও তার যৌক্তিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

জনপ্রশাসনের প্রতিটি সার্ভিস ক্যাডারকে নিজস্ব গন্ডির মধ্য থেকে সর্বোত্তম সেবা প্রদান নিশ্চিত করা এবং কোনো একক সার্ভিস ক্যাডারকেই অন্য ক্যাডারগুলোর কর্মক্ষেত্রে অনৈতিক ও অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং ক্ষমতা প্রদর্শন কঠোরভাবে রোধ করতে হবে।

গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে জনগণের সার্বিক কল্যাণকে লক্ষ রেখে প্রশাসন ক্যাডারসহ এ যাবৎ অবহেলিত ২৫ ক্যাডারকেও সমান গুরুত্ব দিতে হলে যেসব বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে, তা এখানে উল্লেখ করছি।

জাতীয় উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে সার্ভিস ক্যাডারে মেধা, দক্ষতা, সততা এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া অপরিহার্য। প্রজাতন্ত্রের কর্মসম্পাদনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত অবদান রাখার স্বার্থে সৃষ্ট সব ক্যাডারের জন্য অনুকূল কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা ও সমমর্যাদাপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার।

জনপ্রশাসনের প্রশাসন ক্যাডারের সর্বগ্রাসী ক্ষমতাকে জনকল্যাণে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসন ক্যাডারসহ সব ক্যাডারের কাঠামো আমূল সংশোধন না করলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। এ জন্য দরকার প্রতিটি সার্ভিস ক্যাডারকে বৈষম্যহীনভাবে গড়ে তোলা। প্রতিটি সার্ভিস ক্যাডারের প্রারম্ভিক পদে নিয়োগ থেকে শুরু করে ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদও একই ক্যাডারের সদস্য দ্বারা পূরণ করা উচিত।

প্রশাসন ক্যাডারের সর্বগ্রাসী ক্ষমতাকে জনকল্যাণে নিয়ন্ত্রণের জন্য অনতিবিলম্বে এ ক্যাডারটির কর্মক্ষেত্র একটি ক্যাডারের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা দরকার।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তথাকথিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে জাতীয় এবং তৃণমূলপর্যায়ে সরকারদলীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জেতাতে সাহায্য করার অভিযোগ রয়েছে। এই অবৈধ ইন্ধন জোগানোর পুরস্কার হিসেবে জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের মতো শক্তিশালী দুটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে বিকলাঙ্গ করে রাখা হয়, যেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেলা ও উপজেলার সার্বিক ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন।

১৬ বছর ধরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানের সব সিস্টেম আর নিয়মনীতি ধ্বংস করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সামগ্রিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় যত গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে যেসব ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে না পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।

দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করা থেকে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ মাঠ প্রশাসনকে বিরত রাখার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জেলা প্রশাসক পদবিটির সঙ্গে এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসনের গন্ধ বিদ্যমান। প্রশাসক শব্দটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পদবি হিসেবেই বেশি যুক্তিসংগত। তা ছাড়া ঔপনিবেশিক শাসনামলের কমিশনার, ম্যাজিস্ট্রেট ইত্যাদি পদবিগুলোও বর্জন করা উচিত।

জেলার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ের জন্য বিদ্যমান কয়েক ডজন কমিটির প্রধানের মধ্য থেকে দু-তিনটি কমিটির (যেমনÑআইনশৃঙ্খলা/ভূমি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি) প্রধানের পদে বর্তমানের জেলা প্রশাসককে রেখে জেলার অন্যান্য কমিটিগুলোর প্রধান হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত সার্ভিস ক্যাডারের জেলা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান এ ক্ষেত্রে একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের জেলা কর্মকর্তা জেলা ও উপজেলার কর্মকাণ্ডের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবেন ।

জেলা ও উপজেলায় কর্মরত বিভিন্ন সার্ভিস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আইন ও প্রশাসন-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হওয়া সাপেক্ষে স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া উচিত।

সরকারের উচিত অবিলম্বে নতুন করে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ বন্ধ করা এবং বিসিএস ভূমি ব্যবস্থাপনা (BCS Land Management) নামে একটি নতুন ক্যাডার সৃষ্টি করা।

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানপূর্বক ও অভ্যুত্থানকালে সরকারের অনৈতিক, অবৈধ, জনবিরোধী, দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে যারা প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না, তাদের সঠিকভাবে বাছাই করে পুরস্কৃত করতে না পারলে হাশা বিরাজ করবে দেশপ্রেমিক সৎ যোগ্যদের মধ্যে। একইভাবে যেসব কর্মকর্তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে দলীয় সরকারের অন্যায়, অনৈতিক আদেশ বাস্তবায়ন করেছেন, তাদেরও সঠিকভাবে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

প্রশাসনিক সংকট মোকাবিলার জন্য প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থাকা ২৫টি ক্যাডার থেকে সম্ভাবনাময় কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন পরিচালনার উপযোগী স্বল্প মেয়াদের (সর্বোচ্চ ১২ মাস) নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের মতো প্রতিটি ক্যাডারের সর্বোচ্চ মেধাভাগের সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, যেন প্রশাসন ক্যাডারকে নবসৃষ্ট বিসিএস (ভূমি ব্যবস্থাপনা) ক্যাডারভুক্তকরণকালে কোনোরূপ প্রশাসনিক সংকট সৃষ্টি না হয়।

বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সদস্যদের নবসৃষ্ট বিসিএস (ভূমি ব্যবস্থাপনা) ক্যাডারে নিরাপদ ও সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট প্রজ্ঞাপন জারি করা যেতে পারে। নবসৃষ্ট বিসিএস (ভূমি ব্যবস্থাপনা) ক্যাডারে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সদস্যদের সবার স্থান সংকুলান না হলে উন্নয়ন ও উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, বিদ্যমান এমন ক্যাডারগুলোয় তাদের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার বিচারে পদায়নের ব্যবস্থা করবে।

লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত