নাজিমুক্ত জার্মানি ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ৪১
আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১: ০৩

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের পতনের পর বিশ্বজগৎ এখন ৮০ বছর অতিক্রম করছে। ইতোমধ্যে জার্মান-ইউরোপের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়ছে। সারা দুনিয়ার ছাত্ররা ওখানে যাচ্ছেন পড়তে কিংবা স্থায়ী বসতি স্থাপনের আকাঙ্ক্ষায়। চমৎকার একটি দেশ যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুসংরক্ষিত।

তবু এখনো সেখানে কিছু মানুষ বিভিন্ন ব্যানারে জার্মান নীল রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হিটলারের নাজিবাদ অনুসরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কে চায় আবার সেই জঘন্য ফ্যাসিবাদে ফিরে যেতে। তাই জার্মান সমাজ ও সরকার তাদের কখনো উন্মত্ততা প্রকাশের সুযোগ দেয় না। অর্থাৎ তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। এ ঘটনাকে হয়তো আমাদের তথাকথিত সুশীলরা নিন্দা করতে পিছপা হবেন না, যেমনটা এখন তারা করছেন।

বিজ্ঞাপন

জার্মানে ওই ধারা চলে আসছে ফ্যাসিস্ট হিটলারের পতনের পর থেকে, যখন জার্মানের সর্বস্তর থেকে নাজিমুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পাঠক, অনেকেই হয়তো জানেন, ১৯৪৫ সালে হিটলারের পতনের পর জার্মানকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়। পূর্ব জার্মানির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে। আর পশ্চিম জার্মানিকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে এক-একটা জোনের দায়িত্ব গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। তারা যার যার মতো করে ‘নাজিমুক্ত’ প্রক্রিয়া শুরু করে। এটা শুধু জার্মানিতে নয়, জার্মান অধিকৃত সব দেশেই শুরু হয়েছিল।

এটা খুবই জটিল ও কঠিন একটি কাজ ছিল। প্রায় ৮৫ লাখ নাজি সদস্য যাদের বিরাট একটা অংশ সরকার, বিচার বিভাগ, অর্থনৈতিক খাত, সংস্কৃতি, প্রকাশনা, মিডিয়া, মোদ্দাকথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিল। মিত্রবাহিনী বুঝতে পেরেছিল, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ সর্বস্তর নাজিমুক্ত না করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক জার্মান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। তাই জটিল কাজটি একটু সহজ করার জন্য তারা কয়েকটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করেন। যেমনÑগুরুতর অপরাধী, অপরাধী, অপেক্ষাকৃত কম অপরাধী, অনুসারী ও পুনর্বাসন করার মতো যারা ছিল তারা।

এ ছাড়া নাৎসি অপরাধীদের বিচারের জন্য জার্মানির ছোট্ট একটি শহর নুরেমবার্গে গঠন করা হয় একটি ট্রাইব্যুনাল, যা নুরেমবার্গ ট্রায়াল হিসেবে পরিচিত। নাজিমুক্ত করার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করাও একটি কঠিন কাজ ছিল। তবু তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নাৎসি বাহিনীর মূল অপরাধীদের বিচার করার কাজটি শরু করেছিলেন। এটা ছিল বিশ্বের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় বিচার কার্যক্রম।

বিচারের আওতায় আনা হয়েছিল শীর্ষস্থানীয় ২৪ জন নাৎসি নেতাকে, যাদের মধ্যে সামরিক, রাজনৈতিক ও সরকারি কর্তারা ছিলেন। মাত্র ২১৬ দিবসে বিচার সম্পন্ন করে রায় দেওয়া হয়। ২৪ জনের মধ্যে একজন কারাগারে সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করে এবং আরেকজন বিচারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ২২ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হয়। এতে ১২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাকিদের নানা মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা এবং সর্বস্তর নাজিমুক্ত করার প্রক্রিয়া জার্মান সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল এবং সেখানে ফ্যাসিবাদ থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনে সহায়ক হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে ঠিক সে রকম হিটলার-উত্তর একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে সিরিয়াস অপরাধে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে ধীর গতি অনেকের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে। সেই প্রচলিত কথার মতোই, বিচার বিলম্বিত হওয়া মানে বিচার না পাওয়ার শামিল। এটা কিন্তু জার্মানিতে ঘটেনি।

তবে জার্মানে নাৎসি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ও হিটলারের আত্মহত্যা নাজিদের চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছিল। অন্য কোথাও আশ্রয় গ্রহণ ও পুনঃসংগঠিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের পতিত ফ্যাসিবাদীরা অতীতেও ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, এখনো নিয়েছে। নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে, ’৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী ভারতে আশ্রয় নিয়ে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। কয়েকটি সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন সেনাসদস্যের হতাহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। তখন শেখ হাসিনা জার্মান থেকে এসে স্বামীসহ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশে ফিরেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। তখন তিনি পিতার রক্তাক্ত পতনের পর ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন; এবার দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রায় ৪৩ বছর পর নিজের পতনের পর আবার ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সে সময় তিনি একা কাঁদতে কাঁদতে ভারতে গিয়েছিলেন; এবার শত শত পরিবারের আজীবন কান্নার ঘটনা ঘটিয়ে ভারতে গিয়েছেন। কিন্তু সময় ও প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ বদলে গেছে।

বাংলাদেশ এখন আগের তুলনায় অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থ বুঝে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবময় ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

রেডিমেড পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনো শীর্ষেই আছে। আমাদের আছে দুটি সমুদ্রবন্দর, যা পৃথিবীর বহু দেশেই নেই। তাই ভারত যদি মনে করে তার সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে মরবে, তাহলে ভারতীয়রা বোকার স্বর্গেই বাস করছে। বরং বর্তমান যুগ হচ্ছে পরস্পর সহযোগিতার যুগ। এ যুগ শক্তির জোরে কোনো দেশকে দমন করে রাখার যুগ নয়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দুই পরাশক্তি আমেরিকা, রাশীয় আফগানিস্তানসহ অনেক দেশে সে চেষ্টা করে দেখেছে। কিন্তু পারেনি। সুতরাং বাংলাদেশে ভারতের প্রক্সি রাজনীতির দিন কার্যত শেষ। এখন দিল্লির সাউথ ব্লককে একটু পরিশীলিত চিন্তাভাবনা করে এগোনো ছাড়া অন্য কোনো পথ আর নেই।

বিষয়:

হিটলার
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত