ফ্যাসিস্ট আমলে মিডিয়া ট্রায়াল

মো. জিল্লুর রহমান
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ৫৪

একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, অর্থ আত্মসাৎ, মাদক পাচার, যৌতুক দাবি, অ্যাসিড নিক্ষেপ বা এ ধরনের যত বড় ফৌজদারি অপরাধই করুক না কেন, আদালত কর্তৃক তার অপরাধ প্রমাণের আগ পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে তাকে অপরাধী বলা যায় না। ভয়ংকর দুর্ধর্ষ খুনি বা বড় সন্ত্রাসী হলেও তাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তির আওয়ায় আনা উচিত। এরপর তাকে অপরাধী বলা উচিত, অন্যথায় দেশ ও বিদেশে আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

বিজ্ঞাপন

বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময় প্রায়ই দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট অতি-উৎসাহী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুব আলোচিত কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম, বয়স, পেশা, বাবার নাম, এমনকি বিস্তারিত ঠিকানাসহ বাড়ির ছবি পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই দুর্ধর্ষ জঙ্গি, সন্ত্রাসী, খুনি, ধর্ষক, ডাকাত শব্দ লিখে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তির গলায় ঝুলিয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হতো।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গণমাধ্যম অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করতো , যাতে বিচারের আগেই অভিযুক্তরা জনমনে দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। যা কোনোক্রমেই আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয় এবং অভিযুক্তদের ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

গ্রেপ্তারের পর যদি সন্দেহভাজনদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, তবে সেটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। আসলে সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন সেটি মিডিয়া ট্রায়ালের নামে তাকে অপদস্থ বা সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যেই ফ্যাসিস্ট সরকারের সহায়ক দানব শক্তি হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের প্রচারের জন্য সন্দেহভাজনদের এভাবে উপস্থাপন করেছিল। অথচ যাদের অভিযুক্ত হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছিল, তারা আইনের দৃষ্টিতে কেউই অপরাধী ছিল না। তাদের বিভিন্ন কল্পকাহিনি ও নাটক সাজিয়ে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো।

গত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময় অনেক খ্যাতনামা আলেম-ওলামা ও ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ভিন্নমতের রাজনৈতিক কর্মী, প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীসহ সমাজের নানা পেশার লোক বিচারবহির্ভূতভাবে প্রথমে নাটকীয়ভাবে গুম, তারপর তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করে অপরাধী সাজিয়ে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের মাধ্যমে হেনস্তার শিকার করা হয়েছে।

অনেক সময় আলেম-ওলামা ও ইসলামি ব্যক্তিত্বদের জঙ্গি নাটক সাজিয়ে গণমাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করা হতো, যাতে জনমনে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতো। আসলে হাসিনা সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিলি এই নিরপরাধ লোকদের জঙ্গি নাটক সাজিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা এবং নিজের অবৈধ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দীর্ঘস্থায়ী করা।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, কোনো অভিযোগ ছাড়াই বা সন্দেহজনকভাবে বা প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে এনে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বা বিনা কারণেই ওই ব্যক্তির ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও চালানো হতো। অনেক উচ্চশিক্ষিত ও সম্মানিত ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গেই গালাগালি করে নির্যাতন করা হয়। শুধু তাই নয়, ব্যাপক নির্যাতন করে আদালতে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের ঘটনা ঘটেছিল। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিচারকও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শেখানো বুলি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে, ২০১২ সালে একজন বিচারক ফেনসিডিলসহ আটকের পর ফ্যাসিস্ট সরকারের হাইকোর্ট সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিল, গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোনো ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করা হয়; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটি মানা হয়নি। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে স্থায়ী জামিনের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছিল, ‘আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিমান্ডে থাকাবস্থায় দায়িত্বশীল পদে থেকে মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন বলে গণমাধ্যমে পুলিশ সুপার যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা শুধু অযাচিত অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; সম্পূর্ণ ন্যায়নীতির পরিপন্থী।

পর্যবেক্ষণে আদালত আরো বলেছিল, অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে এসে গণমাধ্যমে হাজির করে সংবাদ সম্মেলন করে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে মামলার তদন্ত নিয়ে উৎসাহী বক্তব্য দিতে দেখা যায়। গণমাধ্যমে হাজির করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বিচারে অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না। তদন্ত পর্যায়ে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে গণমাধ্যমে কতটুকু প্রচার করা যাবে, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা থাকা দরকার। নীতিমালা যাতে প্রণয়ন করা হয়, সে জন্য স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের আইজিকে পদক্ষেপ নিতে বলেছিল হাইকোর্ট।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এবং যাদের সবচেয়ে বেশি আইন মেনে চলা প্রয়োজন, সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই আইনের প্রতি সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিল, ফ্যাসিস্ট সরকারের সবচেয়ে বড় দানব বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করেই গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের গণমাধ্যমের সামনে শুধু হাজিরই করেনি, বরং তাদের অপরাধের বর্ণনা দিয়ে সমাজে এই আটক ব্যক্তিদের অপরাধী হিসেবেই পরিচিত করিয়েছিল। গণমাধ্যম ছাড়াও তাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ আটক ব্যক্তির ছবি ও অপরাধের বিবরণ প্রচার করা হতো। অথচ আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালতে প্রমাণ হলেই শুধু ওই ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা যায়।

আমাদের সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা হয়েছে, সব নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমানভাবে বিবেচনা করা হবে। একই অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, ১৯৪৮ সালের ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’র ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়া আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকারের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। একটি দেশে তখনই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সে দেশের প্রতিটি নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান হয়ে সমান সুযোগ এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার ভোগ করতে পারে।

গত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময় এসব নাটকীয় ঘটনায় সন্দেহভাজনদের আটকের পরপরই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করানোর বিষয়টি নিয়ে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকারের লঙ্ঘন উল্লেখ করে তারা বলেছেন, হাইকোর্টেরও নির্দেশনা রয়েছে গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোনো ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করা হয়। কিন্তু তখন আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে অনেক মামলাতেই সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের আটক করা হলে, তাদের ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপনের সংস্কৃতি চালু ছিল।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, আমাদের দেশের অনেক দলীয় চেতনায় বিশ্বাসী ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়াও একইভাবে অভিযুক্তকে উপস্থাপন করেছিল, নানাভাবে ট্রল করেছিল, যা ভুক্তভোগী ব্যক্তির জন্য ছিল চরম অবমাননাকর। সামাজিক সম্মানের জন্য বিব্রতকর এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

বিশেষ করে সামাজিক ভাবে পরিচিত ব্যক্তি , নারী ও শিশুদের জন্য এটা তাদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ এবং সামাজিক ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, যা অপূরণীয় ক্ষতি এবং কোটি টাকায়ও পূরণীয় নয়।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই কাউকে অপরাধী হিসেবে উল্লেখ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে না। কোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। এটি তার আইনি সুরক্ষা ও মানবাধিকার। সেটি সে করতে পারে যখন বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই গ্রেপ্তার ও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা ফ্যাসিস্ট সরকারের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তথাকথিত মিডিয়া ট্রায়ালের কারণে বিচারের আগেই অভিযুক্তরা জনমনে দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল, যা কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া, মিডিয়া ট্রায়ালের সময় দেখা গিয়েছিল, আগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন ধরনের ট্যাগ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু সে সময় সে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেনি, কারণ বিচার শুরু হয়নি। তা ছাড়া তার তখন কিছু বলারও সুযোগ দেওয়া হতো না।

বিগত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় হামলা, হত্যা, গুম, গায়েবি মামলা, ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছিল নিয়মিত ঘটনা । প্রশাসন, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থাও বিগত সরকারের ইশারা-ইঙ্গিতে চলত । মিডিয়া ট্রায়ালের নামে যাদের হত্যা, গুম, গায়েবি মামলা দিয়ে চরিত্র হনন করা হয়েছে কিংবা কথিত নাটক সাজিয়ে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে, এদের অনেকেই ছিল নিরপরাধ। তারা ছিলো ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতিহিংসার শিকার। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হচ্ছে সুশাসনের প্রধান উপাদান। যা সরকারের স্বচ্ছতা ও আইনের শাসনের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় এগুলোর কোনো বালাই ছিল না, এ কারণেই বিনাভোটের ফ্যাসিস্ট সরকার মিডিয়া ট্রায়ালের নামে মানুষকে হেনস্তা ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই অপরাধী প্রমাণের অপচেষ্টা করা হয়েছে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

সতিশ সরকার রোড গেণ্ডারিয়া, ঢাকা

zrbbbp@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত